রবিবার, ২ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

আওয়ামী লীগে কাউয়া বৃত্তান্ত

নঈম নিজাম

আওয়ামী লীগে কাউয়া বৃত্তান্ত

প্রয়াত আবদুস সামাদ আজাদের সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক ছিল। তার কলাবাগানের বাড়িতে অনেকবার গিয়েছি। তবে বেশি কথা হতো ফোনে। শেষ বয়সে তিনি অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু স্বীকার করতেন না শরীর খারাপ। আমাকে অনেকবার বলেছেন, দলের একটি অংশ তাকে নিয়ে মিথ্যা শরীর খারাপের গল্প ছড়াচ্ছে। তিনি অসুস্থ নন, তবু কেন এই প্রচারণা? জবাব দিতে সিলেটে বড় জনসভাও করেন। সেই জনসভা ভালোভাবে এটিএন বাংলাতে দেখাতে হবে। আমি তখন এটিএন বাংলার বার্তা সম্পাদক। কত সহজ সরল ছিলেন, নিজের শরীর খারাপের কথাও কর্মীদের জানান দিতে নারাজ। চমৎকার মানুষটির সঙ্গে বেশি কথা হতো ’৯১ সালের সংসদে বিরোধী দলের উপনেতা থাকাকালে। ’৯৬ সালে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। তাকে নিয়ে মজার মজার গল্প আছে। আজ সেই বিষয়ে নয়, আজকের বিষয় কাউয়া বৃত্তান্ত। আওয়ামী লীগে কাউয়ার সন্ধান প্রথম পান আবদুস সামাদ আজাদ। ফেসবুকে এ কথাটি মনে করিয়ে দেন নেত্রকোনার আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল মতিন। অনেক বছর পর আবারও দলে কাউয়া ঢুকে পড়ার কথা বললেন ওবায়দুল কাদের। আমি বলব, শুধু আওয়ামী লীগে নয়, আমাদের জাতীয় রাজনীতিতেই কাউয়া ঢুকে পড়েছে। এই কাউয়ারা সরকারি দল হিসেবে আওয়ামী লীগে বেশি। আবার অন্য দল ক্ষমতায় থাকলে সেখানেও ছুটে যায়। আসলে আমাদের দেশে যখন যারা ক্ষমতায় থাকে, তাদের কিছু অতি উৎসাহী সমর্থক তৈরি হয়। আওয়ামী লীগেও তাই হয়েছে। আওয়ামী লীগের কাউয়ারা উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। তাদের পরিমাণ দিন দিন বাড়ার কারণে দৃষ্টিকটু মনে হচ্ছে। চোখে পড়ছে বেশি। দলের নেতা-কর্মীরা হতাশ হচ্ছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলতে বাধ্য হয়েছেন।

আওয়ামী লীগ ঐতিহাসিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠানে নানা ধরনের লোক থাকাটাই স্বাভাবিক। সুবিধাভোগীরা সবসময় আগাছার মতো ঠাঁই নিয়েছে দলটিতে। দুঃসময়ে তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। সুসময়ে ওরা আসে শীতের পাখির মতো। দুঃসময়ে আবার হারিয়ে যায়। দুঃসময়ের কঠোর সমালোচকরা সুসময়ে সবচেয়ে বড় আওয়ামী লীগার। আসলে যুগে যুগে আওয়ামী লীগে একদল লোক কাজ করে, আরেক দল লোক ভোগ-উপভোগ করে। ক্ষমতা দেখলেই কাউয়ারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ভাতগুলো খেয়ে নেয়। কাজ শেষে ক্লান্ত দেহে বাড়ি ফিরে ত্যাগী নেতা-কর্মীরা দেখেন ঘরে খাবার নেই। হঠাৎ এমন হচ্ছে তেমন নয়, কাউয়ারা প্রথম যুক্ত হয় ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর। যারা মুক্তিযুদ্ধ করেনি, যুদ্ধের ৯ মাস দেশে আরাম-আয়েশে ছিল, যুদ্ধ শেষে তারা রাতারাতি আওয়ামী লীগার বনে যায়। কাউয়াদের যন্ত্রণায় ছাত্রলীগের মেধাবী ছেলেগুলো বেরিয়ে গিয়ে বিভ্রান্তির রাজনীতি জাসদে যোগ দেয়। অন্যদিকে কাউয়াদের কা-কা শব্দে সাধারণ মানুষের ঘুম হারাম হয়, বঙ্গবন্ধুর ইমেজ নষ্ট হতে থাকে নাগরিক সমাজে। ১৫ আগস্টের পর এই কাউয়াদের অনেক দিন আওয়ামী লীগে দেখা মেলেনি। এ সময়  ত্যাগী নেতা-কর্মীর শ্রম-মেধায় আওয়ামী লীগ আবার ঘুরে দাঁড়ায়। ১৯৭৯ সালে আওয়ামী লীগ মাত্র ৩৯টি আসন পায়। তখন কাউয়ারা আওয়ামী লীগের সমালোচক।

’৮১ সালে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নেন। এ সময় তার পাশে দাঁড়ান ত্যাগী নেতা-কর্মী আর জনগণ। লাখো মানুষ তাকে বিমানবন্দরে বরণ করে নেয়। ’৮৬ সালের নির্বাচনে ও এরশাদবিরোধী আন্দোলনে কাউয়াদের তার পাশে দেখা যায়নি। কিন্তু এরশাদের পতনের পর ধারণা ছিল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসছে। তখন একদল লোক রাতারাতি আওয়ামী লীগার বনে যায়। কিন্তু ’৯১ সালের নির্বাচনের ফলাফল এই নবাগতদের হতাশ করে। তারা সরে পড়ে। চলে যায় বিএনপিতে। শেখ হাসিনা নতুন করে যাত্রা শুরু করেন। ধানমন্ডির ৩২ ও ২৯ মিন্টো রোডে ভিড় ছিল কট্টর আওয়ামী লীগারদের। তার এই পথচলা অনেক কঠিন ছিল। কারণ এ সময় ড. কামাল হোসেনের সমর্থকরা ’৯১ সালের পরাজয়ের দায়ভার শেখ হাসিনার ওপর চাপানোর চেষ্টা করেন। দলের প্রভাবশালী সিনিয়রদের বড় অংশই শেখ হাসিনাকে দোষারোপ করে বক্তব্য-বিবৃতি দেওয়া শুরু করেন। একপর্যায়ে তারা দল ছাড়েন। দলে আবার ফিরে আসেন মহিউদ্দিন আহমেদ ও আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বাধীন বাকশালের নেতা-কর্মীরা। নেতা-কর্মীদের এই গ্রুপটি দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের বাইরে ছিল। মান-অভিমান ভুলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিকরা এক হয়ে যান। শেখ হাসিনা টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া চষে বেড়াতে থাকেন। প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে প্রগতিশীল চিন্তার অনেক মানুষকে আওয়ামী লীগে ঠাঁই দেন। মাহমুদুর রহমান মান্নাও তখন আওয়ামী লীগে যোগ দেন। শেখ হাসিনা সিভিল সোসাইটির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করেন। সংবাদকর্মীদের সঙ্গে তখন কাজ করতেন মৃণালকান্তি দে। পত্রিকা অফিসে প্রেস রিলিজ নিয়ে ছুটত হৃদয় নামের একটি ছেলে। অনেক দিন হলো হৃদয় মারা গেছে। শেখ হাসিনার এত উইং ছিল না। তিনি নিজে সবার সঙ্গে কথা বলতেন। তার বিটের খবর যারা সংগ্রহ করতেন, তাদের সরাসরি কথা বলার সুযোগ থাকত। তার নিরাপত্তা ও অন্যান্য কাজে মিডিয়া কর্মীরা পেতেন নজীব আহমেদ, মানু মজুমদার, আ ন ম সেন্টু, বাহাউদ্দিন নাছিম, নকিব আহমেদ, আরিফ আহমেদ দুলাল প্রমুখকে। ২০০১ সালে আলাউদ্দিন আহম্মেদ চৌধুরী, ড. আওলাদ হোসেনসহ আরও অনেকে। সেসব দিনের কথা হয়তো কারও মনে আছে, কারও নেই। এখন যদি বলি, ’৭৫ সালের পর এবং  আশির দশকের পুরো সময় সারা দেশের দেয়ালে লেখা থাকত— বাঘা সিদ্দিকী আসছে, খুনিরা কাঁপছে অথবা আওরঙ্গ-লিয়াকতের হুলিয়া নিতে হবে তুলিয়া। অবিশ্বাস্য মনে হবে সব কিছু। কিন্তু এটাই ইতিহাস। এই ইতিহাসের খবর কেউ রাখে না।

বাস্তবতা হলো, অনেক কঠিন সময় পার করেছে আওয়ামী লীগ। ’৮১ সালে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নেওয়ার পর ঝামেলা কম হয়নি। সব ঝামেলাই মোকাবিলা করেছেন শেখ হাসিনা। এর মাঝে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল এরশাদবিরোধী আন্দোলন, ’৮৬ সালের নির্বাচন, ’৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে তছনছ করে আরেকটা নির্বাচনে বিএনপিকে বাধ্য করা। আবদুল মতিন চৌধুরীর মতো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে মোকাবিলা করে আন্দোলন করা। শেখ হাসিনা সফল হলেন। ২১ বছর পর আবার ক্ষমতায় এলেন। ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর একদল কাউয়া আশ্রয় নেয় আওয়ামী লীগে। তারা ক্ষমতার পাঁচ বছর ব্যস্ত ছিল চাটুকারিতা আর সর্বনাশের খেলায়। এই কাউয়াদের কারণে আওয়ামী লীগ ২০০১ সালের নির্বাচনে পরাজিত হয়। এই নির্বাচনে পরাজয়ের পর কঠিন সমস্যায় পড়ে আওয়ামী লীগ। সেই অধ্যায় মোকাবিলা করেছেন দলের ত্যাগী নেতা-কর্মীরা। ২০০১ সালের পর আওয়ামী লীগ কর্মীদের অনেক ভোগান্তি হয়েছে। কীভাবে কর্মীদের হত্যা, হাত-পা কেটে দেওয়া হয়েছিল তা কি আওয়ামী লীগারদের মনে আছে?

মনে না থাকারই কথা। আওয়ামী লীগ খুব সহজে অতীত ভুলে যায়। ভুলে যায় বলেই ২০০৯ সালের পর কাউয়ারা ভিড় করতে থাকে আওয়ামী লীগে। এই কাউয়াদের ২০০১ সালের পর দেখা যায়নি। ওয়ান-ইলেভেনের পর পাওয়া যায়নি। ভুলে গেলে হবে না ১৫ আগস্টের পর কেউ প্রতিবাদ করেননি। শেখ হাসিনা ওয়ান-ইলেভেনের সময় আটকের পরও মিছিল হয়নি। কাদের সিদ্দিকী সশস্ত্র যুদ্ধ করেছিলেন, তার সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে ফাঁসির আসামি হয়েছিলেন দুজন। যারা শহীদ হয়েছিলেন তাদের খবর এখন কেউ নেন না। তারা তো কাদের সিদ্দিকীর জন্য নয়, বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদের জন্যই যুদ্ধে গিয়েছিলেন। সেসব পুরনো ইতিহাস। সেই ইতিহাস নিয়ে কথা বলাও পাপ। কিন্তু মনে রাখা দরকার, একটি ইতিহাসের সঙ্গে আরেকটি গভীরভাবে সম্পৃক্ত। সময়ের বদল হয়, মানুষের বদল হয়, কিন্তু ইতিহাস তার নিজস্ব গতিতে চলে। আর ইতিহাস কোনো দিন কাউকে ক্ষমা করে না। শত বছর পর হলেও বাস্তবতা বেরিয়ে আসে।

আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ইতিহাসে ক্ষমতার সময় এক রকম, বাইরে থাকলে আরেক রকম। আমার সংবাদপত্র জীবনে কম তো দেখলাম না। বিরোধী দলে সবসময় একদল লোক ভূমিকা  রাখে, আরেক দল ক্ষমতার উপভোগে থাকে। এই উপভোগকারীরা আওয়ামী লীগের ক্ষমতার কাউয়া। সবসময় কাউয়া সংস্কৃতি আওয়ামী লীগের সর্বনাশ করে। এবারও তাই করছে। ওবায়দুল কাদেরকে ধন্যবাদ এ নিয়ে কথা বলার জন্য। মনে রাখা দরকার, এত দোকানের দরকার নেই। নতুন প্রতিষ্ঠানও খোলার দরকার নেই। কারও কাজ করার ইচ্ছা থাকলে আওয়ামী লীগের ব্যানারেই করতে পারেন। নিত্য নতুন দোকান খুলতে হবে কেন? একই সঙ্গে আওয়ামী লীগকে কুমিল্লা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। কুমিল্লার রাজনীতি নিয়ে ভাবতে হবে। কুমিল্লাকে গালাগাল করে লাভ নেই। সারা দেশের বাস্তব অবস্থার দিকে নজর দিন। ভুলে গেলে চলবে না, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে প্রতিটি সিটিতে আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়েছিল। এখন সিলেট, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, গাজীপুরে কোন দলের মেয়র? ঢাকা, চট্টগ্রাম পরিস্থিতি নাও আসতে পারে। কুমিল্লায় দলের ভয়ঙ্কর গ্রুপিং ছিল এ কথা সঠিক। গ্রুপিং বন্ধে নেতারা ব্যর্থ হয়েছেন। পাশাপাশি কঠিন নির্বাচনও হয়েছে। নির্বাচন কমিশন তার চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়ন করেছে। প্রশাসন, পুলিশ যথেষ্ট নিরপেক্ষ ছিল।  প্রতিটি ওয়ার্ডে একজন করে ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। সদর দক্ষিণের ওসিকে বদলি করা হয়। ২৫ জন কর্মকর্তাকে একদিন আগে সরিয়ে নতুন কর্মকর্তা দেওয়া হয়। ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন। আরেকটি কথা, জাতীয় সংসদে ১৯৭৩ সালের পর ২০০৮ সালে কুমিল্লা সদর আসনে আওয়ামী লীগ জয় পায়। এবার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা না করতে পারার ব্যর্থতা আওয়ামী লীগকে মেনে নিতে হবে। আর বাস্তবতা মেনে আগামীর কথা ভাবতে হবে। কারণ সরকারের এই মেয়াদে আরও সিটির ভোট হবে। এরপর আছে জাতীয় নির্বাচন। যে এমপি সাহেবরা পুলিশ কনস্টেবল কিংবা পিয়ন নিয়োগে পয়সা নেন, তাদের মনে রাখতে হবে— এই দিন দিন নয়, আরও দিন আছে। এই দিন নিয়ে যাবে সেই দিনের কাছে। কারণ মানুষটি হালের বলদ, ধানি জমি, পুকুর বিক্রি করে নিজের সন্তানের চাকরির জন্য অর্থ দিচ্ছেন, তিনি বা তার পুত্র সুযোগ পেলে আপনার বিপক্ষে অবস্থান নেবেন। আর দলের গ্রুপিং করে যারা সর্বনাশ করছেন, তাদের বলছি, শেখ হাসিনার শক্তির ওপর ভর করে আপনারা ক্ষমতায়। শেখ হাসিনা না থাকলে আপনাদের খুঁজেও পাওয়া যাবে না। ২০০১ সালের চেয়ে ভয়াবহ সর্বনাশ মোকাবিলা করতে হবে। আসমান থেকে আসা পয়গামে সবসময় ক্ষমতায় আসা যায় না। কবি নজরুলের সেই কথা— চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়। বিরোধী দল চুপসে থাকা মানে সব কিছু আপনার নিয়ন্ত্রণে— এ কথা মনে করার কারণ নেই। কারণ রাজনীতির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত শুধু সরকার ও বিরোধী দল এবং তাদের কাউয়ারা নয়, জনগণ প্রতি পাঁচ বছরে একবার নেয়। এই দিনটির অপেক্ষায় তারা বাকি সময় থাকে।

লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন

সর্বশেষ খবর