সোমবার, ২৭ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

দুর্নীতিবাজদের সম্পদ বংশধররাও ভোগ করতে পারবে না

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান হিসেবে এক বছর পার করলেন সরকারি প্রশাসনের এক সময়ের শীর্ষ কর্মকর্তা ইকবাল মাহমুদ। দুদক নামের প্রতিষ্ঠানটিকে ভিতর থেকে বদলে দিয়েছেন তিনি। অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র সচিব ইকবাল মাহমুদ গত বছরের ১৪ মার্চ নতুন দায়িত্বে যোগ দিয়েই বিভিন্ন কঠোর পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে আলোচনায় এসেছেন। যার মধ্য দিয়ে দুদক সাধারণ মানুষের আস্থার জায়গায় ফিরে এসেছে। বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের ১৯৮১ ব্যাচের এই কর্মকর্তার সততা, দৃঢ়তা এবং নিষ্ঠার খ্যাতি ছিল চাকরিজীবনজুড়ে। তিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সিনিয়র সচিবসহ দেশ-বিদেশে ২৪টি দফতরে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) বিকল্প নির্বাহী পরিচালক, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালকসহ বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থায় দায়িত্ব পালন করেন। তার স্ত্রী মিসেস খাদিজা বেগম একজন চিকিৎসক। তাদের এক কন্যা ও পুত্রসন্তান রয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের পিএইচডির ছাত্র ইকবাল মাহমুদ তার গবেষণাকর্ম শেষ করে এনেছেন। গত এক বছরে তার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে দেশে দুর্নীতির প্রকোপ কমে যাওয়া এবং দুদকের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে নেওয়া তার বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন বৃহস্পতিবার দুপুরে। বলেছেন, সরকারের উচ্চপদস্থ কেউ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত হলেও দুদক তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করবে। প্রমাণ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেবে। তিনি বলেন, তালিকাভুক্ত ১৭ মাদক সম্রাটের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের নোটিস দেওয়া হবে শিগগিরই। সম্পদের হিসাবে গরমিল হলেই মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার করা হবে। তিনি বলেন, সরকারি কাজের গাফিলতির জন্যই দুর্নীতি হয়। কাজের পদ্ধতি উন্নত হলে দুর্নীতি কমে যাবে। দুর্নীতি যারা করতে চান তারা খামোশ হয়ে গেছেন। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ উদ্ধার করে রাষ্ট্রীয় খাতে জমা দেওয়া হবে। দুর্নীতিবাজদের সম্পদ বংশধরদের ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শিমুল মাহমুদ ও মোস্তফা কাজল।

 

বাংলাদেশ প্রতিদিন : দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে আপনার দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর পেরুলো। যে প্রত্যাশা নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন তার কতটা পূরণ হলো?

ইকবাল মাহমুদ : প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির মধ্যে যথেষ্ট ফারাক রয়েছে। তবে প্রাপ্তি আছে। আমরা যা চেয়েছিলাম, দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে, তা করতে পেরেছি। তবে অতটা উচ্চাশা করা হয়তো ঠিক হয়নি। আমাদের প্রত্যাশা বেশ উঁচু মার্গের ছিল। সে তুলনায় কাজ না এগোলেও আমরা বার্তা দিতে চেয়েছিলাম যে কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। দুর্নীতি করলে কেউ ছাড় পাবে না। এই বার্তা সমাজকে দিতে পেরেছি। সমাজের ক্ষমতাধরদের মধ্যেও বার্তা দিতে পেরেছি। সম্পদশালীরা মনে করেন, তারা যা ইচ্ছা করতে পারেন। এটা ঠিক নয়। আগে অনেকে মনে করতেন হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেও পার পাওয়া যায়। এটা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কোনো প্রভাবশালী আইনের ঊর্ধ্বে নন। টাকা আত্মসাৎকারীরা গ্রেফতার হয়েছেন। ব্যাংকের দুর্নীতিবাজদের কাউকে ছাড় দেওয়া হয়নি। তারা আইনের আওতায় এসেছেন। এ ক্ষেত্রে আমরা মিডিয়ার অনেক সহায়তা পেয়েছি।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল এ মাসের শুরুতে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় ১৬টি দেশে জরিপ শেষে জানিয়েছে, ঘুষ লেনদেনের শীর্ষে রয়েছে ভারত ও ভিয়েতনাম। সেই তালিকায় বাংলাদেশ নেই। বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের দেশেও ঘুষের লেনদেন হচ্ছে। তবে এখন আগের চেয়ে অনেক কমেছে। দুদকের গত এক বছরের কর্মকাণ্ডের প্রভাবেই এটা হয়েছে বলে আমরা মনে করি।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : দুর্নীতিবিরোধী কর্মকাণ্ডে আপনার নিজের প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা কেমন পাচ্ছেন? দুদকের কারও কারও বিরুদ্ধেই অভিযোগ আছে দুর্নীতিতে জড়ানোর।

ইকবাল মাহমুদ : দুদকে দুর্নীতি আছে কথাটা ঠিক নয়। সব ক্ষেত্রেই দুর্নীতি রয়েছে। দুর্নীতির সঙ্গে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা, বাহিনীর সদস্য জড়িত। তবে অন্যায় করে পার পাওয়া যাবে না, সেই বার্তা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এক সময় দুদক ছিল একটা দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান। তবে আমার এই চত্বরে এখন ঘুষের কোনো লেনদেন নেই। এ বিষয়টি মনিটরিং করা হচ্ছে। বাইরে হয়তো হতে পারে। দুর্নীতির কারণে দুদকের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিছু রিফর্ম হয়েছে। সিস্টেমেটিক পরিবর্তন এসেছে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : ২৬ মার্চ থেকে দুর্নীতি প্রতিরোধ সপ্তাহ পালন করছে দুদক। এই সময়টাকে কেন বেছে নেওয়া হলো?

ইকবাল মাহমুদ : আমাদের মূল লক্ষ্য হলো দুর্নীতি প্রতিরোধে সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করা। এটি আমাদের স্বাধীনতার মাস, মুক্তির মাস। দেশের প্রতি মানুষের আবেগটাকে ধরার চেষ্টা করছি এই মাসে। মানুষের মানসিকতায় চাপ সৃষ্টি করার জন্য এই মাসে প্রতিরোধ সপ্তাহ পালন করছি। এর মধ্য দিয়ে আমরা দুর্নীতি প্রতিরোধে নানা ধরনের পদক্ষেপ জনগণের কাছে উপস্থাপন করব। এ জন্যই স্বাধীনতার মাসে ২৬ মার্চ দুর্নীতি প্রতিরোধ সপ্তাহ পালন করছি।

জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছাড়া দুর্নীতি কমবে না। জনগণ সম্পৃক্ত হয়েছিল বলেই একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হতে পেরেছিল। সেই সময় দেশ স্বাধীনের পাশাপাশি আমাদের প্রত্যাশা ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি। সেই লক্ষ্যের দিকেই এগোচ্ছে বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক মুক্তির পথে বড় বাধা দুর্নীতি। দুর্নীতির মাত্রা কমিয়ে অর্থনৈতিক মুক্তি ত্বরান্বিত করতে হবে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেদিন বলেছেন, ‘আমরা দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করেছি। তারা এখন স্বাধীনভাবে কাজ করছে।’ আমিও মনে করছি, কোনো ধরনের চাপ বা তদবির ছাড়াই দুদক তার আপন গতিতে চলছে। এই প্রতিষ্ঠানের তদন্ত কর্মকর্তারা স্বাধীন ও নিরপেক্ষ। আমি দেশবাসীকে জানাতে চাই, আমরা কাউকে অযথা গ্রেফতার করি না। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া তলব করা হচ্ছে না। তবে দুদকের নোটিসের জবাব ও অফিশিয়াল যোগাযোগ থাকলে কাউকে গ্রেফতারের প্রয়োজন পড়ে না। সরকারি কাজে দুর্নীতি না হলে দেশের সামগ্রিক দুর্নীতি কমে যেতে বাধ্য। আমি নথি দেখার সময় কার বিরুদ্ধে অভিযোগ তা দেখি না। কারণ, নাম দেখলে দেখা যাবে আমার সহকর্মী, আত্মীয়স্বজন, এমনকি পরিচিতদের নাম বেরিয়ে আসতে পারে। এসব কারণে নথি দেখার সময় আমি অভিযুক্তের নাম দেখি না। বিষয়বস্তু ও অভিযোগ দেখি।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : গত বছর আপনি আমাদের বলেছিলেন, তিনটি বিষয় নিয়ে কাজ করবে দুদক। শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার, স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি প্রতিরোধ ও আর্থিক খাতের দুর্নীতি প্রতিরোধ। এ বিষয়গুলো নিয়ে কত দূর কাজ হয়েছে?

ইকবাল মাহমুদ : শিক্ষা খাতে সংস্কারের জন্য আমাদের কাজ চলছে। আমাদের তদারকির কারণে ১৫টি স্কুলে এবার ভর্তিবাণিজ্য হয়নি। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ নিজেই বলেছেন, দুদকের কারণে স্কুলগুলোয় ভর্তিবাণিজ্য হয়নি। এই কাজটা আমরা আরও বাড়াতে চাই। এদিকে টেস্ট পরীক্ষায় ফেল করা শিক্ষার্থীকে পরীক্ষার সুযোগ দেওয়া হয়েছে কিনা তা দেখা হচ্ছে। প্রত্যেক জেলা প্রশাসককে আমরা বলেছি স্কুলগুলোর টেস্ট পরীক্ষার খাতা দেখতে। দেশে শিক্ষার মান তখনই বাড়বে যখন শিক্ষার্থীদের ঠিকমতো ক্লাসরুমে নেওয়া যাবে। ফেল করা কোনো ছাত্রকে পরীক্ষা দিতে না দিলে ছাত্ররা পড়ার টেবিলে যাবে।

সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক বছরে আমরা ২১ হাজার সততা সংঘ চালু করেছি। এ বছর আরও ২০ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সততা সংঘ করা হবে। দুর্নীতি প্রতিরোধে এই কার্যক্রম সুদূরপ্রসারী ফল বয়ে আনবে বলে আমরা মনে করি। সততা সংঘের মাধ্যমে আমরা স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের দুর্নীতিবিরোধী স্লোগানসংবলিত খাতা, জ্যামিতি বক্স, স্কেলসহ বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণ দিচ্ছি। এ জন্য সরকারের কাছে ৫ কোটি টাকা চাওয়া হচ্ছে। এর পাশাপাশি দুর্নীতি প্রতিরোধ কার্যক্রম জোরদার করতে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত কমিটি করা হচ্ছে।

আর্থিক খাতের দুর্নীতি প্রতিরোধে গত এক বছরের কার্যক্রম যথেষ্ট ফলপ্রসূ হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় ঢালাও ঋণ দেওয়ার প্রবণতা বন্ধ হয়েছে। ঋণ নিয়ে স্বেচ্ছাচারিতা কমে এসেছে। ইতিমধ্যে ঋণ নিয়ে অনিয়মের কারণে বিভিন্ন ব্যাংকের ৮৬ কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্যদিকে হলমার্কের সব মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হয়েছে। বিসমিল্লাহ গ্রুপের বিরুদ্ধে ১২টি মামলা ছিল। এর মধ্যে ১০টির চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। দুই মামলার অধিকতর তদন্ত চলছে। আমাদের কার্যক্রমের ফলে ব্যাংকাররা সচেতন হয়েছেন। ঋণের গ্রোথ বেড়ে গেছে। অনিয়ম দূর হয়েছে।

 

বাংলাদেশ প্রতিদিন : দুর্নীতি প্রতিরোধ কার্যক্রমে নতুন তিনটি ইউনিটের কাজ চলছে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত বলবেন?

ইকবাল মাহমুদ : দুর্নীতি প্রতিরোধ কার্যক্রম গতিশীল করতে আমরা নতুন তিনটি ইউনিট সৃষ্টি করছি। সেগুলো হচ্ছে— এনফোর্সমেন্ট ইউনিট, অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট ইউনিট ও ইন্টেলিজেন্ট ইউনিট। এ বছর আমরা আরও জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে চাই। এ কারণে ২১টি প্রাতিষ্ঠানিক টিম গঠন করা হয়েছে। আমরা জনগণকে দেশের দুর্নীতির উৎস জানাতে চাই। দুদক মনে করে জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছাড়া দুর্নীতি কমবে না।

দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে রাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তর করতে গঠন করা হচ্ছে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট বা সম্পদ ব্যবস্থাপনা ইউনিট। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দুর্নীতির খোঁজ করা ও দুর্নীতিবাজদের আইনের আওতায় আনবে গোয়েন্দা ইউনিট। এ ছাড়া দুদকের সার্বিক নিরাপত্তা জোরদার ও আসামি ধরার সময় নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে এনফোর্সমেন্ট ইউনিট গঠিত হচ্ছে। দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধে দুদকের সাংগঠনিক কাঠামো শক্তিশালী করতে এসব ইউনিট হচ্ছে। কমিশন স্বাবলম্বী হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে কাজ করতে চায়। আদালতে দুর্নীতিবাজদের শাস্তি হলে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত তাদের সম্পদের বিষয়ে কিছু হয় না। এখন থেকে ওই সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার আবেদন জানানো হবে। আদালতের আদেশ অনুযায়ী দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের রিসিভার হওয়া এবং ওই সম্পদ রাষ্ট্রীয় খাতে জমা দিতে কাজ করবে সম্পদ ব্যবস্থাপনা ইউনিট। দুর্নীতির দায়ে আদালত যার বিরুদ্ধে শাস্তির রায় দেবে তার সম্পদ বংশধরদের ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। বর্তমানে দুর্নীতির যেসব অভিযোগ বাক্সে জমা পড়ে বা ডাকে পাঠানো হয় সেগুলোই যাচাই-বাছাই করে অনুসন্ধান করা হয়। এ ছাড়া সংবাদপত্রে প্রকাশিত দুর্নীতির খবরও আমলে নিয়ে অনুসন্ধান করা হয়। এবার দুদক কর্মকর্তারা নিজের উদ্যোগে দুর্নীতি খুঁজে বের করে কমিশনে পেশ করবেন। পরে কমিশন অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেবে। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দুর্নীতি খুঁজে বের করতেই নিজস্ব গোয়েন্দা ইউনিট গঠন করা হচ্ছে। এ ছাড়া দুদকের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও দিন বা রাতে আসামি ধরার সময় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে এনফোর্সমেন্ট ইউনিট গঠিত হচ্ছে। এ লক্ষ্যে ৫০ সদস্যের আর্মড ফোর্স চাওয়া হবে সরকারের কাছে। পর্যায়ক্রমে এই ইউনিটে দুদকের নিজস্ব সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলা হবে। দুর্নীতি মামলায় গ্রেফতার আসামিদের হেফাজতে রাখতে দুদক কার্যালয়ে নিজস্ব হাজতখানা নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : সাধারণত ভূমি অফিসে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়। জমি রেজিস্ট্রেশনসহ বিভিন্ন কাজে ঘুষ লেনদেন হয়। এ ব্যাপারে বেশকিছু অভিযান চালিয়েছে দুদক। বিস্তারিত বলবেন?

ইকবাল মাহমুদ : ভূমি অফিসের দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। তবে দুদকের বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে ভূমি অফিসের দুর্নীতির মাত্রা কমেছে। আমরা এ সেবা সংস্থায় ফাঁদ অভিযানসহ নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে ভূমি অফিসে আগের চেয়ে দুর্নীতি কমেছে। সাব-রেজিস্ট্রার, তহসিলদারসহ ২২ জনকে গত এক বছরে গ্রেফতার করা হয়েছে। ভূমি অফিসের দালাল ও টাউটদের নির্মূলে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আমাদের বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা গেছে। দুর্নীতি যারা করতে চান তারা খামোশ হয়ে গেছেন। ১০ টাকা কেজি দামের চাল বিতরণ নিয়ে দুর্নীতির অনেক অভিযোগ ছিল। গরিবের চাল নিয়ে অনিয়মের অভিযোগে ইউনিয়ন পরিষদের ১০ চেয়ারম্যানসহ ১৮ জনকে গত ছয় মাসে গ্রেফতার করেছে দুদক। বর্তমানে এ চাল নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই। চাল বিতরণ নিয়ে সরকারের লক্ষ্য পূরণ হয়েছে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : মাদক নিয়ন্ত্রণেও কাজ করছে দুদক। আপনাদের টিম মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরে গেছে। আপনাদের মাদকবিরোধী কাজটা কেমন হবে?

ইকবাল মাহমুদ : মাদক নিয়ে আমরা জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছি। দেশের তরুণ সমাজ, শিক্ষিত যুবক গোষ্ঠী মাদকের ভয়াল থাবায় আক্রান্ত। এসব দিক বিবেচনা করে আমি কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মতবিনিময় সভা করেছি। আমরা দুদক থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে আপাতত মাদকের ১৭ জন গডফাদার চিহ্নিত করেছি। এই মাদক সম্রাটদের সম্পদের হিসাব চাওয়া হচ্ছে। অনুসন্ধান পর্যায়েই তাদের গ্রেফতার করার নির্দেশ দেওয়া আছে। সম্পদের গরমিল পেলেই তাকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হবে। মাদক ব্যবসার সঙ্গে সরকারি কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কাউকে ছাড়া হবে না। আমরা মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কাছে মাদকের উৎস, কারবারি ও খদ্দরের তালিকা চেয়েছি। এ ছাড়া মাদক নিয়ে কী কী ধরনের আর্থিক লেনদেন হয়, কারা জড়িত, এসব নিয়ে গণমাধ্যমের কাছে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ—রাজউক নিয়ে সাধারণ মানুষের অভিযোগের শেষ নেই। এ নিয়ে আপনারা গণশুনানি করেছিলেন। এর ফলাফল কী হলো?

ইকবাল মাহমুদ : রাজউকের সেবা প্রাপ্তি নিয়ে সাধারণ মানুষের হয়রানি ও ভোগান্তি অনেক। আমরা দুদক থেকে গণশুনানি ও গণশুনানির ফলোআপ করেছি। দুই দফায় তিন শতাধিক মানুষের সমস্যা চিহ্নিত করে প্রস্তাব রাজউকের হাতে তুলে দিই। পাশাপাশি রাজউক চেয়ারম্যান দুর্নীতি প্রতিরোধে আমার সঙ্গে আলাপ করেছেন। তারা ৫০ ভাগ সমস্যার সমাধান করেছেন। তারা আমাদের কথা দিয়েছেন, বাকি সমস্যারও সমাধান হয়ে যাবে। ফলে ভবন নির্মাণের নকশা অনুমোদন, ভূমির ছাড়পত্র এবং প্লট বরাদ্দের ক্ষেত্রে জটিলতা কিছুটা হলেও দূর হয়েছে। ঘুষের হারও কমেছে। রাজউকে কী কী ক্ষেত্রে ঘুষের লেনদেন হয়, তার একটি প্রতিবেদন শিগগিরই মিডিয়ার মাধ্যমে উপস্থাপন করা হবে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কেমন সাড়া পাচ্ছেন?

ইকবাল মাহমুদ : সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আমরা যথেষ্ট সাড়া পাচ্ছি। আমরা সম্প্রতি স্কুল শিক্ষার্থীদের নিয়ে মানববন্ধন করেছি। এতে প্রায় আড়াই লাখ শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছে। ‘দুর্নীতিকে না বলুন’ শিরোনামের এই মানববন্ধনে শিক্ষার্থী ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অসংখ্য মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছেন। আমরা আগামী প্রজন্মকে দুর্নীতির রাহুগ্রাসমুক্ত রাখতে চাই। সমাজের সব ক্ষেত্রেই এখন দুর্নীতি হচ্ছে। তবে দুদকের তৎপরতার কারণে বর্তমানে তার মাত্রা কমে এসেছে। আমরা ট্যাক্স বিভাগকে বলেছি, যাদের জাতীয় পরিচয়পত্র থাকবে (এনআইডি) তাদের সবার করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) থাকতে হবে। বছর শেষে আয় না থাকলে তারা শূন্য দেখাবেন। প্রয়োজনে রিটার্ন জমা দেবেন অনলাইনে। আমরা মনে করছি, যাদেরই এনআইডি থাকবে তাদেরই টিআইএন থাকতে হবে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : দুর্নীতির অভিযোগে যেসব মামলা চলছে সে সম্পর্কে বলবেন?

ইকবাল মাহমুদ : দুদকের মামলায় সাজার হার গত এক বছরে ২২ ভাগ থেকে ৫৪ ভাগে উন্নীত হয়েছে। এসব মামলা আসলে আগের মামলা। আমাদের তো উকিলকে টাকা দিতে হয়। সুতরাং সে যে টাকা নেয় তা যৌক্তিক হতে হবে। সে জন্যই আমরা মনিটরিং বাড়িয়ে দিয়েছি। এর ফলও পাওয়া যাচ্ছে। তবে আমি মনে করি, দুর্নীতির মামলা এত বেশি হওয়ার কোনো দরকার নেই। দুর্নীতির মামলা হবে কম, তবে যা হবে তা যেন দৃষ্টান্তমূলক হয়। আমি মনে করি, কাউকে না শুনে অভিযোগ করা যাবে না। কেউ যদি আইনের কাছে না আসে তাহলে তো তাকে অ্যারেস্ট করতেই হয়। আমরা কাউকে গ্রেফতার করতে চাই না। আমাকে আপনার শুনতে হবে। তিনবার নোটিস দিলাম। আসেন না। আমাদের তদন্ত কর্মকর্তাদের তো সময়সীমা বেঁধে দেওয়া আছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাউকে না পেলে তাকে শোকজ করা হয়। সেই শোকজের জবাব দিতে হয়। সে জন্য কঠোর হওয়ার বিকল্প নেই। আসলে আমাদের দুদক তো সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান। কিছু দিন আগে এক ব্যবসায়ীর ছেলেকে গ্রেফতার করতে হয়েছে। তাকে অনেকবার নোটিস করা হয়েছিল। তিনি আসেননি। ফলে গ্রেফতার করতে হয়েছিল। তার ভাইকে নোটিস করা হয়েছিল। তিনি এসেছেন। গ্রেফতার করার প্রয়োজন হয়নি। আমরা মনে করি, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যদি আইন মেনে চলেন তাহলে দেশে দুর্নীতি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

সর্বশেষ খবর