মঙ্গলবার, ৪ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

সংশোধনীর জাঁতাকলে পবিত্র সংবিধান

মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন

সংশোধনীর জাঁতাকলে পবিত্র সংবিধান

১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধান অনুমোদন পায় গণপরিষদে। মুক্তিযুদ্ধের মহান বিজয়ের পর জাতি পায় তাদের আকাঙ্ক্ষার সংবিধান, যা ছিল গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, আইনের শাসন,  মানবাধিকার ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের মূল্যবান সনদ। জাতি যাত্রা শুরু করল সংসদীয় পদ্ধতির পথ ধরে। কিন্তু অচিরেই সেই সুন্দর পবিত্র সংবিধান বেয়নেটের আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত করা হলো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার লক্ষ্যে। অর্থবহ গণতান্ত্রিক বিধানকে বিদায় দিয়ে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় পদ্ধতির সরকার চালু হলো। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হলো রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা। জাতি পেল আজ্ঞাবাহী মন্ত্রিপরিষদ এবং ক্ষমতাহীন জাতীয় সংসদ। একদলীয় শাসন ব্যবস্থায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়। এর আগে ১৯৭৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিধান, বিবর্তনমূলক আটক-সংক্রান্ত আইনের মধ্য দিয়ে মৌলিক অধিকারে আঘাত হানা হয়। ৭২ সালের ৪ এপ্রিল বাংলাদেশে প্রথম সংবিধানের অধীনে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার যাত্রা শুরু করল। যে সংবিধান এ দেশের জনগণের রক্তের আকরে লেখা, এক পূতপবিত্র জাতীয় দলিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত রাজনৈতিক নেতৃত্ব রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকাকালীন অবস্থায় ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা চালু করা হলো।

প্রকৃতপক্ষে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর তারিখে গণপরিষদে এ সংবিধান গৃহীত হয় এবং ১৯৭২ সালের ১২ ডিসেম্বর তারিখে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান বলবৎ হয়। সংবিধান বলবৎ হওয়াকে সংবিধানে সংবিধান প্রবর্তন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আর সে সংবিধান নিয়ে আমরা সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার পথে যাত্রা শুরু করি। সেই আদি বা মূল সংবিধানে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনে ১৬টি সংশোধনী আনা হয়। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারির সংশোধনী স্বাধীনতার মূলমন্ত্র থেকে বিচ্যুতি ঘটায়। ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন হয়। বহুদলীয় গণতন্ত্র, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের মধ্য দিয়ে বিচার বিভাগ তার স্বাধীনতা ফিরে পায়। আবার ফিরে পায় তার আদি ব্যবস্থা। প্রত্যেক রাজনৈতিক দল তার দলীয় রাজনীতি করার অধিকার ফিরে পায়, জাতি একদলীয় শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্তি পায়।

পঞ্চম সংশোধনীর মধ্য দিয়ে একদলীয় সরকার পদ্ধতির বিধান বিলুপ্ত হলেও রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতি চালু ছিল। কিন্তু ১৯৯১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সংসদে ১২তম সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশে আবার সেই বহু আকাঙ্ক্ষিত সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। জনগণ তাদের বহু কষ্টে অর্জিত স্বাধীনতার স্বাদ, ভোটের অধিকার, মৌলিক অধিকারসমূহ ফিরে পায়। একই ধারায় ১৯৯৬ সালের ২৮ মার্চ ১৩তম সংশোধনীর মধ্য দিয়ে এ দেশের জনগণ দলীয় সরকারের প্রভাবমুক্ত ভোটদানের অধিকার নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি প্রবর্তন করে। বাংলাদেশের সংবিধানের ইতিহাসে ১২তম এবং ১৩তম সংশোধনী ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার পরিবর্তে জনগণের ভোটের অধিকার জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার এক বিরল দৃষ্টান্ত। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে দেশে তিনটি সংসদ নির্বাচনে জনগণ তাদের ইচ্ছামতো প্রার্থীকে ভোট দিয়ে সংসদে পাঠিয়েছেন। ঐতিহাসিকভাবে এ কৃতিত্বের দাবিদার বেগম খালেদা জিয়া, যার নেতৃত্বেই এ দুটি সংশোধনী সংবিধানে এনে জনগণের মৌলিক অধিকার সমুন্নত রাখার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু ২০১১ সালের ৩০ জুন একটি বিতর্কিত রায়ের আলোকে ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিলুপ্তকরণের মধ্য দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার বিধান জারি করে জনগণের ভোটের অধিকার হরণের প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করা হয়। এ ১৫তম সংশোধনীকে চতুর্থ সংশোধনীর নব সংস্করণ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। ১৫তম সংশোধনীর অধীনে সংবিধানে ৫৩টি অনুচ্ছেদ চিরকালের জন্য সংশোধন অযোগ্য করা হয়েছে। গণভোটের বিধান বিলুপ্ত করা হয়েছে। অথচ সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের উপ-অনুচ্ছেদ ১(খ)-এ গণভোটের বিধান বিলুপ্ত করে মূল জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করা হয়েছে। অথচ বর্তমানেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণভোটের পদ্ধতি প্রচলিত। স্কটল্যান্ড যু্ক্তরাজ্যের সঙ্গে থাকবে কী থাকবে না এবং ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে থাকবে কী থাকবে না তাও নির্ধারিত হয় গণভোটের মাধ্যমে, যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গণতান্ত্রিক পদ্ধতি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করে এক ব্যক্তির স্বৈরশাসনের ভিত তৈরি করা হয়েছে। ১৫তম সংশোধনীর মধ্য দিয়ে সাংবিধানিক স্বৈরাচার যে কত ভয়ানক তা বুঝতে কারও বাকি নেই। যার ফলে পঞ্চদশ সংশোধনীর কোনো সার্বজননীতা নেই। এ সংশোধনী ৭৫(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তিনিই স্বপদে বহাল থাকিবেন।’ এই সংশোধনীর ৫৬(৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার অব্যবহিত পূর্বে যারা সংসদ সদস্য ছিলেন তারা সদস্যরূপে বহাল রহিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন।’ এমনকি সংবিধানের অত্র সংশোধনী ৫৮(৪) এবং (৫) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা তাদের উত্তরাধিকারীগণ কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্ব-স্ব পদে বহাল থাকিবেন।’

অত্র সংশোধনীর ৭২(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘রাষ্ট্রপতি পূর্বে ভাঙ্গিয়া না দিয়া থাকিলে প্রথম বৈঠকের তারিখ হইতে পাঁচ বৎসর অতিবাহিত হইলে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবে।’ তবে তিনি উক্ত সংসদের এ মেয়াদ এককালে অনধিক এক বৎসর যাবৎ বর্ধিত করতে পারবেন। অত্র সংশোধনীর ১২৩(৩)(ক) এবং ১২৩(৩)(খ) অত্র সংশোধনীর ৭২(৩) অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি সংসদ পূর্বে ভাঙ্গিয়া না দিয়া থাকিলে ১ম বৈঠকের তারিখ হইতে পাঁচ বৎসর অতিবাহিত হইলে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবে। যা ৭২ সালের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

পঞ্চদশ সংশোধনীর আনীত সংশোধনীর ৫৩টি অনুচ্ছেদ আদি সংবিধানের মৌলিক বিধানগুলোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। পঞ্চদশ সংশোধনী সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়কে ভিত্তি করে আনা হয়েছে আর এই সংশোধনীর মধ্য দিয়ে আমাদের প্রচলিত নির্বাচন ব্যবস্থাকে সংকটাপন্ন করা হয়েছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন জাতির জীবনে যে ক্ষত সৃষ্টি করেছে তার অবসান হবে না যতক্ষণ না পর্যন্ত মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য ও সব দলের অংশগ্রহণে আরেকটি নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন আরেকটি সরকার গঠন করা হবে। জনগণ বলবে এ সরকার আমাদের সরকার। সরকার সম্পর্কে থাকবে না বিতর্কের কোনো অবকাশ, ইতিমধ্যে এই সংকট অনুধাবন করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন আমি আর কোনো প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন চাই না। কেননা গণতন্ত্র মানে সম্মতির শাসন। আর শাসন প্রতিষ্ঠা হয় নির্বাচনের মাধ্যমে, এখানেই সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে পঞ্চদশ সংশোধনীর সাংঘর্ষিক অনুচ্ছেদগুলো বড়, নাকি জনগণের আস্থা অর্জন বড়। সংবিধানের ৭(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হবে। আর এই অনুচ্ছেদের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ কিছু থাকলে তা বাতিল গণ্য করা হবে।

সুপ্রিম কোর্টের যে রায় আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থা ও জাতিকে সংকটে ফেলেছে সেই নির্বাচনী ব্যবস্থা সংবিধানের ১৩তম সংশোধনীর আলোকেই সংকট মুক্ত হতে পারে। পৃথিবীর কোথাও সংসদীয় ব্যবস্থায় সংসদ বহাল রেখে সংসদ নির্বাচনের ইতিহাস নেই। যার কারণ অতি সহজ। সংসদ না ভেঙে সংসদ নির্বাচন হতে পারে না। আর সংসদ না থাকলে সরকারও নির্বাচিত থাকে না। কিন্তু আমাদের দেশে বিচার বিভাগের একটি মাত্র বিতর্কিত রায়ের ওপর ভিত্তি করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার হীন প্রচেষ্টায় রাজনৈতিক নেতৃত্বই এই সংকট সৃষ্টি করেছে। আর এই ধরনের কলঙ্ক থেকে জাতিকে সংকটকাল থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হচ্ছে পঞ্চদশ সংশোধনীর সঙ্গে মূল সংবিধানের যে সাংঘর্ষিক অনুচ্ছেদগুলো সংযোজন করা হয়েছে, তা বাতিল করে অনতিবিলম্বে জনগণের ইচ্ছায় নির্বিঘ্নে সরকার পরিবর্তনের গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা চালু করা। সবাইকে মনে রাখতে হবে যে কোনো সরকারকে সরিয়ে দেওয়া বা ক্ষমতায় বসানোর ক্ষমতা জনগণের হাতে থাকার নামই গণতন্ত্র। মোদি বা ট্রাম্প কাউকে ক্ষমতায় বসানো ও ক্ষমতাচ্যুত করতে পারবে না। একমাত্র জনগণই সেটা পারে। এটি হলো গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। ২০১৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের প্রাক্কালে জাতিকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ৫ জানুয়ারির নির্বাচন শুধু নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। অথচ সেটা বেমালুম ভুলে গিয়ে জাতিকে তিনি সংকটে ফেলেছেন। মনে রাখতে হবে ভোট দেওয়ার অধিকার আর ভোট নেওয়ার অধিকার এক নয়। গণতন্ত্রকে অনেক স্বৈরশাসক বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করতে চেয়েছেন। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় তাদের স্থান হয়নি। ২০১৪ সালের ১৪ নভেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাবেক ভারতীয় হাইকমিশনারদের বৈঠকে ঝানু কূটনীতিক পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলেছেন, বাংলাদেশে আদর্শ গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে আসুক। এ প্রত্যাশায় তিনি আরও বলেছেন, বাংলাদেশে একটি আদর্শ নির্বাচন ব্যবস্থা, গণতান্ত্রিক পরিবেশ এবং শক্তিশালী বিরোধী দল সবাই চায়। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারতও এটা চায়। তিনি আরও বলেছেন, ভারত আশা করে বাংলাদেশ আইডিয়াল ডেমোক্রেসিতে ফিরে আসবে, কেননা সবাই একটি ভালো নির্বাচনে ফিরে আসতে চায়। এবং সবাই চায় বাংলাদেশ সংসদে কার্যকর বিরোধী দল। সবশেষে দ্বিধাহীনচিত্তে বলতে চাই পঞ্চদশ সংশোধনীর কোনো সার্বজনীনতা নেই। সেহেতু সেই সংকট থেকে উত্তরণের উত্তম ব্যবস্থা হচ্ছে গণতন্ত্রের কর্তৃত্বহীনতা পরিহার করে গণতন্ত্রের আদি সংজ্ঞায় ফিরে গিয়ে সরকার পরিবর্তনের ক্ষমতা জনগণকে ছেড়ে দেওয়া। উত্তম পথ হচ্ছে নির্বাচন পরিচালনার জন্য নির্বাচনকালীন এডহক ভিত্তিতে সরকার গঠনের ব্যবস্থা করা। যার মধ্য দিয়ে জনগণ ফিরে পাবে তাদের বহু আকাঙ্ক্ষিত ভোটের অধিকার। জাতি মুক্তি পাবে এক শাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে, পথহারা বাংলাদেশে ফিরে আসবে তার মৌলিক ভিত্তি গণতন্ত্র।

     লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।

সর্বশেষ খবর