মঙ্গলবার, ৪ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

জীবন সংগ্রামে আদর্শিক শক্তিই হলো সম্বল

শফিকুল ইসলাম শফিক

জীবন সংগ্রামে আদর্শিক শক্তিই হলো সম্বল

জীবন হলো নিরন্তর সংগ্রামের নাম, যোগ্যতা ও প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অধিকার প্রতিষ্ঠার নাম— আল্লামা ইকবাল। জীবন কারও দয়া ও দান নয়। জীবন তো যোগ্যতা বলে নিজে অর্জন করতে হয়। আপনি জীবনের অধিকার অর্জন করুন, পৃথিবী আপনাকে গ্রহণ করতে বাধ্য হবে। বর্তমান সময়ে এসে ইসলামের মূলধারা কওমি শিক্ষার ধারার প্রবাহ ও প্রভাব হয়ে পড়েছে সংকীর্ণ ও সীমাবদ্ধ। আমরা কেবল বিশেষ একটা জায়গাতে কোণঠাসা হয়ে পড়েছি। তা থেকে উত্তরণ ছাড়া বেঁচে থাকার কঠিন লড়াইয়ে আমাদের পরাজিতের ভাগ্যবরণ করতে হবে। জার্মানির ইতিহাস দেখুন, দুটি বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পরও বিজয়ী শক্তি মানচিত্র থেকে তাকে মুছে ফেলতে পারেনি, বরং ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় তার অস্তিত্ব মেনে নিয়েছে। পৃথিবীতে বহু জাতির বিলুপ্তি ঘটেছে, আবার এমনও জাতি আছে যারা বার বার পরাজিত হয়েও টিকে আছে। তাতারিদের হাতে মুসলিম জাতির এমন পরাজয় ঘটেছিল যে সম্ভবত দুনিয়ার অন্য কোনো জাতির ইতিহাসে তার নজির নেই। কিন্তু তাদের মাঝে ছিল মানবতার কল্যাণ সাধনের যোগ্যতা, তাদের কাছে ছিল একটি জীবন্ত বাণী ও বার্তা, তাই বিজয়ী তাতারিদের শেষ পর্যন্ত মাথা নোয়াতে হয়েছিল মুসলিম জাতির সামনে। মানব জাতির ইতিহাস প্রমাণ করে যে সময় ও সমাজ খুব বেশি সময়ের জন্য দয়া ও করুণার আবদার বরদাশত করে না এবং ব্যর্থতার কাহিনী শুনতে চায় না। কেননা জীবন হলো চির প্রবহমান স্রোতধারা। সময় এমনই বাস্তববাদী যে যোগ্যতা ও উপযোগিতার প্রশ্নে সে অবিচল এবং শ্রেষ্ঠত্বের বন্দনায় বিভোর। তাই যোগ্যতা ও উপযোগিতা ছাড়া কাউকে গ্রহণ করতে কিংবা      নিজের অংশ ছেড়ে দিতে সময় রাজি হয় না।

পৃথিবীর বুকে কোনো প্রতিষ্ঠান শুধু এই যুক্তিতে এগিয়ে যেতে পারে না যে আজ থেকে ১০০-২০০ বছর আগে তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং জাতির জীবনে তার অবদান রয়েছে। সুবর্ণ অতীত ও গৌরবময় ইতিহাসের কথা বলেও পার পাওয়া যায় না। শুধু ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে আশ্রয় করে এবং শুধু অতীতের দোহাই পেরে কোনো প্রতিষ্ঠান, কোনো দল ও আন্দোলন এবং কোনো দর্শন না কোনো সময়ে চলেছে না আগামীতে চলবে। কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব রক্ষায় কিংবা তার আনুকূল্য লাভের জন্য আপনি যদি তার ইতিহাস ও অবদান তুলে ধরেন তাহলে কেউ তা কান পেতে শুনতে পর্যন্ত রাজি হবে না। কোনো কারণে মানুষ যদি চুপ থাকেও, তাহলে আগামীকাল অবশ্যই ভিতর থেকে জোর দাবি উঠবে যে, এ বোঝা নামাও, এ অপবাদ দূর কর। এমনকি বিনোদনের জগতেও দেখুন আজকের নন্দিত তারকা আগামীকাল কীভাবে কক্ষচ্যুত হয়ে পড়ে। এ পৃথিবীতে করুণার কোনো স্থান নেই। এমনকি যোগ্যতরের মোকাবিলায় যোগ্য ব্যক্তিরও এখানে স্থান নেই। এই বিশ্বজগতে আল্লাহর যে অটল বিধান শুরু থেকে কার্যকর এবং আল কোরআন আমাদের সামনে যে সত্য তুলে ধরে তা এই যে অধিকতর উপকারীই শুধু টিকে থাকবে। আজকের পৃথিবী অবশ্য যোগ্যতরের অধিকারের কথা বলে, কিন্তু আল কোরআন ঘোষণা করেছে অধিকতর উপকারীর বেঁচে থাকার বিধান এবং এটাই সত্য, আয়াতটিতে পরিষ্কার বলা হয়েছে।

ফেনা ও খড়কুটা যা তা ভেসে যাবে, আর যা মানুষকে উপকার দান করে তা টিকে থাকবে। এভাবেই আল্লাহ উদাহরণ তুলে ধরেন। সময় ও সমাজের জন্য যে প্রতিষ্ঠানের উপকারিতা নেই, যার কাছে কোনো বার্তা নেই, যার কোনো অবদান বর্তমান নেই, মানুষের উন্নতি ও অগ্রগতি যার ওপর নির্ভরশীল নয় এবং মানবতার অস্তিত্ব ও বিকাশ যার মুখাপেক্ষী নয় তা নিজেও অস্তিত্বের অধিকার হারিয়ে ফেলে। এ ধরনের অপ্রয়োজনীয় বস্তুকে আল কোরআনে যাবাদ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে, যা অত্যন্ত গভীর ও ব্যাপক অর্থবহ শব্দ। যাবাদ হলো সাগরের ফেনা, যার ভিতরে স্বতন্ত্র সত্তাগত অস্তিত্ব নেই, যার মধ্য স্থিতি ও স্থায়িত্বের যোগ্যতা নেই। কেননা ফেনা শুধু সাগরে স্ফীতির একটি বাহ্যিক প্রকাশ। তাতে কোনো বস্তুগুণ ও জমাট নেই, বাতাস ভরা ফাঁপা অবস্থা মাত্র। আল্লাহর বিধান ও অনুমতি দেয় না যে, ‘যাবাদ’ বা সাগরের ফেনা বেশি সময় টিকে থাকবে। কেননা বিশ্বজগতে ততটা প্রশস্ততা নেই যে সাগরের যুগ যুগের ফেনা ও খড়কুটো সে ধারণ করতে পারে। সাগর ফেনার মতো অপদার্থ যদি জগতে থাকে, তাহলে তো মানুষের উপকারের জন্য যেগুলোর থাকা উচিত সেগুলোর জন্য স্থান সংকুলান হবে না। তাই আল্লাহর অটল বিধান এই যে, যা মানুষের উপকার করবে এবং যা মানুষ ও মানবতার জন্য কল্যাণকর প্রমাণিত হবে তাই শুধু পৃথিবীতে থাকবে। যত তিক্তই হোক স্পষ্ট সত্য এই যে, আমাদের দীনি মূলধারার যদি অস্তিত্ব রক্ষা করতে চাই এবং জিন্দেগীর কাফেলার মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান নিশ্চিত করতে চাই তাহলে অবশ্যই আমাদের নিজের উপকারিতা এবং যোগ্যতা ও উপযোগিতা প্রমাণ করতে হবে। সময় ও সমাজের কাছে আমাদের এ সত্য তুলে ধরতে হবে যে, চলমান জীবনে দীনের প্রয়োজন রয়েছে এবং তাকে বাদ দিয়ে মানবিক প্রয়োজন পূর্ণ হতে পারে না, বরং তার অবর্তমানে এক বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি হবে, যা মানব সমাজের জন্য ক্ষতিকর। এ ছাড়া অস্তিত্ব রক্ষা এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার আর কোনো উপায় নেই। কেননা সময় ও সমাজ যে ভাষা বোঝে এবং সবসময় বুঝে এসেছে তা হলো যোগ্যতা ও প্রতিযোগিতা এবং উপকারিতা ও প্রতিযোগিতার ভাষা, এ ভাষা বোঝার জন্য তরজমার প্রয়োজন নেই। আরবিতে বলুন কিংবা ইংরেজিতে জামানা তা বোঝবে। শব্দের ভাষায় বলুন কিংবা শব্দহীন ভাষায় জামানা তা বুঝবে। কেননা মানুষের ভাষা বিভিন্ন, কিন্তু জামানার ভাষা অভিন্ন। জামানা যে ভাষা বোঝে তা হলো যোগ্যতা, সংগ্রামময় জীবনের মুখরিত অঙ্গনে নিজের প্রতিষ্ঠার ভাষা। তাতারিদের শক্তি ও বিক্রম মুসলমানদের পরাজিত করেছিল কিন্তু তাতারিদের হৃদয় ও মস্তিষ্ক মুসলমানদের দাওয়াতের সামনে, তাদের উপকারিতা ও কল্যাণের সামনে অবনত হয়েছিল।

     লেখক : ইসলামী গবেষক।

সর্বশেষ খবর