রবিবার, ২৬ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

হ্যাপি বার্থ ডে টু বাংলাদেশ

মো. শাখাওয়াত হোসেন

১৭ মার্চ, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন।  দিনটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে পিএসসির চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘১৭ মার্চ তো বাংলাদেশেরই জন্মদিন’। অনন্য উচ্চতার এ মানুষটিকে নিয়ে এ ধরনের মন্তব্য করার অর্থই হলো কৃতজ্ঞচিত্তে ঋণ শোধ করার ব্যর্থ চেষ্টা। এমন চেষ্টা প্রত্যেকটা বিবেকবান মানুষ মনে মনে হলেও করে। আমি এর বাইরে নই। সম্প্রতি বাংলাদেশের জন্ম ও অভ্যুদয় দুটোকেই বিকৃত করে এক সেনাশাসককে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ছাত্রসমাজ এর তীব্র প্রতিক্রিয়াও দেখায়। এই বিকৃত তথ্য উপস্থাপনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন রেজিস্ট্রার কূটকৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করে। বিষয়টি জানতে ও বুঝতে এ দেশের ইতিহাস সম্পর্কে এক লাইন না পড়লেও চলবে। শুধু ঐতিহাসিক কিছু ছবির ওপর চোখ বুলাতে হবে। ছবিগুলোতে উল্লিখিত রাজকর্মচারী বঙ্গবন্ধুকে স্যালুটের মাধ্যমে সশ্রদ্ধ অভিবাদন জানাচ্ছেন। পৃথিবীর প্রতিটি গণতান্ত্রিক দেশে অথবা অগণতান্ত্রিক দেশে মুনিব-গোলাম সম্পর্ক এমনটাই হয়। রাজা কখনো রাজকর্মচারী হয়? এমন উদাহরণ পৃথিবীতে নেই। তবে প্রশ্নবিদ্ধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে গোলাম রাজা হয়, এমন ইতিহাস পৃথিবীতে বহু। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। তাহলে কে আগে রাজা নাকি গোলাম-রাজা? ইতিহাসের পাতা না ঘেঁটে এমন করে ভাবতে কার না ভালো লাগে? এমন ভালো লাগা থেকেই আমাদের হৃদয়ে নানা প্রশ্নের উদ্রেগ হয়। দেশ ছাড়া তো আর প্রেসিডেন্ট হয় না। বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট মানে বাংলাদেশ নামক দেশটির যেদিন জন্ম, সেই দিন থেকেই তিনি প্রেসিডেন্ট। তাহলে বাংলাদেশের জন্মদিন কবে? এটা প্রায় সবারই জানা। তবে অনেকেই বলে থাকি ১৬ ডিসেম্বর। তা কিন্তু নয়।

২৬ মার্চ, বাংলাদেশের শুভ জন্মদিন। তবে তা আইনগত ভিত্তিতে। তাই দিনটির প্রকৃত ঘটনা প্রবাহ যৌক্তিক ব্যাখ্যার দাবি রাখে। আইনগত ভিত্তির বিষয়টি আপাতত ভাবনায় না নিলে দেশের প্রকৃত জন্মদিন ১০ এপ্রিল। এ দিন ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশের সরকার গঠন করা হয় এবং বাংলাদেশের নাম রাখা হয়— ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’। খবরটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রচার করা হয়। প্রবাসে এদেশের জন্ম ও নামকরণ। তাই এই সরকারকে প্রবাসী সরকারও বলা হয়। প্রবাসে গঠিত সরকার, ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার মেহেরপুরে শপথ গ্রহণ করে। শপথ গ্রহণ ছিল নবগঠিত সরকারের বাধ্যতামূলক রুটিন ওয়ার্ক। একটি গণতান্ত্রিক দেশের সরকার গঠনের ভিত্তি হলো সংবিধান। কুষ্টিয়ায় আনুষ্ঠানিকভাবে সরকার গঠনের সংবিধান ১০ এপ্রিল প্রণীত হয়। এর নাম রাখা হয় ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’। যার অন্য নাম বাংলাদেশের সাময়িক সংবিধান। ১০ এপ্রিল প্রণীত হয় বিধায় ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে পঠিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে পেছনের তারিখ অর্থাৎ ১০ এপ্রিল ব্যবহার করা হয়েছে। অনেকেই মজা করে বলেন, অনুষ্ঠান হোক বা না হোক জন্মদিন তো আর পরিবর্তন হয় না। এই সাময়িক সংবিধানের ওপর ভিত্তি করেই এ দেশের জন্ম। কেউ যদি এই সংবিধানকে অস্বীকার করে সে যেন বাংলাদেশের জন্মকেই অস্বীকার করে। সাময়িক সংবিধানের পঞ্চম প্যারায় উল্লেখ করা হয়, ‘সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তারিখে ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন এবং বাংলাদেশের মর্যাদা ও অখণ্ডতা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।’ বাংলাদেশের জন্ম দলিলে উল্লিখিত অংশ অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। যারা করে এ দেশ তাদের নয়, তাদের দেশ পাকিস্তান। ওইদিন প্রাতিষ্ঠানিক জন্মলগ্নে পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াত করা হয়। পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে যে দেশের জন্ম সে দেশে সত্য প্রতিষ্ঠিত হবেই। আর গোলাম-রাজা সম্পর্কিত কৃত্রিম ও কাল্পনিক ধারণা নিক্ষিপ্ত হবে আঁস্তাকুড়ে। তাই নয় কি?

১৮ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে আনন্দ বাজার পত্রিকায় ‘নতুন রাষ্ট্র নতুন জাতি জন্ম নিল’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘একটি রাষ্ট্র আজ সকালে জন্ম নিল। এই নতুন নগরে সে রাষ্ট্রের নাম গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্র। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ। তার জন্মলগ্নে সহস্র কণ্ঠে জয়ধ্বনি  উঠল ‘জয় বাংলা’। তাই এই স্লোগানে আমরা খুঁজে পাই এ দেশের জন্মের ঠিকানা। যে রাজনৈতিক দল এই স্লোগান বাঙালি জাতিকে উপহার দিয়েছিল সেই দল হারিয়েছে তার অধিকার। এটি আর দলীয় স্লোগান নয়। এটি হলো বাঙালি জাতির স্লোগান। যারা আজ এই স্লোগান মুখে নিতে সংকীর্ণতা বোধ করে স্বাধীনতার প্রশ্নে তাদের অবস্থান ছিল উল্টো। তারা কেউ কিন্তু পাকিস্তানে চলে যায়নি। এ দেশেই তাদের বসবাস। এই সংকীর্ণতায় ঊর্ধ্বে উঠে দেশের মাটির টানে নিজের মমতাকে জড়ানো আজ সময়ের দাবি। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখরিত এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন দেশি-বিদেশি বহু খ্যাতিমান সাংবাদিক। সেদিন আকাশে ছিল থোকা থোকা মেঘ। সঙ্গে ছিল না শুধু আমাদের খোকা। বাঁধভাঙা স্লোগানের মাঝেও আমরা যেন শুনতে পেয়েছি খোকার কবর খোঁড়ার শব্দ। তবুও বাঙালি টলেনি। বুক ভরা সাহস নিয়ে এগিয়ে চলেছে। আর চেতনায়-ভাবনায় ধারণ করেছে, ‘খোকা ছিল সাড়ে সাত কোটি বাঙালির। আজ সেই পরিচয়ে নয়, তা তো হৃদয়েই ধারণ করেছি। আজ খোকা হলো সোনার হরফে লেখা বাংলাদেশ। কেননা তিনি আজ থেকে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি। এখন কবর খুঁড়বে কার? সাড়ে সাত কোটি বাঙালির নাকি বাংলাদেশের? পাকিস্তান সে সাহস দেখায়নি। জাতির পিতা বেঁচে গেলেন। বেঁচে গেল বাঙালি জাতি। ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে পঠিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত সিদ্ধান্ত মোতাবেক ঘোষণাপত্রটি ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর বলে উল্লেখ করা হয়। নতুন সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত এটিই ছিল দেশের রক্ষা কবচ। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ তারিখে বাংলাদেশের নতুন সংবিধান প্রণীত হয়। নতুন সংবিধান প্রণীত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সাময়িক সংবিধান বা ঘোষণাপত্রটি রহিত হয় যা সংবিধানের ১৫১ ধারায় উল্লিখিত। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেই বাঙালি জাতি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেদিন থেকেই বাংলাদেশ স্বাধীন।  তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়, স্বাধীনতার জন্য আমরা নয় মাস যুদ্ধ করিনি।  যুদ্ধ করেছি মুক্তির জন্য। তাই বাঙালি বীর সৈনিকদের আমরা শ্রদ্ধা করি স্মরণ করি ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে ‘বীর স্বাধীনতাযোদ্ধা’ হিসেবে নয়।  

লেখক : শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর