বুধবার, ৫ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

চিকন আলীরাই ফাঁসে!

আলম রায়হান

চিকন আলীরাই ফাঁসে!

একটি সুসংবাদ হচ্ছে, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের বাড়িঘরে আগুন দেওয়ার ঘটনায় দুজন চিহ্নিত হয়েছে। এ ঘটনায় আমার মনে পড়ছে, রাজাকার চিকন আলীর কথা। সে সময় বাঘা বাঘা রাজাকার ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল, ফাঁসির আদেশ হয়েছে চিকন আলীর। আমার ভীরু ধারণা, সাঁওতালপল্লীর ঘটনায় আসলে পুলিশের দুই চিকন আলীর ওপর দিয়ে কর্তাদের দায় পার করার প্রক্রিয়া অনেকটাই সফল হতে যাচ্ছে। 

গোবিন্দগঞ্জে উচ্ছেদের সময় সাঁওতালদের বাড়িঘরে আগুন দেওয়ার ঘটনায় দায়ী দুই পুলিশ সদস্য হচ্ছেন সে সময়কার গাইবান্ধা ডিবির এসআই মাহবুবুর রহমান ও গাইবান্ধা পুলিশ লাইনসের কনস্টেবল মো. সাজ্জাদ হোসেন।  পুলিশের তিন সদস্যের কমিটির অনুসন্ধান প্রতিবেদন অনুসারে দুজন অগ্নিসংযোগ করেছেন বলে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তাদের সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। এ তথ্যও জানানো হয়েছে পুলিশের আরেকটি প্রতিবেদনে। বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চে ৯ মার্চ রাষ্ট্রপক্ষ এসব প্রতিবেদন দাখিল করে। হাই কোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়নের অগ্রগতি জানিয়ে পুলিশের আইজি ও রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি পৃথক দুটি প্রতিবেদন দেন। এর সঙ্গে অগ্নিসংযোগকারীদের চিহ্নিত করতে গঠিত পুলিশের তিন সদস্যের অনুসন্ধান কমিটির প্রতিবেদনও দাখিল করা হয়। সংক্ষিপ্ত শুনানি শেষে এসব নথিভুক্ত করার আদেশ দেয় আদালত।

মাননীয় আদালত সঠিক কাজই করেছে এবং কঠিন বাস্তবতা তুলে ধরেছে শুনানিকালে। আদালত বলে, মিডিয়া যদি সোচ্চার না হতো, তাহলে ওই ঘটনা এভাবে আসত না। আল-জাজিরা প্রচার না করলে বিষয়টি স্পষ্ট হতো না। দেশীয় গণমাধ্যমও সোচ্চারভাবে প্রচার করেছে।

আইনের রক্ষক হিসেবে আদালত সঠিক কাজ করেছে। বিদেশি মিডিয়া আল জাজিরার সূত্র ধরে দেশি গণমাধ্যম সীমিত হলেও ভূমিকা পালন করেছে— এটি মানতেই হবে। কিন্তু রাষ্ট্রের কাছে সাধারণের প্রশ্ন হতে পারে, প্রকাশ্য দিবালোকে এত বড় একটি অপকর্ম কি কেবল একজন সাধারণ এসআই এবং অতি সাধারণ একজন কনস্টেবলের পক্ষে সম্ভব? নাকি আদালতের হাত থেকে বাঁচার কৌশল হিসেবে দুজনকে কেবল স্কেপ গোট বানানো হয়েছে; যে বিষয়টিকে অধিকতর সহজ ভাষায় বলা হয়, বলির পাঁঠা! ওই দিনের ‘অপারেশনে’ অনেক পুলিশ সদস্য ছিলেন; তারা আবার ছিলেন তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে। যে বাহিনী কথায় কথায় উপরের আদেশ-নির্দেশের দোহাই দেয় সেই বাহিনীর অপারেশন চলাকালে অপরাধমূলক ঘটনার জন্য কীভাবে কেবল চুনোপুঁটি লেবেলের সদস্য দায়ী হয়। গত বছরের ৬ নভেম্বর গোবিন্দগঞ্জে রংপুর চিনিকলের জমিতে আখ কাটাকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারীদের সঙ্গে সাঁওতালদের সংঘর্ষ হয়। উপজেলার সাপমারা ইউনিয়নের সাহেবগঞ্জ এলাকায় ওই সংঘর্ষে পুলিশসহ উভয়পক্ষের অন্তত ২০ জন আহত ও কয়েকজন সাঁওতাল নিহত হন। সাঁওতালদের ঘরে আগুন দেওয়ার ঘটনাও ঘটে।

এ ঘটনার পর এক সংবাদ সম্মেলনে শিল্পসচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেছিলেন, ভূমি বিরোধের জের ধরে চিনিকল কর্মীদের সঙ্গে সাঁওতালদের সংঘর্ষের সময় হতাহতের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দায়ী নয়। তিনি আরও বলেছিলেন, বিরোধপূর্ণ জমি নিয়ে চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারী ও সাঁওতালদের সংঘর্ষ থামাতে পুলিশ আইন প্রয়োগ করেছে। তিনি দাবি করেন, সেদিন ‘অবৈধ দখলকারীদের’ তীর-ধনুকের আঘাতে ১০-১২ জন পুলিশ সদস্য আহত হওয়ায় পরিস্থিতি খারাপের দিকে যায়। পুলিশের গায়ে যখন আঘাত হয় তখন বিষয়টা আরেকটু সেনসিটিভ হয়ে গেছে। কিন্তু মাসখানেকের মধ্যে থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়ার মতো গোবিন্দগঞ্জের সত্য প্রকাশ পেয়ে যায় বিদেশি মিডিয়ার কল্যাণে। গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসা একটি ফুটেজে সত্য উন্মোচিত হয়; বিষয়টি গড়ায় আদালত পর্যন্ত। সাঁওতালদের ঘরে আগুন দেওয়ার দৃশ্য নিয়ে শুরু হয় নতুন করে আলোচনা।

গোবিন্দগঞ্জে ঘটনার দিন চামগাড়ি বিল এলাকায় বিভিন্ন পদমর্যাদার ৮৫ জন পুলিশ সদস্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে ছিলেন। তাদের মধ্যে ৫৮ জনকে প্রত্যাহারসহ ৭২ জনকে গাইবান্ধা থেকে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। অপর ১৩ জনের মধ্যে একজন অবসর প্রস্তুতিকালীন ছুটিতে আছেন। বাকি ১২ জন অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিলের আগে অন্যত্র বদলি হন। আদালতে দাখিল করা একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাইবান্ধা জেলার গোয়েন্দা শাখার এসআই মাহবুবুর রহমান ও গাইবান্ধা পুলিশ লাইনসের কনস্টেবল মো. সাজ্জাদ হোসেন অগ্নিসংযোগ করেছেন বলে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। তাদের চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। অন্য কোনো পুলিশ সদস্য কিংবা পুলিশ ছাড়া কেউ অগ্নিসংযোগের সঙ্গে জড়িত আছে বলে প্রতীয়মান হলেও তাদের এখনো চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। তবে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় করা রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নির্দেশনা অনুসারে গত ১৬ নভেম্বর গোবিন্দগঞ্জ থানায় করা মামলা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তদন্ত করছে। ভবিষ্যতে এ ঘটনায় জড়িত অপরাধীদের শনাক্ত করা সম্ভব হলে তা আদালতকে জানানো হবে বলে জানিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ। শুরুতেই বলেছি, সাঁওতালপল্লীর ঘটনায় দুই সাধারণ পুলিশ সদস্য চিহ্নিত হওয়া এবং শাস্তির জন্য প্রাথমিকভাবে বাছাই হওয়ার ঘটনায় আমার মনে পড়ে রাজাকার চিকন আলীর কথা। দালাল আইনে প্রথম মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয় রাজাকার চিকন আলী। কুষ্টিয়ার দায়রা জজ ও বিশেষ ট্রাইব্যুনালের সদস্য রবীন্দ্র কুমার বিশ্বাস রাজাকার চিকন আলীর বিরুদ্ধে এ রায় দেন। কুষ্টিয়ার মিরপুর গ্রামের চিকন আলীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের ১৯ অক্টোবর একই গ্রামের ইয়াজউদ্দিনকে গুলি করে হত্যার অভিযোগ ছিল। পরে উচ্চ আদালতে সাজা কমিয়ে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আট বছর চার মাস জেল খাটার পর দালাল আইন বাতিলের সুযোগে চিকন আলী ছাড়া পায়। কারা মুক্তির পর নিরক্ষর, হতদরিদ্র চিকন আলী অভাবের তাড়নায় চুরি করে পেট চালাত। কিন্তু বারবার ধরা পড়ায় এক পর্যায়ে সে চুরি করা ছেড়ে দেয়।  শেষ জীবনে চিকন আলী আঁখের ব্যবসা করে জীবিকানির্বাহ করতেন। যতদূর জানা যায়, চিকন আলী সাধারণ রাজাকার ছিল, রাজাকারদের কমান্ডার ছিল না। স্বাধীনতার বিপক্ষে কমান্ডাররা বহু বছর ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকেছে। যদিও অনেকেরই শেষ রক্ষা হয়নি, অনেকেই সাজা পেয়েছেন অনেক পরে হলেও মানবতাবিরোধী অপরাধে।  গোবিন্দগঞ্জের ঘটনায় কমান্ডারদের সাজা কী কোনো দিন হবে?     লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর