শুক্রবার, ২৪ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

আল্লাহতায়ালার বড় নেয়ামত স্বাধীনতা

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

আল্লাহতায়ালার বড় নেয়ামত স্বাধীনতা

প্রখ্যাত সুফি সাহাবি হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, প্রিয়নবী (সা.) বলেছেন, ‘কুল্লু মাউলিদিন ইউলাদু আলাল ফিতরাত। অর্থাৎ, প্রতিটি আদম সন্তানই আপন স্বভাব ধর্মের ওপর জন্মগ্রহণ করে।’ (সহি বুখারি : ১২৯২, সহি মুসলিম : ২৬৫৮)।  মানুষের স্বভাব বা প্রকৃতি হলো স্বাধীন। সে স্বাধীনতা প্রিয় সৃষ্টি। মানুষ ছাড়া আর কোনো সৃষ্টিকে আল্লাহতায়ালা স্বাধীনতার নেয়ামত দেননি। স্বাধীনতা মানে শুধু স্বাধীন ভূখণ্ডই নয়, স্বাধীন বিবেক, স্বাধীন জীবনযাপন সবকিছুই এর অন্তর্ভুক্ত। স্বাধীনতাকে যদি আমরা দুই ভাগে ভাগ করি তবে স্বাধীন বাসভূমি আর জীবনযাপন বাহ্যিক স্বাধীনতায় পড়বে। আর আত্মার স্বাধীনতা, চিত্তের প্রসন্নতা এসব পড়বে অভ্যন্তরীণ ভাগে। স্বাধীনতার এ ভিতর-বাহির দুই রূপকে উপক্ষো করে কোনো জাতি বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না। এটাই খোদার চিরচারিত নিয়ম। খোদা বলেন, ‘সুন্নাতাল্লাহি কদ খালাত মিন কবলু, ওয়ালান তাজিদা লিসুন্নাতিল্লাহি তাবদিলা। অর্থাৎ, অতীতে আল্লাহর নিয়ম-বিধান-আইন-প্রকৃতি এমনই ছিল। ভবিষ্যতেও একই থাকবে। আল্লাহর ‘সুন্নাতে’ কোনো পরবির্তন-পরিবর্ধন তোমরা লক্ষ্য করবে না।’ (সূরা ফাতহ : ২৩)। ‘ওয়ালান তাজিদা লিসুন্নাতিল্লাহি তাবদীলা। অর্থাৎ, আর আল্লাহর নিয়মে কোনো ভুলও পরিবর্তন তোমরা পাবে না।’ (সূরা ফাতির ৪৩)।

নবীদের জীবন পর্যালোচনা করলে আমরা স্বাধীনতার দুই রূপই দেখতে পাই। একদিকে তারা ছিলেন স্বাধীন ভূখণ্ডের জন্য মরিয়া। অন্যদিকে ছিলেন আত্মার স্বাধীনতা অর্জনের মরমি সাধক। হজরত মুসা (আ.)-এর স্বাধীনতা সংগ্রামের বর্ণনা কোরআন এভাবে দিয়েছে— মুসা বলল, ‘হে ফেরাউন! আমি বিশ্বজাহানের প্রভুর পক্ষ থেকে প্রেরিত। আমার দায়িত্ব হচ্ছে, আল্লাহর নামে সত্য ছাড়া আর কিছু না বলা। আমি তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণ নিয়ে এসেছি। কাজেই তুমি বনি ইসরাইলকে মুক্ত করে আমার সঙ্গে পাঠিয়ে দাও।’ (সূরা আল আ’রাফ: ১০৮-৫)। আমাদের প্রিয়নবী (সা.) এর স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়েছে খোদার কাছে কাতর কণ্ঠের মোনাজাত আর চোখ ভেজা প্রার্থনা দিয়ে। সে প্রার্থনা আবার কোরআনে তুলে দিয়েছেন মাবুদ রাব্বানা। ‘হে পরওয়ারদিগার! আমাকে যেখানেই নেবেন স্বাধীন এবং সত্যের সঙ্গে নেবেন, যেখান থেকে বের করবেন স্বাধীন ও সত্যের সঙ্গেই বের করবেন। আর আপনার পক্ষ থেকে একটি কর্তৃত্বশীল পরাক্রান্ত শক্তিকে আমার সাহায্যকারী বানিয়ে দিন। (সূরা বনি ইসরাইল : ৮০।)

আগেই বলেছি, নবীগণ (আ.) বাহ্যিক স্বাধীনতার সঙ্গে অন্তরের স্বাধীনতাকেও গুরুত্ব দিয়েছেন। তাই তো আমাদের নবী (সা.) এক যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে বলেন, আমরা ছোট যুদ্ধ থেকে অবসর নিয়ে এখন বড় যুদ্ধে নামব। আর তা হলো নফসের সঙ্গে যুদ্ধ জিহাদ। নফস তথা কুপ্রবৃত্তি সবসময় মানুষকে নিজের গোলাম বানিয়ে রাখতে চায়। কিন্তু মানুষ তো তার খোদা ছাড়া আর কারও গোলামী করবে না। এ কারণেই সবসময় নফসের সঙ্গে আমাদের জিহাদ অব্যাহত রাখতে হবে। এ জিহাদে উত্তরোত্তর উন্নতি লাভ করলেই আমরা হব ‘নফসে মুতমাইন্না-তথা প্রশান্ত আত্মার’ অধিকারী। তখন আমাদের ভিতরের সুগন্ধি ছড়িয়ে পড়বে জগত্জুড়ে। বিশ্বের মানুষ অবাক নয়নে তাকিয়ে দেখবে একটি জাতির অবিস্মরণীয় উত্থান। উপলব্ধি করবে মুহাম্মাদী সুঘ্রাণ। যা মদিনার সবুজ গম্বুজ থেকে ছড়িয়ে পড়বে নবীপ্রেমিক বিশ্বপ্রাণে।

হায় আফসোস! আমরা শুধু বাইরেই স্বাধীন হতে পেরেছি। আত্মায় স্বাধীন হইনি এখনো। আমাদের ধর্মদরদি আত্মাগুলো শত দলে, শত মাজহাবের খাঁচায় বন্দী। যে খাঁচা ভেদ করে কোরআনের আলো পৌঁছতে পারে না মানব দিলে। কোরআনের আলো দেখে আমরা বলে উঠি- এ তো আমাদের মাজহাব বলেনি। আমাদের পীর-তরিকা এ আলোর পক্ষে নয়। আমরা তোমাদের নিতে পারব না হে ঐশী আলো! তোমার চেয়ে আমাদের দল-মাজহাব অনেক বেশি ভালো। হায়! উম্মতে মুহাম্মাদীর আত্মায় পড়েছে বুঝি কালোর ধুলো। মাজহাবের খাঁচায় মানবাত্মা ছটফটায়, কিন্তু মানুষ তাকে মুক্ত করে না। স্বাধীন করে না। তাই তো দুনিয়াজুড়ে মুসলমানদের এত অধঃপতন। এত লাঞ্ছনা-গঞ্জনা। পৃথিবীর নিকৃষ্ট জাতিতে আজ পরিণত হয়েছে মুসলমান। স্বাধীন ভূখণ্ডে থেকেও স্বাধীন নয় তারা। বড় ব্যথার কথা, এত অপমানের পরও ঘুম ভাঙছে না মুসলমানের। লাঞ্ছনার জীবনকেই তারা আজাদীর জীবন ভেবে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছে। তাই তো কবি নজরুল বিশ্ব মুসলমানের কাছে প্রশ্ন রেখেছেন— কোথা সে আজাদ? কোথা সে পূর্ণ মুক্ত মুসলমান?/আল্লাহ ছাড়া করে না কারেও ভয়, কোথা সেই প্রাণ?/কোথা সে ‘আরিফ’, কোথা সে ইমাম, কোথা সে শক্তিধর?/মুক্ত যাহার বাণী শুনি কাঁপে ত্রিভুবন থরথর!/কে পিয়েছে সে তৌহিদ-সুধা পরমামৃত হায়?/যাহারে হেরিয়া পরান পরম শান্তিতে ডুবে যায়/আছে সে কোরআন মজিদ আজিও পরম শক্তি ভরা,/ওরে দুর্ভাগা, এক কণা তার পেয়েছিস কেউ তোরা?

নানা মাজাহাব-দল-মতের ভিন্ন ভিন্ন কারণেই আমরা স্বাধীনভাবে কোরআনের অনুসরণ করতে পারছি না। তাই মুক্ত আত্মার মুমিন মুসলমান হতে হলে সর্বপ্রথম আত্মাকে সব দল-মত থেকে মুক্ত করে কোরআনের কাছে সমর্পণ করতে হবে। তবেই আমরা ফিরে পাব খোলাফায়ে রাশেদার স্বাধীনতাময় ইসলাম। দুনিয়ার বুকে দাঁড়াতে পারব মাথা উঁচু করে। নতুবা মাজহাবের খাঁচায় বন্দী মানবাত্মা নিয়েই আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হবে দুনিয়ায়। না পেয়েও পেয়েছি বলে বৃথা আনন্দে মেতে উঠতে হবে।  ‘কপালের লিখন, না যায় খণ্ডন বলে করতে হবে ক্রন্দন!’

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসিসরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

            www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর