মঙ্গলবার, ৪ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

রজব মাস ও আত্মোন্নয়ন

মুফতি আমজাদ হোসাইন হেলালী

রজব মাস ও আত্মোন্নয়ন

প্রতি বছর আমাদের কাছে রজব মাস ঘুরে ঘুরে আগমন করে। এই রজব মাসের দাবি কী?  রজব মাস মূলত মাহে রমজান আগমনের শুভ সংবাদ দান করে। একজন মানুষকে কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে হাজারও যুদ্ধ করে সুপ্রবৃত্তির বিকাশ ঘটাতে হয়। নফসে আম্মারার বিরুদ্ধে কঠিন সাধনা করে সঠিক পথের ওপর অটল থাকতে হয়। অতীত পাপের জন্য লজ্জিত হয়ে এবং পাপকার্য না করার সংকল্পকে মূলত তওবা বলে। তওবার প্রয়োজন এ জন্যই যে, পাপ মানবাত্মায় গভীর অন্ধকার সৃষ্টি করে। মানুষ যত বেশি পাপ করে তার মনে তত বেশি  অন্ধকারের আবরণ গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে। মানবাত্মা থেকে সৃষ্ট এই গভীর অন্ধকার দূর করার একমাত্র মাধ্যম হলো তওবা। তওবা অর্থই হচ্ছে, আল্লাহর দেওয়া তামাম বিধিবিধানের দিকে নিজেকে ফিরিয়ে আনা। নিজের মনকে সম্পূর্ণরূপে পরিশুদ্ধ করে সব অন্যায় থেকে মুক্ত থাকার লক্ষ্যে আন্তরিকতার সঙ্গে একনিষ্ঠভাবে সামনে আল্লাহর পথের দিকে পথ চলার নাম তওবা। আমাদের সব সময় আল্লাহর ভয় ও অনুতাপের সঙ্গে আল্লাহর রহমত, ক্ষমা ও সাহায্য পাওয়ার জন্য সব গুনাহের কথা স্মরণ করে মওলার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। একজন মুমিন-মুসলমানের ভিতরে আল্লাহর ভয় ও নিজের গুনাহের অনুতাপ তৈরি হয় সুন্নতের অনুসরণের মাধ্যমে। নবীজীর সুন্নতের অনুসরণ যে যত বেশি করবে তার মধ্যে তত বেশি আল্লাহর ভয় ও গুনাহের অনুতাপ সৃষ্টি হবে। পবিত্র  কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘অতএব, তোমার পালনকর্তার কসম, সে লোক ইমানদার হবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে ন্যায়বিচারক বলে মনে না করে। অতঃপর তোমার মীমাংসার ব্যাপারে নিজের মনে কোনো রকম সংকীর্ণতা পাবে না এবং তা হৃষ্টচিত্তে কবুল করে নিবে।’ (সূরা নিসা : ৬৫) এ আয়াতে মহানবী (সা.)-এর সুউচ্চ মর্যাদা বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে মুমিনের গুণাবলির দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা কসম খেয়ে বলছেন কোনো মানুষ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন কিংবা মুসলমান হতে পারবে না যতক্ষণ না সে ঠাণ্ডা মাথায় এ কথা মেনে নেবে যে, ‘আমার রসুল যা কিছু বলেছেন এবং করতে বলেছেন বা যার থেকে নিষেধ করেছেন তার সব কিছু আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি ও মেনে নিই।’ অপর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে, ‘রসুল তোমাদের যা কিছু দান করেন তা তোমরা গ্রহণ কর। আর যা কিছু থেকে তিনি তোমাদের বিরত থাকতে বলেছেন তা থেকে বিরত থাক এবং আল্লাহকে ভয় কর নিশ্চয় আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।’ (সূরা হাসর : ৭) একজন মানুষের জন্য সত্যিকারের আল্লাহর ভয় তখন হাসিল হয়, যখন তার ভিতরে একিন, রসুল (সা.) তথা সুন্নতের অনুসরণ ও ইহসানের গুণাবলি হাসিল হয়। একিন অর্থ আল্লাহ থেকে সব কিছু হওয়ার বিশ্বাস অন্তরে রেখে মাখলুক থেকে দিল পরিষ্কার করা। মাখলুক কিছু করতে পারে না এ কথা অন্তরে গেঁথে নেওয়া। আর ইহসান অর্থ সারাক্ষণ আল্লাহর ধ্যান অন্তরে সজাগ রাখা, সব ধরনের ইবাদত আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা। তাঁকে হাজির-নাজির মনে করে ইবাদতসহ সব পার্থিব কাজ করা। যা নিয়মিত জিকির করার দ্বারা হাসিল হয়। আল্লামা জমিরুদ্দীন নানুপুরী (র.) বলেন, মানুষ জিকির করতে করতে একটা সময় এমন হয় যে, তার মুখ বন্ধ কিন্তু শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জিকিরের কারণে নড়াচড়া করতে থাকে। তাকে মূলত কাছরাতে জিকির বা অধিক জিকির বলা হয়ে থাকে। তাই তো বুজুর্গরা বলে থাকেন, বুজুর্গদের সোহবতে থেকে তাদের খিদমত করে সাহাবায় কেরামের মুজাহাদার অনুকরণ করে নবীর ভালোবাসায় তাঁর তরিকায় চলতে পারলে এই ইহসান অতি সহজে হাসিল হয়। এ ধরনের গুণের অধিকারী মানুষ থেকে আসল তাকওয়া প্রকাশ পায়। তাকওয়া ও বিনয় হচ্ছে অন্তরের আমল, অন্তর পরিষ্কার না হলে আসল তাকওয়া ও বিনয় পাওয়া যায় না। আল্লাহর আজাবের ভয়ে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার নাম হলো তাকওয়া। গুনাহ করা ও তা থেকে বেঁচে থাকার প্রবণতা অন্তর থেকে আসে। অন্তরের চাহিদার মাধ্যমে গুনাহ প্রকাশ পায়। আবার অন্তরের চাহিদার মাধ্যমে ইবাদত প্রকাশ পায়। অন্তরে প্রবল চাপের সৃষ্টি না হলে কষ্টের সময় ইবাদত করা যায় না। তেমনি তাকওয়া ও বিনয় সৃষ্টি হওয়ার জন্য স্বচ্ছ ও পবিত্র অন্তর হওয়া জরুরি। পার্থিব মোহ ও গুনাহ দ্বারা জর্জরিত অন্তরে তাকওয়া ও আল্লাহর ভয় সৃষ্টি হয় না। হাদিস শরিফে আছে, গুনাহের দ্বারা অন্তর ময়লাযুক্ত হয়। আর আল্লাহর জিকির দ্বারা অন্তর ময়লামুক্ত হয়। আল্লাহতায়ালা বান্দাকে অন্তর পবিত্র রাখার আদেশ করেছেন। তাকওয়ার কারণে সৃষ্টিকুলের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব আমাদের প্রিয়নবী হজরত  মুহাম্মদ (সা.) উন্নত চরিত্রের অধিকারীর স্বীকৃতি পেয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে, আপনি তো উন্নত চরিত্রের অধিকারী। (সূরা কলম : আয়াত : ৪) অর্থাৎ আপনি তাকওয়া ও বিনয়সহ সব ধরনের উত্তম চরিত্রের অধিকারী হয়েছেন। কাফেরদের সমাজেও তিনি আল-আমিন ও বিশ্বাসী উপাধি পেয়েছেন। এখন চিন্তার বিষয় হলো, আম্বিয়ায় কেরাম ছাড়া অন্য মানুষ যাদের অন্তরে শয়তানের ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষমতা রয়েছে তাদের কী হবে? তাদের জন্য রসুল (সা.) বলেছেন, শয়তানের ধোঁকা অথবা গুনাহ করার দ্বারা অন্তরে যে অন্ধকার ও ক্ষত তৈরি হবে, বেশি বেশি আল্লাহর নামের জিকির করার দ্বারা তা দূর হবে। কারণ অন্তর পরিষ্কার করার বস্তু হচ্ছে আল্লাহর নামের জিকির। নবীর তরিকায় যারা বেশি বেশি জিকির করেছেন তাঁদের অন্তর পরিষ্কার হয়েছে, তাকওয়া ও বিনয়ের ঘটনা তাঁদের কাছ থেকে বেশি পাওয়া গেছে। সমাজে তাঁরা মুত্তাকি, ওলি, বুজুর্গ ও বিভিন্ন উত্তম উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। নবী (সা.)-এর পরে তাদের ওপরেই দীনের বিশাল গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। আল্লাহতায়ালা তাঁদের দ্বারা হেদায়েতের খিদমত নিয়েছেন।  হে আল্লাহ! আমাদের রজব ও শাবান মাসে বরকত দান কর এবং এই বরকত পবিত্র রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দাও।  আমিন।

লেখক : মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও খতিব বারিধারা, ঢাকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর