বৃহস্পতিবার, ৩০ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধুর সেই মেসেজ কে প্রচার করেছিলেন

নূর-উন-নেছা নীরু

বঙ্গবন্ধুর সেই মেসেজ কে প্রচার করেছিলেন

১৯৭১ এর ২৫ মার্চের রাতে ঢাকা থেকে বেতারে বঙ্গবন্ধুর একটি বার্তা সম্প্রচার করা হয়েছিল। কী ছিল সেই বার্তায়? গুটিকয়েক মানুষ তা শুনেছিলেন। কয়েকজনের লেখায় সেটির পরোক্ষ আভাস মিললেও পরিষ্কার কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। তবে শহীদ ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম নুরুল হকের পত্নীর কাছে ১৯৭২ সালে লেখা বঙ্গবন্ধুর একটি চিঠিতে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু লিখেছিলেন— প্রিয় বোন, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আপনার সুযোগ্য স্বামী আত্মত্যাগ করেছেন। আপনাকে আমি গভীর দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি আমার আন্তরিক সমবেদনা। আপনাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি রইল আমার প্রাণঢালা সহানুভূতি। এমন নিঃস্বার্থ মহান দেশপ্রেমিকের স্ত্রী হওয়ার গৌরব লাভ করে সত্যি আপনি ধন্য হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে আপনার পরিবারের সাহায্যার্থে আপনার সংশ্লিষ্ট মহকুমা প্রশাসকের নিকট ১০০০/- টাকার চেক প্রেরিত হলো। চেক নং-সিএ-০০৬৮৯৮। আমার প্রাণঢালা ভালোবাসা শুভেচ্ছা নিন। (স্বাক্ষর) শেখ মুজিব। দেশের তৎকালীন সেরা টেলিকম ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম নুরুল হক। ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা ও ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলনে দেশ রাজনৈতিকভাবে টালমাটাল। নুরুল হক পাকিস্তানের দেওয়া সম্মানজনক ‘তমঘা-ই-ইমতিয়াজ’ খেতাব পরিত্যাগ করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের দিকে হাত বাড়িয়ে দেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তিনি নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নুরুল হকের কী বিষয় নিয়ে আলোচনা হতো সেটা আজ জানার কোনো উপায় নেই। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে দিয়েছিলেন সঠিক দিকনির্দেশনা। তার অমর কথা ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি যার যা আছে তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে’। এই মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে এবং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে নুরুল হক তার বানানো ট্রান্সমিটার খুলনা থেকে ঢাকায় আনান। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ছিলেন তার এক ঘনিষ্ঠজন, তিনিও ছিলেন কুষ্টিয়া জেলার। ব্যারিস্টার আমিনুল ইসলাম তার সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ২৫ মার্চ বেলা আড়াইটার দিকে নুরুল হক তার সঙ্গে দেখা করতে যান এবং তাকে জানান যে, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তিনি (নুরুল হক) খুলনা থেকে একটি ট্রান্সমিটার আনিয়েছেন। যখন নুরুল হক ব্যারিস্টার আমিনুল ইসলামের কাছে জানতে চান পরবর্তী কার্যক্রম কী হবে, তখন আমিনুল ইসলাম তাকে জানান, ‘আপনি ওয়্যারলেসে কী বলবেন তা কি আমি বলে দিব এবং ওটা লিখে দেব?’ নুরুল হক বলেন, ‘আমি জানি কী বলতে হবে, ইট উইল কস্ট মাই লাইফ বাট আই  উইল ডু ইট’। (পৃষ্ঠা ২৬৫, তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা)।

২৫ মার্চ রাতে নুরুল হক ঘরের দরজা বন্ধ করে কাজ করেছেন অনেক রাত পর্যন্ত। রাত প্রায় ১২টার দিকে বঙ্গবন্ধুর বাসায় ফোন করেন, সেই ফোন ধরেন বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী হাজী গোলাম মোর্শেদ। ফোন করে নুরুল হক গোলাম মোর্শেদ সাহেবকে বলেন যে, ‘আমি বলধা গার্ডেন থেকে বলছি, মেসেজ পাঠানো হয়ে গিয়েছে, মেশিন নিয়ে কী করব’? হাজী গোলাম মোর্শেদ বঙ্গবন্ধুকে বলতেই বঙ্গবন্ধু বলেন, মেশিনটা ভেঙে ফেলে পালিয়ে যেতে বল। কিন্তু নুরুল হক কোথাও পালাননি, মহাখালী ওয়্যারলেস কলোনির তার সরকারি বাসাতেই তিনি থেকে গিয়েছিলেন। তখন বঙ্গবন্ধু ছিলেন কড়া নজরদারিতে, তার ফোনালাপ রেকর্ড করা হতে পারে ভেবেই নুরুল হক বলধা গার্ডেনের কথা উল্লেখ করেছিলেন, যা ছিল অবধারিতভাবেই একটি সাংকেতিক শব্দ যাতে বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারেন কে মেসেজ পাঠিয়েছেন এবং কী মেসেজ পাঠানো হয়েছে। ২০১৪ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ প্রতিদিনে মুহম্মদ জাফর ইকবাল লিখেছেন, পাকিস্তানি মিলিটারি অফিসার সিদ্দিক সালিকের বইয়ে দেখেছি, ‘পঁচিশে মার্চ রাতে খুবই ক্ষীণভাবে একটি স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারিত হয়েছিল। ঘোষণাটি কোথা থেকে এসেছিল তার একটি ব্যাখ্যা শারমিন আহমেদের ‘তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা’ বইয়ে দেওয়া আছে। ট্রান্সমিটার বানানোতে পারদর্শী ইঞ্জিনিয়ার নুরুল হক ঘোষণাটি প্রচার করেছিলেন। ব্যারিস্টার আমিনুল ইসলাম ৭ নভেম্বর ২০১৪ তারিখে প্রকাশিত দৈনিক জনকণ্ঠে ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও আমাদের সংবিধান’ কলামে লিখেছেন, মেসেজের প্রথম দালিলিক প্রমাণ আমাদের হাতে এলো যখন সীমান্ত পার হওয়ার পর আমাদের গোলক মজুমদার অভ্যর্থনা জানাতে সীমান্তে এলেন তখন। গোলক মজুমদার জানালেন, বঙ্গবন্ধুর ওয়্যারলেস মেসেজ তাদের ওয়্যারলেসেও ধরা পড়েছে। সেই মেসেজের একটা কপি তিনি আমাদের দেন। আমিনুল ইসলাম তাজউদ্দীন আহমদকে বলেছিলেন, ইঞ্জিনিয়ার নুরুল হক তার প্রতিশ্রুতি রেখেছেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ওপর নির্মিত প্রামাণ্য চিত্রেও  জেনারেল সফিউল্লাহ পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিকের বইয়ে বর্ণিত ওয়্যারলেস মেসেজের কথা উল্লেখ করেছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মেসেজটা কী ছিল? তার উত্তর এখন পাওয়া সম্ভব নয়। যারা মেসেজটা শুনেছিলেন তারা আজ আর কেউ বেঁচে নেই। সেই মেসেজের একটা কপি ব্যারিস্টার আমিনুল ইসলামের কাছে পরবর্তীতে হস্তান্তর করা হয়েছিল, যা তিনি যুদ্ধের ডামাডোলে সংরক্ষণ করতে পারেননি। পরের ঘটনা ছিল অবশ্যম্ভাবী। পাকিস্তানের রিসিভারে মেসেজটি নিশ্চয়ই ধরা পড়েছিল। তারা বুঝেছিল পূর্ব পাকিস্তান থেকে মেসেজটি কে পাঠাতে পারে। পাকিস্তান সরকার ঠিকই জানত যে, এ ধরনের মেসেজ পাঠানোর ক্ষমতাসম্পন্ন ট্রান্সমিটার বানানোর মতো জ্ঞান ও ক্ষমতা একমাত্র প্রকৌশলী নুরুল হকেরই আছে। ২৯ মার্চ ১৯৭১ সকালে নুরুল হকের বাসা ঘেরাও করে একদল পাকিস্তানি সেনা। তারা ইঞ্জিনিয়ার নুরুল হককে ধরে নিয়ে যায় এবং সারা বাসা সার্চ করা হয়। পাকিস্তানি মিলিটারিরা সার্ভেন্ট রুম থেকে একটি ট্রান্সমিটারসদৃশ জিনিস উদ্ধার করে বাজেয়াপ্ত করে। যেসব সামরিক সদস্য তাকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যান তার মধ্যে এক বাঙালি ড্রাইভার পরে জানান যে, নুরুল হককে বাসা থেকে তৎকালীন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে (তেজগাঁও) নেওয়া হয়।  সেখান থেকে কোথায় নেওয়া হয়েছে বা কী করা হয়েছে সে সম্পর্কে আর কোনো তথ্য নেই। তারপর যা থেকে গেছে সেটি বঙ্গবন্ধুর একটি চিঠি। নুরুল হকের পরিবার তাদের চলার পথে এই অমূল্য সম্পদ স্বযত্নে আগলে রেখেছেন।

লেখক : শহীদ এ কে এম নুরুল হকের কন্যা।

সর্বশেষ খবর