শনিবার, ১ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

আমার ডানা মেলা ভাবনাগুলো

লে. জে. মাহবুবুর রহমান (অব.)

আমার ডানা মেলা ভাবনাগুলো

বাংলাদেশ নামক আমাদের আজকের এই ভূখণ্ডের রয়েছে মহান সভ্যতা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি। চীনারা দাবি করে তাদের আছে পাঁচ হাজার বছরের লিখিত ইতিহাস। পাশাপাশি বাংলাদেশের ইতিহাসও সমান্তরালভাবে তাদের মতে অতি প্রাচীন। দুই পাশাপাশি সভ্যতার যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল তিন হাজার বছরেরও আগে দক্ষিণাঞ্চলের রেশম পথ ধরে। বাংলায় রেনেসাঁ এসেছে বার বার। অনেক মহাজ্ঞানী, মহাজন, সাধক, শিল্পী এখানে জন্মগ্রহণ করেন যাদের কীর্তি ও অবদান ভারতবর্ষের সীমানা ছাড়িয়ে সমৃদ্ধ করেছে বিশ্বসভ্যতাকে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ বাংলার সম্পদ, বাংলার কবি। তার কবিতা বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। বর্তমান যুগের দুই মহান নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও অমর্ত্য সেন বাংলাদেশে জন্মেছেন। সুপ্রাচীন বাংলার সভ্যতার আলো বিকিরণ ঘটিয়েছে সর্বত্র। চীন, নেপাল, ব্রহ্মদেশ, শ্যাম, সিংহলে তা ছড়িয়েছে। ছড়িয়েছে সুমাত্রা, জাভাসহ সুদূর ইন্দোনেশিয়ায়। এ জনপদেই মহামতি গৌতম বুদ্ধ আবির্ভূত হয়েছেন। পায়ে হেঁটে প্রচার করেছেন ভারতজুড়ে অহিংসার অমিয় বাণী। তিনি বলেছেন, অহিংসা পরম ধর্ম, সর্বজীবে দয়া কর।

এ বাংলাতেই পাল রাজারা চার শতাধিক বছর রাজ্য শাসন করেছেন। প্রথম পালরাজ গোপাল গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে সবার সম্মতিতে নৃপতি নির্বাচিত হন। পাশ্চাত্যে গ্রিস ছাড়া বিশ্ব ইতিহাসে এমন কখনো হয়নি। পাল রাজারা বাংলাদেশের ঐতিহ্য, কৃষ্টি, মানবতাবাদ, অহিংসা গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছেন। শান্তি, সম্প্রীতি, ভালোবাসা, ক্ষমা ও মানবতার কথা বলেছেন। সে ছিল বিশ্বসভ্যতায় বাংলাদেশের তথা ভারতবর্ষের এক সুবর্ণ যুগ। এই ভূখণ্ডে একসময় পবিত্র ইসলাম ধর্ম বিস্তার লাভ করে। ইসলাম প্রচারকরা অস্ত্রের বলে নয়, শান্তি ও মানবতার কথা প্রচার করে দলে দলে মানুষকে আকৃষ্ট করেছেন। তাদের কাছ থেকে মানুষ জেনেছে সহিষ্ণুতা, ক্ষমা, ন্যায় ও সাম্যের কথা। সুফি-সাধক, পীর-আউলিয়ারা পবিত্র এই ধর্মের ক্ষমার মর্মবাণী তুলে ধরেছেন। সিলেটের হযরত শাহজালাল ও আজমিরের খাজা মইনুদ্দিন চিশতি অহিংসা ও ক্ষমার কথাই বলেছেন। আমাদের এই ভূমিতেই সত্যের সন্ধান করেছেন শ্রীচৈতন্য দেব। তিনি ভালোবাসা ও ক্ষমার বাণী প্রচার করেছেন। আমরা এখানে শুনেছি রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ও স্বামী বিবেকানন্দের কথা। স্বামীজি মানবতার ব্রত নিয়ে গোটা ভারতবর্ষ পরিভ্রমণ করেছেন। সত্য ও সুন্দরের জয়গান করেছেন। তিনি বলেছেন, একমাত্র মানবতাই আমার ধর্ম। বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার সন্তান ফকির লালন শাহ মানবতার সাধনা করেছেন। তার গানে ও গীতিতে যে দর্শন রয়েছে তার মূলকথা মানবতার উপরে কিছু নেই।

আমি বেদনাহত চিত্তে এ কথাও বলতে চাই, যুগ যুগ ধরে শান্তি ও সম্প্রীতির লীলাভূমি বলে পরিচিত ছিল যে ভূখণ্ড আমাদের, তাতে বিঘ্নও ঘটেছে। ঘটেছে হানাহানি ও রক্তপাত। তবে তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। বাংলার মানুষই তা হতে দেয়নি। তারা সহিংসতা-হানাহানি প্রতিহত করে অহিংস বৈশিষ্ট্য ধরে রেখেছে। পাকিস্তানের প্রতিকূল সময়ও অশুভশক্তি বিস্তার লাভ করতে  পারেনি। একপর্যায়ে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে জাতিসত্তার বিকাশ ঘটে, স্বাধীনতার জাগরণ সৃষ্টি হয়। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে অনেক ত্যাগের বিনিময়ে অর্জন করে স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতাই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আদিবাসী সবাই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। চরম আত্মত্যাগ করে। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল সব শৃঙ্খলমুক্ত হয়ে সম্পূর্ণ মুক্তি। দেশবাসী চেয়েছে সত্যিকারের গণতন্ত্র। চেয়েছে সুখী-সমৃদ্ধ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ আজও গঠন করা যায়নি। আরও দুঃখের কথা, পাকিস্তান আমলেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এতটা বিনষ্ট হয়নি। আমরা একসঙ্গে যুদ্ধ করেছি, রক্তাক্ত প্রান্তরে একসঙ্গে শত্রুর মোকাবিলা করেছি, ধর্মের কারণে আমাদের বিশ্বাস-আস্থায় ছেদ পড়েনি। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে গণতন্ত্র ব্যাহত হয়েছে। একদলীয় শাসন চালু হয়েছে। সামরিক শাসন এসেছে। স্বৈরশাসনের বিস্তার ঘটেছে। আবার এ কথাও ঠিক, বহুদলীয় গণতন্ত্রও চলেছে বেশ সময় ধরে। কিন্তু সত্যিকারের গণতন্ত্র, শোষণ-বঞ্চনাহীন এক সমাজ, সবার সমান বিকাশের সমান সুযোগ এখনো অর্জন করা যায়নি।

অসাম্প্রদায়িকতা, অহিংসা আমাদের আবহমানকালের ঐতিহ্য। এ চেতনা আবিষ্কার করি কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখায় ও কবিতায়। তিনি বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আইকন। তিনি বলেছেন, ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? কাণ্ডারি, বল মরিছে মানুষ। সন্তান মোর মার।’ নজরুল আমাদের জাতীয় কবি। নজরুলের পুরো সাহিত্যকর্মে মানবতা ও সাম্য, অসাম্প্রদায়িকতা ও মুক্তির প্রতিফলন। আর এটাই তো ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। আরেক মহান বাঙালি অগ্নিপুরুষ নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু। মুক্তিযুদ্ধে তিনি ছিলেন আমাদের প্রেরণা। ভারত স্বাধীন করার ব্রত নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে রক্ত দাও আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব।’ সশস্ত্র আজাদ হিন্দ ফৌজ তিনি গঠন করেছেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করেছেন। তার আজাদ হিন্দ বাহিনী বার্মা থেকে অভিযান চালিয়ে ভারতবর্ষে প্রবেশ করে ইম্ফল কহিমাসহ বিস্তৃত অঞ্চল মুক্ত করে। নেতাজির বিশ্বস্ত সহযোদ্ধা ছিলেন ক্যাপ্টেন শাহনেওয়াজ।

বাংলার এই জনপদ আবহমানকাল ধরে ইতিহাসে এক সামাজিক সম্প্রীতির সুখী-সমৃদ্ধ দেশ। পদ্মা, যমুনা, তিস্তা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র, কুশিয়ারা, সুরমাবিধৌত বঙ্গোপসাগরের বিশাল উপকূলজুড়ে বাংলার এই বদ্বীপ ঈশ্বর নির্মিত এক অনবদ্য পুণ্যভূমি। হাজার বছর ধরে বাংলার সংস্কৃতি শান্তির, সম্প্রীতির। বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ, হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, বিভিন্ন নৃগোষ্ঠী, আদিবাসী সবার মাতৃভূমি। সবার দেশ বাংলাদেশ। হাজার বছর ধরে বাংলাদেশ বিশ্বে পরিচিত হয়েছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অপূর্ব লীলাভূমি বলে। ধর্মীয় চেতনা এখানে মানুষকে উদার করেছে। মহানুভব করেছে। দয়াবান ও ক্ষমাশীল করেছে। করেছে পরমতসহিষ্ণু। সব ধর্মই প্রেম-প্রীতি আর ভালোবাসার কথা বলেছে। মানবতার দীক্ষা দিয়েছে। শুনিয়েছেন এই বাংলার কবি চণ্ডীদাস, ‘শোন হে মানুষ ভাই সবাই উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’ শিক্ষা দিয়েছে নরের মধ্যে নারায়ণ, নররূপে নারায়ণ। ইসলাম বলেছে নরহত্যা মহাপাপ, শিখিয়েছে প্রতিশোধ নয়, ক্ষমা কর। ক্ষমাই শ্রেষ্ঠ। বলেছে প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে আহার করা হারাম। গৌতম বুদ্ধ বলেছেন, অহিংসা পরম ধর্ম, সর্বজীবে দয়া কর। বাংলাদেশের হাজার বছরের সমাজ ও সংস্কৃতি এই দর্শন, এই বিশ্বাস এবং এই ঐতিহ্যের ভিত্তির ওপরই গড়ে ওঠা। এটাই জাতিধর্মবর্ণনির্বিশেষে সবার মন ও মনন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যুগ যুগ ধরে বাংলার জাতীয় বৈশিষ্ট্য। বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ বাংলার রূপ দেখেছিলেন। কবিতা লিখেছিলেন, ‘বাংলার রূপ আমি দেখিয়াছি তাই পৃথিবীর রূপ দেখিতে চাহি না আর।’ রূপসী বাংলা আজ বিবর্ণ, ঊষর, ধূসর। সবুজে সবুজ, ছায়া ঢাকা, পাখি ডাকা, শান্তির নীড় এই বাংলা আজ নষ্ট নীড়। রবীন্দ্রনাথের অনেক ভালোবাসার সোনার বাংলা এখন এক হতশ্রী বাংলা।

বাংলাদেশ আজ অশান্ত। শান্তি বিঘ্নিত। চারদিকে অস্থিরতা, উত্তেজনা, ধর্মান্ধতা, জঙ্গি ও উগ্রবাদের উন্মাদনা। সামাজিক সংঘাত, ধর্ম ও জাতি-গোষ্ঠীগত ঘৃণা, সহিংসতা, হানাহানি। সন্ত্রাসবাদের বলগাহীন বিস্তার। শান্তি-সম্প্রীতি সুদূরপরাহত। স্থিতিশীলতা বিপজ্জনকভাবে বাধাগ্রস্ত। নীতি ও মূল্যবোধের প্রচণ্ড শূন্যতা। হিংসায় উন্মত্ত বাংলাদেশ। আমরা উদ্বিগ্নতার সঙ্গে লক্ষ্য করছি এক কদর্য ও সাম্প্রদায়িকতার নগ্ন উত্থান এখানে ঘটে চলেছে। প্রত্যক্ষ করছি, আবহমানকালের বাংলার ঐতিহ্যে বিশাল ফাটল। প্রতিনিয়ত মিডিয়ায় দেখছি ভিন্নমতের, ভিন্ন আদর্শের, ভিন্নপথের অনুসারীরা হত্যা হচ্ছে।

হিন্দু পুরোহিত, বৌদ্ধ ভিক্ষু, খ্রিস্টান ধর্মযাজক, শিয়া ইমাম, সুফি-সাধক, বাউল, গায়ক নির্যাতিত হচ্ছে। নৃশংসভাবে মৃত্যুর শিকার হচ্ছে। মন্দির, গির্জা, উপাসনালয় আগুনে ভস্মীভূত হচ্ছে। বোমা বিস্ফোরণ হচ্ছে, রক্তপাত ঘটছে, জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। দেব-দেবীর প্রতিমা, যিশুর মূর্তি, বৌদ্ধের প্রতিকৃতি ক্ষতবিক্ষত, চূর্ণ-বিচূর্ণ করা হচ্ছে। আরও দেখি অবুঝ নিষ্পাপ স্বর্গশিশুরা হত্যা হচ্ছে, নির্যাতিত হচ্ছে প্রতিদিন। পৈশাচিক উন্মাদনায় ধর্ষিত হচ্ছে নারীরা, শিশু কন্যারা, বৃদ্ধারাও। আর ধর্ষণ শেষে হত্যা হচ্ছে নিশ্চিত ও অবধারিতভাবে। এর কোনো ব্যত্যয় নেই। হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা দিনে দিনে বেড়ে চলেছে, স্ফীত হচ্ছে। সংক্রামক রোগের মতো এর ভয়াবহতা, এর ব্যাপকতা গোটা জাতিকে শঙ্কিত করে তুলেছে। হত্যাকাণ্ড এক মহাহত্যাযজ্ঞে পরিণত হয়েছে। মানুষের হিংসা, বিদ্বেষ, অর্থগৃধ্নুতা, সীমাহীন লালসা, পারস্পরিক ঘৃণা, পশুত্বের সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে গেছে। পশুরাই আজ অনেক মানবিক। মানুষ পাশবিক। হিংসার বিষবাষ্পে সমাজ বিষাক্ত। উদগ্র লালসায় মানুষ উন্মত্ত। চারদিকে শুধু হানাহানি, রক্ত আর রক্তপাত আর হত্যা। ঘৃণা ঘৃণার জন্ম দেয়, হিংসা হিংসার। ভায়োলেন্স ভায়োলেন্সের। সন্ত্রাস সন্ত্রাসের।

ব্যক্তি নিরাপত্তা, পারিবারিক নিরাপত্তা, গোষ্ঠী নিরাপত্তা, সামাজিক নিরাপত্তা, জাতীয় নিরাপত্তার ইস্যুগুলো আজ অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে সামনে চলে এসেছে। জঙ্গিরা দেশজুড়ে তাণ্ডবনৃত্য করে চলেছে। একটা ভীতি, শঙ্কা সবার মধ্যে আজ কাজ করছে আর তা সংক্রামক রোগের মতো চারদিকে সংক্রমিত হচ্ছে। প্রতিদিনের অব্যাহত, অপ্রতিরোধ্য, অবিরাম গুপ্তহত্যা, সন্ত্রাসী তৎপরতা, জঙ্গির বীভৎসতা আর নারকীয়তা জাতির জন্য এক মহা অশনিসংকেত। আমরা উটপাখির মতো আসন্ন সাইমুম ঝড়কে না দেখার ভান করে চোখ বন্ধ করে মাথা বালুর মধ্যে ঢুকিয়ে রাখলে ঝড়ের অস্তিত্ব মিথ্যা হয়ে যাবে না। ঝড়ও বন্ধ হবে না। জাতির কাছে আজ এ এক মহাচ্যালেঞ্জ। এর মোকাবিলায় প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য, ঐকতান, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা, এক ও অভিন্ন হয়ে শত্রুকে চিহ্নিত করা, তার বিরুদ্ধে একসঙ্গে প্রাণপণ সংগ্রামে নামা। আর সরকারকেই এর উদ্যোগ নিতে হবে। সব ভেদাভেদ ভুলে সব রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সুশীল সমাজ, পেশাজীবী মানুষ, বিজনেস কমিউনিটি, ছাত্র-শিক্ষক সবাইকে একত্রিত হতে হবে। জাতীয় সংলাপে বসতে হবে। দেশটি শুধু সরকারের নয়। দেশটি সবার, প্রতিটি নাগরিকের এটাও সরকারের জোর করে বোঝাতে হবে। আমাদের সবার একটাই দেশ— বাংলাদেশ। সবাই এখানে স্টেকহোল্ডার। সবাই মিলে মুক্তিযুদ্ধ করে একসঙ্গে দেশটাকে স্বাধীন করেছি। অনেক রক্তে অর্জিত আমাদের এই স্বাধীনতা এই দেশ। আজ দেশকে বিপদমুক্ত করতে স্বাধীনতাকে ধরে রাখতে বাংলাদেশের হৃতঐতিহ্য অহিংস অসাম্প্রদায়িক ও গৌরবোজ্জ্বল অতীত পুনরুদ্ধার করতে একত্রিত হয়ে সংগ্রাম করতে হবে। সংগ্রাম করতে হবে সহিংসতার বিরুদ্ধে, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে, দুর্নীতি ও অসাম্যের বিরুদ্ধে, সব অপশক্তির বিরুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় (গণতন্ত্র, অহিংসা, অসাম্প্রদায়িকতা ও সুশাসন) শানিত হতে হবে। জয় হোক সত্যের, জয় হোক সুন্দরের। মহান ইংরেজ কবি জন কিটস বলেছিলেন, সত্যই সুন্দর, সুন্দরই সত্য। Truth is beauty, beauty is truth.

আমি আমার কিছু অনুভূতি, উপলব্ধি, চিন্তা, চেতনার কথা স্বাধীনতার এই অগ্নিঝরা মাসে তুলে ধরতে চেষ্টা করলাম। সাম্প্রতিককালে এই বিষয়গুলো নিয়ে ভাবনাগুলো আমাকে খুব ভাবায়, উদ্বিগ্ন করে। ভীষণ আশাবাদী মানুষ আমি। নিরাশায় কখনো ভুগি না। আমি পজিটিভ থিংকিংয়ে বিশ্বাস করি। আমি স্বপ্ন দেখি। অনেক বড় স্বপ্ন। স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। বুঝি, এখন সময়টা বাংলাদেশের দুঃসময়। হয়তো তা একটু দীর্ঘ হচ্ছে। কিন্তু তা কখনো চিরস্থায়ী নয়। হতে পারে না। এর অবসান অবশ্যম্ভাবী। (আমার) মহাসাগর পাড়ি দেওয়া মহাবিহঙ্গের— 

ক্লান্তি আসিছে অঙ্গে নামিয়া

মহা আশঙ্কা জপিছে মৌন মন্তরে

দিক-দিগন্ত অবগুণ্ঠনে ঢাকা...

তবু বিহঙ্গ, বিহঙ্গ মোর এখনি, অন্ধ, বন্ধ কর না পাখা।

না। আমি পাখা বন্ধ করব না। সাইবেরিয়ার কঠিন তুষারঝড় পেছনে ফেলে ঊর্ধ্বাকাশে ডানা মেলে আমি উড়ে চলেছি। মহাসাগর পার হয়ে দক্ষিণ গোলার্ধে বাংলার উষ্ণ গন্তব্যে আমি পৌঁছবই পৌঁছব, নিশ্চয়ই পৌঁছব। আমি কাগজ-কলম নিয়ে কিছু লেখার চেষ্টা করি। আমার ভাবনাগুলোই আমাকে লিখতে তাগিদ দেয়। ঠেলে টেবিলে বসায়। বলতে দ্বিধা নেই আমি কোনো লেখক বা সাহিত্যিক নই। সেনাবাহিনীতে দীর্ঘ সৈনিকের গদ্যময় জীবন আমার। সাহিত্যচর্চার বড় একটা সুযোগ আসেনি। তবে সাহিত্য আমার ভালো লাগে, সাহিত্য আমাকে কাছে টানে। সাহিত্য নান্দনিক। সে মানবাত্মার ভাষা। সে অমরাবতীর সন্ধান পায়। মানুষের শ্রেষ্ঠত্বকে বহু বৈশিষ্ট্যে নির্মাণ করে। সাহিত্যশূন্যতায় মানুষ প্রাণিজগতে হাজার নিযুত প্রাণীর মাঝে নিছক একটি প্রাণীমাত্র। সাহিত্যই মানুষকে তার জীবনবোধ দিয়েছে। জীবনের উপলব্ধি শিখিয়েছে। সভ্যতা, ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছে। বিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়েছে। কবিতার দেশ, গানের দেশ, সাহিত্যের দেশ, সংস্কৃতির দেশ বাংলাদেশ। জয় হোক স্বাধীনতার, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের।

            লেখক : সাবেক সেনাপ্রধান।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর