সোমবার, ৩ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা
স্মরণ

সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ : শ্রদ্ধাঞ্জলি

কাজী সালাহউদ্দীন

সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ : শ্রদ্ধাঞ্জলি

বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোরশেদের নাম, ব্যক্তিত্বের প্রভা বিচারালয়ের চার দেয়ালের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রগাঢ় মানবতাবোধসম্পন্ন আলোকিত মানুষ ছিলেন তিনি। বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর (১৯৪৩) ব্রিটিশ ভারতে মানবতার সেবায় ‘আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম’ সংস্থাটির মাধ্যমে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। ’৪৭-এর দেশ ভাগের আগে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়ে দাঙ্গা নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে ভাষা আন্দোলনে তিনি অংশ নেন। যুক্তফ্রন্টের (১৯৫৪) ২১ দফা কর্মসূচি প্রণয়নে তার ভূমিকা বিশেষভাবে স্মরণীয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ৬ দফা দাবি যা ২১ দফারই সারাংশ হিসেবে ইতিহাসবেত্তাদের কাছে বিবেচিত। ঊনসত্তরের ছাত্রদের নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থানের ১১ দফা দাবির প্রতিপাদ্য যে একই সূত্রে গাঁথা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এসব দাবি প্রণয়নে যার প্রজ্ঞা, মেধা এবং মনন ক্রিয়াশীল ছিল তিনি অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্ব বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ।

১৯৬১ সালে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী কমিটি গঠনে তিনি তৎকালীন সরকারের সব বাধা উপেক্ষা করে অগ্রনায়কের ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। কবি শামসুর রাহমান এক স্মৃতিচারণে এ  প্রসঙ্গে লেখেন— ‘মনে পড়ে, সেই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে স্টেজে তাঁর পাশে বসবার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। তিনি সভাপতির ভাষণ পাঠ করেছিলেন তার জলদমগ্ন কণ্ঠস্বরে, আর আমি পড়েছিলাম বরীন্দ্রনাথকে নিবেদিত একটি কবিতা। মুগ্ধ হয়ে শুনেছিলাম বিচারপতি মোরশেদের সুলিখিত ভাষণ। সেই ভাষণ ছিল কুিসতের বিরুদ্ধে সুন্দরের, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের, সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে ঔদার্যের প্রতিবাদ। এখনো মনে পড়ে সেই ঋজু, দীর্ঘ দণ্ডায়মান মূর্তি, সেই প্রগাঢ় উচ্চারণ। মনে হয় এখনো তিনি দাঁড়িয়ে আছেন সেখানে সেই আলোকময় মণ্ডপে— চিত্ত যেথা ভয়শূন্য।’

১৯৬৮ সালে যখন কুখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত প্রধান আসামি শেখ মুজিবুর রহমান তখন তার কৌঁসুলি স্যার উইলিয়ামসের সবচেয়ে নিকটতম ছিলেন বিচারপতি মোরশেদ। প্রথম সাক্ষাতে বিচারপতি মোরশেদ টম উইলিয়ামসকে বলেছিলেন : ‘আমি আপনার সহকারী হিসেবে কাজ করে যাবো।’ জবাবে টম উইলিয়ামস তাকে বলেছিলেন : ‘একজন প্রধান বিচারপতি সব সময়ের জন্যই প্রধান বিচারপতি। সুতরাং আপনি আমার উপদেষ্টা হিসেবেই কাজ করবেন।’ টম উইলিয়ামস যতদিন ছিলেন ততদিন বিচারপতি মোরশেদকে প্রধান বিচারপতি বলেই সম্বোধন করতেন। ঐতিহাসিক কুখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিপক্ষে শেখ মুজিবের পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করে বিচারপতি মোরশেদ প্রধান বিচারপতির পদ থেকে পদত্যাগ করে সে সময়ে সংবাদের শিরোনাম হয়েছিলেন। দোর্দণ্ড প্রতাপশালী আইয়ুবের মসনদ সেদিন কেঁপে উঠেছিল। নির্ভীক বিচারপতি হিসেবে মোরশেদের নাম তখন সাধারণ মানুষের হৃদয়ে স্থান লাভ করেছিল। কবি শামসুর রাহমান এ প্রসঙ্গে লেখেন :  ‘আইয়ুবী আমলে তিনি যে সাহস, বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিলেন তা কি কখনো বিস্মৃত হওয়া সম্ভব আমাদের? বিচারপতি কায়ানীর মতোই তিনি এক প্রতিবাদী অস্ত্র হয়ে ঝলসে উঠেছিলেন। তিনি সহজেই পারতেন গ্রন্থাগারে লীন হয়ে যেতে, সুবিধাবাদের ভিতর মহলে বসবাস করে নিজস্ব সমৃদ্ধির ভাণ্ডার কানায় কানায় ভরে তুলতে, নীরব দর্শক সেজে থাকতে। কিন্তু তিনি তা পারেননি। তিনি পারেনি জনসাধারণের প্রতি উদাসীন থাকতে। তার পক্ষে সম্ভব হয়নি অন্ধকারে সিটি বাজিয়ে একলা পথচলা। জনসাধারণের কল্যাণ ও মুক্তির জন্য, গণতন্ত্রের বিকাশের জন্য তিনি নিয়োজিত করেছিলেন তার মেধা, স্বাধীন চিন্তা ও বিবেক।’

মানুষের ভোটাধিকার, প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিচারপতি মোরশেদের সুচিন্তিত ‘ওয়ান মেন— ওয়ান ভোট’ পদ্ধতিও সত্তরের নির্বাচনে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল। সত্তরের নির্বাচনে ‘ওয়ান মেন— ওয়ান ভোট’ পদ্ধতিতেই ৩০০ আসনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান ১৬৯টি আসন লাভ করেছিল। বিচারপতি মোরশেদ সম্পর্কে বিচারপতি মোস্তফা কামাল এক নিবন্ধে বলেন : ‘কবি শিল্পী-সাহিত্যিকের মতো বিচারপতি মোরশেদের অন্তরেও একটি কান্না ছিল, একটি জ্বালা ছিল, একটি অস্থিরতা ছিল। যাদের কান আছে তারা এই কান্না শুনতে পারেন তার রায়ে, যাদের অনুভূতি আছে তারা এই জ্বালার প্রখরতায় দগ্ধ হবেন। বিচারকের রায় তার বিচার কর্মের চূড়ান্ত প্রকাশ। বিচারপতি মোরশেদের রায়গুলো তার বিচার কর্মের চূড়ান্ত প্রকাশে শিল্পকর্মের মত। শব্দ বিন্যাসে, ভাষার স্বাচ্ছন্দ্যে ও গতিশীলতায়, বিচার বিশ্লেষণের নিপুণতায় ও মত প্রকাশের স্পষ্টতায় ও কনিষ্ঠতায় তার বহিরঙ্গ যেমন অনবদ্য ও অসাধারণ, তেমনি জীবন দর্শনের গভীরতায় সত্যের প্রতি অবিচল নিষ্ঠায়, মানবাধিকারের প্রতি আনুগত্যে, বঞ্চিতের প্রতি সমবেদনায় তার অন্তরঙ্গ তেমনি নিটোল ও ভরপুর।’

আদর্শ মানুষদের জীবনী পাঠ থেকে পরবর্তী জেনারেশন তাদের চরিত্র গঠন— জীবনের লক্ষ্য স্থির করে নেয়। এ কারণেই পাঠ্য তালিকায় বিচারপতি মোরশেদের সংক্ষিপ্ত জীবন অন্তর্ভুক্ত হোক। অতীত ইতিহাস, স্বাধীনতার  ইতিহাস নতুন প্রজন্ম জানবে এটাই তো স্বাভাবিক। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ছিলেন বিচারপতি মোরশেদের মামা। এদেশের মাটি মানুষের ইতিহাসের সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী এ পরিবার কত গভীরভাবে সম্পৃক্ত তা নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য পাঠ্য তালিকায় বিচারপতি মোরশেদের গৌরবোজ্জ্বল জীবন অন্তর্ভুক্ত করার কোনো বিকল্প নেই। পাশাপাশি তার পাণ্ডিত্যপূর্ণ রচনাসমূহ প্রকাশ করা প্রয়োজন আমাদের জাতীয় স্বার্থেই।

১৯৭৯ সালের ৩ এপ্রিল বিচারপতি মোরশেদ এই সুন্দর সুশোভিত পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। তার মৃত্যুদিনে নিবেদন করছি অনন্ত শ্রদ্ধা। কারণ তিনি আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস-বাতিঘর।

লেখক : কবি ও সচিব, সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ স্মৃতি সংসদ।

সর্বশেষ খবর