রবিবার, ২ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

মহিষের বাথান, অজানা উপাখ্যান

শাইখ সিরাজ

মহিষের বাথান, অজানা উপাখ্যান

ভৌগোলিকভাবেই দ্বীপজেলা ভোলার প্রাকৃতিক, আর্থ-সামাজিকসহ সব বৈচিত্র্য অন্য যে কোনো জেলার চেয়ে আলাদা। এমনকি নদীকেন্দ্রিক জনপদ হিসেবেও ভিন্ন এখানকার জীবন-জীবিকা। মেঘনা-তেঁতুলিয়া নদী এ জেলার মানুষের আশীর্বাদের কেন্দ্রভূমি। আর এই দুই নদীর মধ্যবর্তী বিভিন্ন দুর্গম চরে প্রাচীনকাল থেকেই চালু রয়েছে অনন্য এক বাণিজ্যিক কার্যক্রম। সেরকম একটি ক্ষেত্রেই গিয়েছিলাম।   ভোলা জেলা সদরের কাচিয়া ইউনিয়নের রামদেবপুর চর। তুলাতুলি ঘাট থেকে রওনা হলাম মাঝেরচর নামের দুর্গম এক চরের উদ্দেশ্যে। সঙ্গে ছিলেন এই কাচিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জহিরুল ইসলাম নকিব। মেঘনা নদীর ওপর দিয়ে আমার যাত্রা। পাঠক, বলে রাখি মেঘনার দুর্গম চরে কোনো বাথান দেখতে সাধারণত কেউ যায় না। তাছাড়া অনেকটা জনশূন্য চরে নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সেখানে অনেক ঘটনার কথাই শোনা যায়। চারদিকে রোদের ঝিলিক। এই প্রকৃতি, দূরের ও কাছের জনপদ যেন বলছে অনেক কথা। চরে আছে মহিষের বাথান আর ভোলার ঐতিহ্যবাহী একটি খাবার রয়েছে। বহুকাল আগ থেকেই এই বাথানগুলো ভোলার চরগুলোতে দেখা যায়। আর খাবারটি হলো মহিষের কাঁচা দুধ থেকে উৎপাদিত দই। যা ভোলার ব্র্যান্ড। মহিষের বাথানে মহিষ লালন-পালন করা হয় আর যেহেতু চরে চারণভূমি আছে তাই খাবারের কোনো অসুবিধা হয় না। মহিষের খাঁটি দুধ উৎপাদিত হয় সহজেই। মাঝেরচরের বাথান, এখানে কাজ করা রাখাল, মহিষের দুধের দই— এসব বিষয়ে আগ্রহ থেকে সেখানে যাওয়া। দক্ষিণের প্রকৃতিই ভিন্ন। দ্বীপজেলা ভোলার এই দুর্গম অঞ্চলগুলোতে সচরাচর মানুষের যোগাযোগ নেই তেমন। নদী পার হলে ওপারে আর কিছু নেই, ধু-ধু চর আর চর। কত নামের চর। পূর্বের পশ্চিমের চর, পশ্চিমের চর, রাজাপুর, রামদেবপুর চর। আমরা যাব কাচিয়া ইউনিয়নের রামদেবপুর চরে। প্রিয় পাঠক, বলে রাখি ২৬ বছর আগে যখন এই নদীই পাড়ি দিয়েছিলাম দুর্গম চরের মহিষের বাথানের উদ্দেশ্যে, তখনো প্রকৃতি অনেকটা এমনই ছিল। তবে নদীর গতিপথ অনেক পাল্টেছে। সে সময়ের সেই উত্তাল স্রোত, পানির গভীরতা ও নাব্য আর নেই। বোঝা যায়, পাল্টে গেছে এই এলাকার মানুষের জীবনধারাও।

নদীর ধার ধরে ট্রলার এগোচ্ছে রামদেবপুর চরের দিকে। তখন পুবের আকাশে সূর্য উঁকি দিয়েছে মাত্র। নদীর ধার থেকে দিগন্তজুড়ে তরমুজ, টমেটো আর বাঁধাকপির পাতার ওপর ভোরের সূর্যের আলো ফসলের পাতা ভেদ করে এসে পড়ছে আমার গায়ে। দিগন্তজোড়া ফসলি মাঠসমৃদ্ধ বাংলাদেশের কথাই বলছে। অথচ ২৫-২৬ বছর আগে যখন এখানে এসেছিলাম তখন এই চরগুলো ফাঁকাই পড়েছিল। 

নদীর পানি কম থাকার কারণে ট্রলার থেকে নেমে ডিঙি নৌকায় চেপে বসতে হলো। প্রায় দেড় ঘণ্টার নদীপথ পেরিয়ে জনবসতি থেকে বহু দূরের চরে এসে পৌঁছলাম আমরা। একেবারে অচেনা এক দ্বীপ। আমাকে দেখে এগিয়ে এলেন লোকমান নামের একজন। হ্যাঁ, আমার গন্তব্য এই ‘লোকমানের কেল্লা’। অবাক হলাম, আমার ২৫ বছর আগে ভোলার মহিষের বাথানের স্মৃতি এই লোকমানের সঙ্গেই। যা আমার স্মৃতিতে কিছুটা ঝাপসা হলেও লোকমান ঠিকই মনে রেখেছেন। লোকমান বললেন, আরেকবার বিডু (ভিডিও) কইরা নিসেন আমারে। ১৯৯১ সালের কথা বলল সে। সত্যি বহুদিন আগের কথা। তখন বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করতাম। এতগুলো বছর পার হয়ে গেছে কাজে-ভ্রমণে, বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে, ভাবতেই কেমন এক অনুভূতি হয়। অন্যরকম শিহরণ খেলে গেল লোকমানের কথা শুনে। লোকমানকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। সে বলছিল শেষ যখন তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল আমি তরুণ ছিলাম। মজার অথচ বাস্তবতার কথা। ২৬ বছর আগের আমি যে! আমার বন্ধু ক্যামেরাম্যান মোসাদ্দেক হাসানের কথাটাও তার স্পষ্ট মনে আছে। চটকি মারার চরে দেখা হয়েছিল লোকমানের সঙ্গে। মনে পড়ে শুটিংয়ের এক পর্যায়ে একদল মহিষ তেড়ে এসেছিল আমাদের দিকে। কোনো রকম কেল্লায় উঠে প্রাণ বাঁচাই। ওই সময়ে লোকমানের শিশুসুলভ হাসি আজও আমাকে আবেগপ্রবণ করে তোলে। সে সময়ের তরুণ লোকমান আজ প্রবীণ। মনে আছে বাঁশের চোঙ্গায় করে মোষের দুধ দোহনের স্মৃতি। এখনো একই পদ্ধতিতে দুধ দোয়ায় সে। কারণ এই চোঙায় রেখে দিলে সকাল বেলায় দোয়ানো দুধ সন্ধ্যা অবধি নষ্ট হয় না। দারুণ লোকজ আবিষ্কার। 

অনেক পরিবর্তনের ভিতরও লোকমানদের কোনোই পরিবর্তন হয়নি। মহিষের বাথানকে ঘিরেই তাদের জীবন সংসার।

বাঁশের বেষ্টনীর ভিতর উঁচু ঢিপিতে থাকে অনেক মহিষ শাবক। এই উঁচু ঢিপিগুলোই হলো বাঁশের প্রতীকী কেল্লা। বাঁশের কেল্লা সাধারণত প্রাচীন যুগের আধিপত্য ও দুর্গের প্রতীক। এখানে বাঁশের কেল্লার ভিতরে থাকে মহিষ শাবক, আর উপরের বড় খুপরিতে থাকে মহিষ পালকদল। প্রত্যেক মহিষ শাবকের আলাদা আলাদা নাম আছে। নাম ধরে ডাকলেই যারা সাড়া দেয়। অবাক বিষয়! অভূতপূর্ব দৃশ্য। যে বাছুর বের হচ্ছে কেল্লা থেকে সে ঠিক তার মাকে খুঁজে নিচ্ছে। এভাবে একে একে অনেক শাবক তাদের মাকে খুঁজে পেল। রাখালদের ডাকে ‘বাতাসী’ নামের শাবক বেরিয়ে এলো। চলে গেল তার মায়ের কাছে। এ এক অদ্ভুত শৃঙ্খলা, আর মায়ায় জড়ানো প্রকৃতির অন্যরকম খেয়াল। এ যেন মহিষ শাবকদের স্কুল। মায়েরা অপেক্ষমাণ। স্কুল ছুটি হলে ক্লাস থেকে বেরিয়ে একে একে ছুট দিচ্ছে মায়ের কাছে। মানুষের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম কিছু নয়। সত্যিই এ যেন এক অজানা অধ্যায়। মা মহিষ বা শাবক, যা-ই হোক, পালক বা রাখালকে মনে করে তাদের শিক্ষক। যে কোনো নির্দেশনা বা শব্দ অনুসরণ করতে ভুল করে না তারা। মহিষের পাল অপরিচিত মানুষ পছন্দ করে না। আমি তো আগন্তুক। আমার দিকে এমন দৃষ্টি দিচ্ছিল মহিষগুলো যেন মনে হয় এই বুঝি তেড়ে আসবে।  

একেকজন রাখাল দুধ দুইয়ে ফিরছেন। কিন্তু সবারই কথা এক। দুধ উৎপাদনের পরিমাণ কমছে। পাঁচটি মহিষ থেকে মাত্র আড়াই লিটার দুধ পেয়েছে জয়নাল। চরে ঘাস কমে যাওয়ার কারণে এমনটি হচ্ছে। শেষ যেবার এখানে এসেছিলাম দেখেছি, আগে পুরো একটি বাঁশের চোঙা ভরে যেত একটি মহিষের দুধে। প্রায় দু’শ-আড়াইশ মহিষ থাকা সত্ত্বেও মাত্র পাঁচটি বড় কনটেইনার ভরছে না দেখে মনটা খারাপ হলো। উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে দুধের উৎপাদন। শুধু ঘাসই নয়। প্রয়োজন ভালো জাতের মহিষ। বাথানেই পাওয়া গেল দুধ ব্যবসায়ী ফারুক ঘোষকে। তার কাছে জানা গেল, দুধ প্রাপ্তি ও বেচাকেনা প্রসঙ্গে। তিনি জানালেন দশ বছর আগেও প্রতিদিন দশ-বারো মণ দুধ নিতেন তিনি এই চরের বাথান থেকে। কিন্তু এখন তা কমে মাত্র ৭০ লিটারে নেমে এসেছে। বাঁশের কেল্লার ওপরেই রান্না খাওয়া, রাত যাপন। বাথানের এই জীবনের এক আলাদা মজাও আছে। আর মজার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে মোষের ঘন দুধের চা। স্বাদ মনে রাখার মতো। জীবনে যে এই চায়ের স্বাদ নেয়নি, সে বুঝবে না বাথানের চা মানে সে কি জিনিস! সত্যিই অদ্ভুত। সব মিলিয়ে অন্যরকম এক পৃথিবী যেন এটি। কিন্তু সব কথার শেষ কথা, বাণিজ্য। কেমন আছেন মহিষের বাথানের সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা? সুযোগ-সুবিধাই বা পাওয়া যাচ্ছে কতখানি? কথা হলো এই কেল্লার তত্ত্বাবধানকারী আমার ছাব্বিশ বছর আগের পরিচিত মোহাম্মদ লোকমানের সঙ্গে। তিনি জানালেন, সরকারের মহিষ উন্নয়ন প্রকল্পের কোনো সুবিধা তিনি পাননি। দুধ বেচেও তেমন লাভ পান না তিনি। ভ্যাকসিন বা পশুপালন চিকিৎসা সুবিধাবঞ্চিত তারা। বিষয়গুলো আরও সবিস্তারে জানালেন কাচিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জহিরুল ইসলাম নকিব। তিনি জানালেন, সরকার তাদের কোনো নির্দেশনা দেয়নি কিছু করার জন্য। সে জন্য মহিষের বাথানে সরকারি সুবিধার কোনো চিত্রই দেখতে পারেননি জহিরুল ইসলাম নকিব। তবে এসব সংকটও ছাপিয়ে যায় দুর্গম মোষের বাথানকে ঘিরে টিকে থাকা মানুষগুলোর জীবন সংগ্রামের গল্প শুনলে। বিশেষ করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলোচ্ছ্বাসে যখন চারদিকে অথৈ পানি ছাড়া আর কিছুই থাকে না তখন কীভাবে শত শত মহিষ ও নিজের জীবন রক্ষা করেন এই মানুষগুলো। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় হেলু মিয়া তুলে ধরলেন সে গল্প। তিনি জানালেন, মহিষের সঙ্গে তুফানে নদীতে ভেসে গেছেন মাইলের পর মাইল। রাতের পর রাত নির্ঘুম কেটেছে তার। বহুদিন না খেয়ে থেকেছেন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়। শুধু সৃষ্টিকর্তাই বাঁচিয়ে রেখেছেন হেলু মিয়াকে, এমনটাই মনে করেন তিনি।

প্রিয় পাঠক, এই দুর্গম চরেও কাটে কিছু মানুষের জীবন। এখানেও রয়েছে অর্থ ও বাণিজ্যের একটি হিসাব। এখানেও রয়েছে পাওয়া না পাওয়ার অনেক গল্প। যেগুলো কখনই পৌঁছে না নীতিনির্ধারণীর শীর্ষ জায়গাগুলোতে। চরে এখন অনেক ফল-ফসল হচ্ছে। সরকারকেও এ ব্যাপারে মনোযোগ আরও বাড়াতে হবে। বাড়াতে হবে বহুমুখী পরিকল্পনা।  আমরা প্রত্যাশা করি, সরকারের প্রাণিসম্পদ বিভাগ মহিষ বাথানের সমস্যাগুলো কাছ থেকে দেখার জন্য এগিয়ে আসবে। উদ্যোগ নেবে ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখার।  সে সঙ্গে বাথানকেন্দ্রিক মানুষগুলোর জীবনমান উন্নয়নের কথাও ভাববে সংশ্লিষ্টরা। কারণ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের মূল প্রতিপাদ্যই হচ্ছে তৃণমূল প্রতিটি মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটানো।

 

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর