শনিবার, ১ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস বিতর্ক

অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ

ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস বিতর্ক

ডাক্তারদের বিশেষ করে সরকারি চাকরিজীবী ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস নিয়ে সমালোচনার ইতিহাস খুব নতুন নয়। প্রায়ই পত্রপত্রিকায় বিষয়টি নিয়ে লেখালেখি হয়। অনেকে সমালোচনা করে বলছেন, ‘সরকারি ডাক্তার আবার প্রাইভেট প্র্যাকটিস কেন করবেন? বেতন তো পাচ্ছেনই তারা! সরকারি চাকরিরত ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস করা উচিত নয়। সরকারি ডাক্তাররা কাজে ফাঁকি দিয়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিস আর ক্লিনিক ব্যবসা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন।’ এ ধরনের সমালোচনা কখনো কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় ক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে, আবার কখনো বা আবেগপ্রসূত অতিকথন। সুধীজনদের কেউ কেউ এখানে মানবসেবার কোনো উপলক্ষ খুঁজে পান না, বরং ডাক্তারদের বাণিজ্যের বিষয়টিকেই সামনে নিয়ে আসেন। কথায় কথায় ডাক্তারদের কপালে কাজের পুরস্কারের চেয়ে তিরস্কারটাই জোটে বেশি।

সত্যিকার অর্থেই সরকারি চাকরিজীবী ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস করা কতটুকু উচিত বা একেবারেই উচিত নয়, পাশাপাশি এর ইতিবাচক আর নেতিবাচক দিকগুলোই বা কী কী, তা বিতর্কিত বিষয়। এ নিয়ে বাংলাদেশে কোনো জরিপ কিংবা গবেষণা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। যারা সমালোচনা করেন, তারা তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও যুক্তিতর্কের মাধ্যমেই তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন। আবার যারা বিপরীত মেরুর, তারাও যে খুব যৌক্তিকভাবে বিষয়টি খোলাসা করেছেন তাও নয়। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই বিষয়টি নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে বিতর্কের মঞ্চে জায়গা পেয়েছে বেশি।

মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশে জনসংখ্যা বেশি, তাই স্বভাবতই রোগীর সংখ্যাও বেশি, সে তুলনায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা অপ্রতুল। ১৬ কোটি মানুষের এই দেশে এখনো স্বাস্থ্যব্যবস্থা পুরোপুরি পিঠ সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি। রাজধানীর বড় বড় করপোরেট হাসপাতাল আর বড় শহরে স্বাস্থ্যসেবার কিছুটা সহজলভ্যতা থাকলেও, জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে তা এখনো যে অনেকটাই নড়বড়ে অবস্থানে, এ কথা জোর গলায় অস্বীকার করার মতো নয়। সীমিত সম্পদ নিয়ে ১৬ কোটি মানুষের সবার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সরকারের পক্ষে আসলেই কঠিন। অসংখ্য রোগীর চিকিৎসাসেবার চাহিদা মেটাতে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো মোটেও পর্যাপ্ত নয়। তার ওপর সামর্থ্যের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি সেবা দিতে গিয়ে কাঙ্ক্ষিত মান রক্ষাও সম্ভব হয় না। ফলে রোগীদের ক্ষোভ যেমন বাড়ে, তেমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও ঘটে। স্বভাবতই সরকারি ডাক্তাররা অফিস টাইমের পরে, তার নিজস্ব সময় অন্য কোনো কাজে মনোনিবেশ না করে প্রাইভেট প্র্যাকটিসে মনোনিবেশ করেন। যেসব রোগীর আর্থিক সঙ্গতি আছে এবং অনেকেই বিশেষ করে যারা ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী বা অফিস টাইমে অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকেন, তারা নিতান্ত বাধ্য হয়েই চিকিৎসাসেবা নিতে ছোটেন ডাক্তারের প্রাইভেট চেম্বারে বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয়। বিশ্বের সব দেশেই এ ব্যবস্থা চালু আছে। সরকারি চাকরি শেষ করে যখন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের বিশ্রাম নেওয়ার কথা, তখন তারা নিজের আরাম-আয়েশ বিসর্জন দিয়ে ছুটে যান প্রাইভেট চেম্বারে। ক্লান্তিকে পায়ে ঠেলে সেবা দিয়ে যান মুখ বুজে। বিপরীতে কিছু ফি তারা পান এটা সত্য। কিন্তু ডাক্তারের টাকা রোজগারটাই অনেকে বড় করে দেখছেন, তাদের সেবা বা ত্যাগটা কি একেবারেই গৌণ হয়ে গেল? অনেকের অভিযোগ, সরকারি হাসপাতালে সময় কম দিয়ে বা কাজকর্মে ফাঁকি দিয়ে ডাক্তাররা প্রাইভেট প্র্যাকটিস নিয়েই ব্যস্ত থাকেন, আর দুই হাতে শুধু পয়সা কামানোকেই তারা গুরুত্ব দেন বেশি। কথাটা একেবারে অযৌক্তিক নয়, আবার ঢালাওভাবে সব ডাক্তারের ক্ষেত্রে এ অভিযোগ সত্যও নয়। অধিকাংশ ডাক্তারই এমন নন। কোনো ডাক্তার যদি তার দায়িত্ব পালনের সময়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন, সরকারিভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে অবহেলা প্রদর্শন করেন, এটা অবশ্যই নিন্দনীয় এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের উচিত হবে দোষী ব্যক্তির উপযুক্ত শাস্তির বিধান করা। এমনও শোনা যায়, দায়িত্ব পালনকালে কোনো কোনো ডাক্তার সরকারি হাসপাতালে বসেই ফি নিয়ে থাকেন। এও গুরুতর অপরাধ এবং এমন ঘটনা রোধে কর্তৃপক্ষের কঠোর হওয়া উচিত। কতিপয় ব্যক্তির অর্থলোভ আর অসাধুতা যাতে সামগ্রিকভাবে চিকিৎসা পেশার মতো মহান কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে কালিমালিপ্ত না করতে পারে, এ ব্যাপারে ডাক্তারদের নিজেদেরও সোচ্চার হওয়া উচিত। যারা দিনের পর দিন নিজের কর্মস্থলে অনুপস্থিত থেকে প্রাইভেট প্র্যাকটিসকে ধ্যান-জ্ঞান করে নিয়েছেন, তাদের আমি যৌক্তিকভাবে নিজের অবস্থান চিন্তা করে দেখতে বলব। তাদের বিবেকের সঙ্গে বোঝাপড়া হওয়া দরকার। কেউ যদি সরকারি চাকরিতে থেকে নিজের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করেন, তবে বেতন নেওয়াটা তাদের জন্য হালাল হবে তো? প্রাইভেট প্র্যাকটিস করার কথা এলেই অর্থ আয়ের কথা আসে। এ কথা কি ঠিক নয় যে, ডাক্তাররা শুধু টাকা-পয়সাই কামাচ্ছেন। তারা সার্ভিসের বিনিময়ে ফি নিচ্ছেন, কিন্তু রোগীর সেবা কি একেবারেই হচ্ছে না? যিনি বলেন ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস করা উচিত নয়, তিনি কি একবারও ভেবে দেখেছেন, সরকারি অফিস টাইমের পরে নিজে বা তার ছেলেমেয়ে, বাবা-মা, ভাইবোন যদি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন তখন তিনি কোথায় যাবেন বা কী করবেন? আর সেই অবস্থায় যদি একজন বিশেষজ্ঞ সরকারি ডাক্তারকে রোগী দেখতে অনুরোধ করা হয়, তখন ওই ডাক্তারের ভূমিকাই বা কী হবে? কারণ প্রাইভেট প্র্যাকটিস নিষিদ্ধ হলে, ডাক্তার তো আইনগতভাবে তখন ওই রোগী দেখতে পারবেন না এবং অফিস টাইমের পরে ডাক্তার তার সেবা দিতে বাধ্য নন। সাধারণ বা গুরুতর কোনো রোগীর অনুরোধে তাকে চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে আইন লঙ্ঘন বা বেআইনি কাজ হবে কিনা? আইনগতভাবে কোনো রোগী অফিস টাইমের পরে ডাক্তারের চিকিৎসা নিতে অনুরোধ করতে পারবেন কি? এমনকি প্রচুর টাকার বিনিময়েও? যারা প্রভাবশালী বা নীতিনির্ধারক, অসুস্থ হলে তাদের কি তখন নৈতিকভাবে উচিত হবে অসময়ে বা ডিউটি আওয়ারের পরে একজন ডাক্তারকে রোগী দেখাতে অনুরোধ করা? আইন সবার জন্যই সমান। যারা আইন করছেন তারা যদি বিপদে পড়ে ডাক্তারদের শরণাপন্ন হন, তখন ডাক্তারের করণীয়ই বা কী হবে? আইনের ফাঁকতালে পড়ে কোনো রোগী যদি এ অবস্থায় যথাযথ চিকিৎসাসেবা না পান, তাহলে তা কি মানবাধিকার লঙ্ঘন হবে না? আইনপ্রণেতারা কি এর দায় এড়াতে পারবেন? ডাক্তারের বিরুদ্ধে আবার নতুন করে কোনো অভিযোগ আসবে কিনা? পরবর্তীতে ডাক্তারের কাঁধেই সব দায় চাপিয়ে দোষারোপের পাহাড় গড়া হবে না তো? একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার যদি নিপীড়িত অসুস্থ মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর কাজে ব্রত হন যে কোনো সময়ে, সেটা কি অন্যায় হতে পারে?

যারা সচ্ছল তারা নামিদামি প্রাইভেট ক্লিনিক বা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যান। এখন কথা হলো, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় এ সেবা কে দেবে? অপ্রিয় সত্য হলো, হাতে গোনা কিছু বড় হাসপাতাল বাদে অধিকাংশ ক্লিনিক বা হাসপাতালেও কিন্তু সরকারি চাকরিরত অনেক বিশেষজ্ঞই অফিস টাইমের পরে সেবা দিয়ে থাকেন, কারণ বিশেষজ্ঞের সংখ্যা সেখানেও সীমিত। টাকা দিয়ে যন্ত্র বানানো যায়, ডাক্তার তো বানানো যায় না! একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার তৈরি হতে যুগ পেরিয়ে যায়। তাহলে এই প্রতিষ্ঠানগুলোয় সেবা দেবে কারা? প্রাইভেট প্র্যাকটিস বন্ধের ফলে ওইসব ক্লিনিক বা হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা পেতেও যথেষ্ট অসুবিধা হওয়ার সম্ভাবনাই কিন্তু বেশি। ফলে রোগীদের ভোগান্তিই বাড়বে বইকি। যদি আইন করে প্রাইভেট প্র্যাকটিস বন্ধ করা হয় তবে ডাক্তাররা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অফিসে থাকবেন, রোগীর চিকিৎসা দেবেন, কোনো ক্লিনিকে যেতে পারবেন না, বিকালে চেম্বারে রোগী দেখতে পারবেন না। এতে ডাক্তারদের হয়তো কিছু আর্থিক ক্ষতি হবে, কিন্তু রোগীরা তো গুরুত্বপূর্ণ সার্ভিস থেকে বঞ্চিত হবেন। ডাক্তারদের ক্ষতির চেয়ে রোগীদের ভোগান্তিটাই বেশি হবে। বিশেষ করে সাধারণ রোগব্যাধিতে হাসপাতালে না গিয়ে, ডাক্তারের প্রাইভেট চেম্বারে গিয়ে দেখাতে অনেকে স্বচ্ছন্দবোধ করেন, তাদের ভোগান্তি আরও বাড়বে।

দেখা যায় কিছু জটিল রোগীও বহু দূর থেকে সরাসরি চেম্বারে আসেন। আজকেই ডাক্তার দেখাতে না পারলে তাদের থাকার জায়গা নিয়ে ভোগান্তি পোহাতে হবে। ডাক্তারকে দেখিয়ে তারা ওইদিনই হয়তো নিজ বাড়িতে ফিরে যাবেন। রোগীর লোকজনের আকুতিভরা অনুরোধ ‘স্যার বাঁচান, যত টাকা লাগে কোনো অসুবিধা নেই আমার ছেলেটারে বাঁচান।’ এখন ডাক্তারের কী করা উচিত? তাকে দেখে দেওয়া নাকি ক্লান্ত নিজকে বিশ্রামের সুযোগ দেওয়া? মানবিক কারণেই রোগীর চিকিৎসা দেওয়ার পরে এ কথা কি বলা উচিত হবে, এই বিপন্ন রোগীদের টাকার লোভই আমাকে প্রচণ্ড ক্লান্তির মধ্যেও চিকিৎসা দিতে বাধ্য করেছে? এতটা অমানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে কেন দেখা হয় ডাক্তারদের? প্রাইভেট প্র্যাকটিস বন্ধ হলে এই অবস্থায় দূরদূরান্ত থেকে আগত কোনো রোগী যদি চিকিৎসাসেবা না পান, তাহলে আবারও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে কোনো অভিযোগ আসবে কিনা বা এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠবে কিনা? অনেকে মনে করেন ডাক্তাররা শুধু টাকাই রোজগার করেন, ডাক্তারদের অর্থোপার্জনের সুযোগকে কটাক্ষ করতেও ছাড়েন না। কেউ কেউ মনে করেন, ডাক্তাররা টাকা উপার্জনকেই ধ্যান-জ্ঞান করে নিয়েছেন, সেবার কথা সব বোগাস। আসলেই কি তাই? ডাক্তাররা টাকা নিচ্ছেন এটা সত্যি, কিন্তু সার্ভিস দেওয়ার বিনিময়েই তো নিচ্ছেন। পৃথিবীর কোথাও কি এমন কোনো পেশা রয়েছে, যেখানে কেউ সার্ভিস দেবেন, আন্তরিকভাবে শ্রম দেবেন অথচ পারিশ্রমিক নিতে পারবেন না? সেবার বিনিময়ে ডাক্তারদের ফিই বা কত? যেখানে একজনের জীবন বাঁচাতে সার্ভিস দিয়ে তার বিনিময়ে ফি নেওয়া হচ্ছে, এটা কি পরিমাণে খুব বেশি? এই বিষয়গুলোও বিবেচনায় আনতে হবে।

ডাক্তারি তো একটা পেশা, কাজেই তারা প্র্যাকটিস করতেই পারেন, এখানে তো আইনগত কোনো বাধ্যবাধকতা থাকার কথা নয়। অফিস টাইমের পরে প্রাইভেট প্র্যাকটিসে ডাক্তাররা যে সময় দেন, তা তার নিজস্ব সময়। যে সময়ে বিকালে বা রাতে অনেকেই ক্লাবে, সিনেমায়, পার্কে বা অন্য কোনোভাবে সময়টা উপভোগ করেন, সেই সময়টাতে ডাক্তার প্র্যাকটিস করে রোগীর সেবা দিচ্ছেন। নিজের আরাম-আয়েশ বা ভোগ-বিলাস বিসর্জন দিয়ে অফিস টাইমের পরে রোগীর জন্য সময় দেওয়াটা কি খুব অন্যায়? অনেক চাকরিজীবী তার চাকরির সময়ের বাইরেও অন্য কাজকর্ম বা ব্যবসা-বাণিজ্য যদি করতে পারেন, তবে ডাক্তাররা সরকারি চাকরি করে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতে পারবেন না কেন? ডাক্তারদের বিরুদ্ধে আরও একটা অভিযোগ ঢাকা বা অন্যান্য বড় শহরের বাইরে গিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছুটির দিনে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন। এখানে ডাক্তারদের কী অপরাধ, তা বোধগম্য নয়। একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার যদি ঢাকা থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে একজন জটিল রোগীর অপারেশন করেন বা একজন রোগীকে দেখে চিকিৎসাসেবা দেন, এতে কি ওই রোগীটার লাভ হলো না? কোনো জটিল রোগীকে যদি প্রত্যন্ত অঞ্চল বা গ্রাম থেকে ঢাকা বা অন্য শহরে প্রাইভেট চেম্বারে এসেও চিকিৎসা নিতে হয়, তাতে তার ভোগান্তিও কম হয় না। রোগীর সঙ্গে আরও কয়েকজন আত্মীয়স্বজন বা সাহায্যকারী প্রয়োজন পড়ে। টাকা-পয়সা থেকে শুরু করে যাতায়াত, থাকা-খাওয়া— সব মিলিয়ে তার অবস্থা কী দাঁড়াবে? বড় শহরে এসে সঙ্গে সঙ্গেই কি চিকিৎসা পাওয়া সম্ভব? জরুরি প্রয়োজনে সব সময় সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা পাওয়া বা ভর্তি হওয়া সম্ভব হবে কি? সেই অবস্থায় হোটেলে থেকে তাকে আরও বাড়তি খরচের ঝামেলা পোহাতে হবে না? তার পরিবারের অবস্থাটাই বা কী হবে? তাই একজন ডাক্তার যদি প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘরের দুয়ারে গিয়ে একজন রোগীর অপারেশন বা চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসেন, তাতে রোগীর লাভই তো বেশি। এতে রোগীর ভোগান্তি এবং টাকা-পয়সার সাশ্রয় সবই তো হয়। ছুটির দিনে পরিবার-পরিজনকে সময় না দিয়ে, আরাম-আয়েশ বিসর্জন দিয়ে, বিশেষজ্ঞ ডাক্তার প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে রোগীর যতটুকু সম্ভব সেবা দেওয়াটা কি খুব খারাপ বা অন্যায় হয়ে যায়? এর কি কোনো মূল্যই নেই?

অনেক ডাক্তারের বিরুদ্ধে ওষুধ কোম্পানির বা ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কাছ থেকে পারসেন্টেজ নেওয়ার অভিযোগ আছে। কথাটা বাজারে চালু আছে এবং আংশিকভাবে সত্য। তবে ঢালাও অভিযোগ দিয়ে সবাইকে এক কাতারে দাঁড় করানো অযৌক্তিক। পৃথিবীর বিভিন্ন পেশার সব মানুষ কি ভালো? সবার সততার মান কি এক রকম হয়? সব ডাক্তার সমান নয়। তাই কেউ যদি অসদুপায় অবলম্বন করেন, তা অবশ্যই অন্যায় এবং অনৈতিক। এ ক্ষেত্রে প্রশাসনকেই সোচ্চার হতে হবে। প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাও নিতে হবে।

বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের চেম্বারে ফি নিয়েও অনেকের অভিযোগের শেষ নেই। ডাক্তারের ফিই বা কত? একজন রোগীর জীবন বাঁচানোর বিনিময়ে যে ফি নেওয়া হয়, তা কি অন্যান্য পেশাজীবীর চেয়ে খুব বেশি? এ কথা সত্য যে, একেকজনের ফি একেক রকম, অনেকের ফি হাজার টাকারও বেশি। এ ব্যাপারে বিএমডিসি, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা যারা নীতিনির্ধারক, তারা ডাক্তারদের ফি নির্ধারণে একটা সুন্দর নীতিমালা তৈরি করতে পারেন। ডাক্তারদের ফি একটা নিয়মের মধ্যে নিয়ে এলে, এ অভিযোগগুলো আর শুনতে হবে না, রোগীরাও উপকৃত হবেন। আরেকটি কথা বলার অবকাশ রাখে না যে, ডাক্তারদের ফির চেয়ে ওষুধপথ্য, পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা অপারেশনের খরচ এমনকি প্রাইভেট হাসপাতাল বা ক্লিনিকের ভাড়া বা অন্যান্য খরচ আসলেই অনেক বেশি, গরিব ও অনেক মধ্যবিত্তের পক্ষে চিকিৎসার খরচ মেটানো অসম্ভব। সেদিকেও নীতিনির্ধারকদের নজর দেওয়া উচিত এবং চিকিৎসাসেবা যাতে জনগণের জন্য সহজলভ্য হয়, সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

উপসংহারে বলা যায়, আমাদের মতো গরিব দেশে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সংখ্যা সীমিত। তাই বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা যদি অফিস টাইমের পরে প্র্যাকটিস না করেন, সেবা না দেন, তবে রোগীরা যাবেন কোথায়? বিশেষ করে জটিল ও গরিব মধ্যবিত্ত রোগীরা পড়বেন বেশি সমস্যায়। বিত্তশালীরা হয়তো উন্নত দেশের বড় হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিতে পারবেন। আর অনেকেই বিদেশগামিতার দিকে ঝুঁকে পড়বেন বেশি। তাই আইন করে প্রাইভেট প্র্যাকটিস বন্ধ করে দিলে পুরো চিকিৎসাব্যবস্থা যেন হুমকির মুখে না পড়ে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। এর দায়দায়িত্ব তখন সংশ্লিষ্টদের ওপরই বর্তাবে।

লেখক : ডিন, মেডিসিন অনুষদ, অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর