শনিবার, ১ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা
বায়তুল মোকাররমের খুতবা

ইসলামের দৃষ্টিতে অহংকার

হাফেজ মাওলানা মিজানুর রহমান
ভারপ্রাপ্ত খতিব, বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ

ইসলামের দৃষ্টিতে অহংকার একটি কবিরা গুনা। অহংকার মানুষকে জাহান্নাম পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেয়। আল্লাহতাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই যারা আমাদের আয়াতসমূহে মিথ্যারোপ করে এবং তা থেকে অহংকারবশে মুখ ফিরিয়ে থাকে, তাদের জন্য আকাশের দুয়ারসমূহ উন্মুক্ত করা হবে না এবং তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যতক্ষণ না সুইয়ের ছিদ্রপথে উষ্ট্র প্রবেশ করে। এভাবেই আমরা পাপীদের বদলা দিয়ে থাকি।’ (সূরা আরাফ ৭/৪০)।

এ আয়াতে আল্লাহ কুফরিবশে বা অজ্ঞতাবশে বলেননি, বরং ‘অহংকারবশে’ বলেছেন। ফলে অহংকারী কাফিরের জান্নাতে প্রবেশ করা ওইরূপ অসম্ভব, যেরূপ সুইয়ের ছিদ্রপথে উটের প্রবেশ অসম্ভব। কাফির তওবা করে ইমান আনতে পারে, অজ্ঞ ব্যক্তি জানার পরে ফিরে আসতে পারে। কিন্তু অহংকারী ব্যক্তি স্বীয় অহংকারের ওপর অটল থাকে এবং একসময় সে ধ্বংস হয়ে যায়। অহংকার তাই মারাত্মক পাপ। যা সাধারণত হিংসার পরই আসে এবং যা অধিকাংশ পাপের উৎস। আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ মানুষকে অহংকারের পাপ ও তার ভয়াবহ পরিণতি বিষয়ে সাবধান করেছেন। ‘অহংকার’ মানবস্বভাবের একটি নিকৃষ্ট অংশ। বিশুদ্ধ-অশুদ্ধ সব আকিদা-বিশ্বাসের লোকের মধ্যেই থাকে। এর উপকারিতার চেয়ে অনিষ্টকারিতা বেশি। একে দমন করে সৎকর্মে লাগানোর মধ্যেই মানুষের কৃতিত্ব নির্ভর করে। মানুষের মধ্যে ষড়রিপু হলো— কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য। এর মধ্যে ‘মদ’ হলো দম্ভ, গর্ব, অহংকার। ‘মাৎসর্য’ হলো ঈর্ষা, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা। প্রতিটি রিপুই মানুষের প্রয়োজনে সৃষ্ট এবং প্রতিটির দক্ষ ব্যবহার কাম্য। যেমন টক-ঝাল-মিষ্টি-লবণ প্রতিটিই খাদ্যের জন্য প্রয়োজন। কিন্তু অধিক বা অন্যায় ব্যবহারে প্রতিটিই ক্ষতিকর। জীবনে চলার পথে ষড়রিপু আমাদের সার্বক্ষণিক সাথী। দেহের মধ্যে লুক্কায়িত উপরোক্ত ছয়টি আগুনের মধ্যে ‘মদ’ বা অহংকার হলো অন্যতম প্রধান স্ফুলিঙ্গ; যা একবার জ্বলে উঠলে ও নিয়ন্ত্রণ হারালে পুরা মানব গাড়িটাকে পুড়িয়ে বা ধ্বংস করে ছাড়ে।

অহংকারের আরবি নাম ‘কিব্র’; যার অর্থ বড়ত্ব। অন্যের চেয়ে নিজেকে বড় মনে করাই এর অন্তর্নিহিত বক্তব্য। এর পারিভাষিক অর্থ, সত্যকে দম্ভভরে প্রত্যাখ্যান করা এবং মানুষকে তুচ্ছজ্ঞান করা। নিম্নের হাদিসটিতে এর পরিণতি ও ব্যাখ্যা দুটিই বর্ণিত হয়েছে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রা.) বলেন, রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘ওই ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না যার অন্তরে কণা পরিমাণ অহংকার রয়েছে। জনৈক ব্যক্তি প্রশ্ন করল, লোকেরা চায় যে, তার পোশাক সুন্দর হোক, তার জুতা জোড়া সুন্দর হোক। জবাবে রসুল (সা.) বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ সুন্দর। তিনি সৌন্দর্য পছন্দ করেন। কিন্তু ‘অহংকার’ হলো ‘সত্যকে দম্ভের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করা এবং মানুষকে তুচ্ছজ্ঞান করা’। [১]

তিনি বলেন, ‘যেখানেই তোমরা থাকো না কেন, মৃত্যু তোমাদের গ্রাস করবেই। যদিও তোমরা সুদৃঢ় দুর্গের মধ্যে অবস্থান কর।’ (নিসা ৪/৭৮)। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা স্বাদ ধ্বংসকারী বস্তুকে বেশি বেশি স্মরণ কর।’ অর্থাৎ মৃত্যুকে। [১]

অতএব মানুষের জন্য অহংকার করার মতো কিছু নেই। কেননা সে তার রোগ-শোক, বার্ধক্য-জরা কিছুকেই প্রতিরোধ করতে পারে না। শতবার ওষুধ খেলেও আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া তার রোগ সারে না। শত চেষ্টায়ও আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া তার বিপদ দূরীভূত হয় না। ফলে সে একজন অসহায় ব্যক্তি ছাড়া কিছুই নয়। সুতরাং তার উচিত সর্বদা নিরহংকার ও বিনয়ী থাকা।

২. আখিরাতে জওয়াবদিহিতার ভয়ে ভীত হওয়া : কিয়ামতের দিন প্রত্যেকের আমলনামা তার হাতে দিয়ে আল্লাহ বলবেন, ‘তোমার আমলনামা তুমি পাঠ কর। আজ তোমার হিসাব নেওয়ার জন্য তুমিই যথেষ্ট।’ (ইসরা ১৭/১৪)। অতঃপর যখন তারা স্ব স্ব আমলনামা দেখবে, তখন সেই সময়কার অবস্থা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘সেদিন উপস্থিত করা হবে প্রত্যেকের আমলনামা। অতঃপর তাতে যা আছে তার কারণে তুমি অপরাধীদের দেখবে আতঙ্কিত। এ সময় তারা বলবে, হায় দুর্ভোগ আমাদের! এটা কেমন আমলনামা যে, ছোট-বড় কিছুই বাদ দেয়নি, সবকিছুই লিখে রেখেছে। তারা তাদের কৃতকর্মসমূহকে সম্মুখে উপস্থিত দেখতে পাবে। বস্তুত তোমার প্রতিপালক কারও প্রতি জুলুম করেন না।’ (কাহাফ ১৮/৪৯)।

অর্থাৎ আল্লাহ যাকে যে নিয়ামত দিয়েছেন ও দুনিয়াবি দায়িত্ব প্রদান করেছেন, আল্লাহর কাছে তার যথাযথ জবাবদিহিতার কথা সর্বদা স্মরণ করতে হবে এবং কীভাবে সে দায়িত্ব আরও সুন্দরভাবে পালন করা যায়, তার জন্য সর্বদা চেষ্টিত থাকতে হবে। কেননা আল্লাহ মানুষের হায়াত ও মউত সৃষ্টি করেছেন, কে তাদের মধ্যে সুন্দরতম আমল করে, তা পরীক্ষা করার জন্য।’ (সূরা মুলক ৬৭/২)। অতএব এই তীব্র দায়িত্বানুভূতি তাকে অহংকারের পাপ থেকে মুক্ত রাখবে ইনশা আল্লাহ। ‘সুন্দরতম আমল’ অর্থ ‘শরিয়তের আলোকে সর্বাধিক শুদ্ধ আমল এবং অন্তরের দিক দিয়ে সর্বাধিক বিশুদ্ধ কর্ম। যা স্রেফ আল্লাহর জন্য নিবেদিত এবং সকল প্রকার রিয়া ও শ্রুতি থেকে মুক্ত।’ উল্লেখ্য, এখানে ‘অধিক আমল’ বলা হয়নি। অতএব শিরকবিমুক্ত এবং সহি সুন্নাহ অনুমোদিত সৎকর্ম সংখ্যায় ও পরিমাণে অল্প হলেও তাই-ই ‘সুন্দরতম আমল’ হিসেবে আল্লাহর কাছে গ্রহণীয় হবে।

আল্লাহতায়ালা আমাদের অহংকার থেকে বেঁচে থাকার তৌফিক দান করুন।  আমিন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর