বৃহস্পতিবার, ৬ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

কেন আত্মঘাতী বোমারু হতে ইচ্ছে করে

তসলিমা নাসরিন

কেন আত্মঘাতী বোমারু হতে ইচ্ছে করে

যখন বাংলাদেশের আত্মঘাতী বোমারুর কথা ভাবছিলাম, তখনি শুনি সেন্ট পিটার্সবুর্গের এক মেট্রো স্টেশনে আকবরজন জালিলভ নামের ২২ বছরের এক যুবক আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ১৪ জনকে নিহত আর ৫০ জনকে আহত করেছে। মনে আছে ১৯৯৪ সালে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হওয়ার পর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যখন আমন্ত্রিত হচ্ছিলাম, অনেকে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, তোমাদের দেশে কি সুইসাইড বোম্বার আছে? আমি অনেকক্ষণ হতবাক তাকিয়ে থেকে মাথা নাড়তাম। না নেই। ওরা স্বস্তির শ্বাস ফেলতো। আজ আর আমি বলতে পারছি না যে বাংলাদেশে আত্মঘাতী বোমারুর অস্তিত্ব নেই।

কী ঘটছে এই পৃথিবীতে? কেন এত মানুষ নিজেকে হত্যা করছে শুধু অন্যদের হত্যা করার জন্য? আত্মঘাতী হামলা নতুন কিছু নয়। তবে এককালে খুব কম ঘটতো এই হামলা। ঘটতো মূলত যুদ্ধের সময়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের কামিকাজে বৈমানিকেরা করেছেন আত্মঘাতী হামলা। মরবেন জেনেও শত্রুদের জাহাজের ওপর নিজের বোমা ভরা বিমান ছুড়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন।

কিন্তু আশির দশক থেকে আত্মঘাতী হামলা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়েছে। গত তিরিশ বছরে প্রায় চল্লিশটি দেশে প্রায় পাঁচ হাজারের মতো আত্মঘাতী হামলা হয়েছে, ওতে নিহত হয়েছে প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ। আশির দশকে বছরে ৩টি হামলা হতো, নব্বই দশকে মাসে ১টি, ২০০১ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত সপ্তাহে ১টি, আর ২০০৩ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত দিনে ১টি। মূলত আফগানিস্তান, ইরাক, ইসরাইল, প্যালেস্টাইন, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কায় হামলা হয়েছে। তালিকায় এখন বাংলাদেশ যোগ হলো। জাতীয়তাবাদ এবং জিহাদ এই দুটোই আত্মঘাতী সন্ত্রাসী হামলার পেছনে কাজ করছে। নিজের দেশকে বহিরাগত শত্রু থেকে মুক্ত করার জন্য অনেকে আত্মঘাতী সন্ত্রাসী হামলা করেছে। এটির কারণ জাতীয়তাবাদ। তরুণ-তরুণীদের মগজ ধোলাই করে বিশ্বাস করানো হয়েছে যে জিহাদ করতে গিয়ে কারও মৃত্যু হলে তারা জীবন ভর নামাজ রোজা ইবাদত ইত্যাদি করা ছাড়াই, আখেরাতে কোনও রকম বিচার ছাড়াই, বেহেস্তবাসী হওয়ার সুযোগ পাবে। জিহাদিরা বিধর্মীদের, ইসলামের সমালোচক এবং নিন্দুকদের এবং মুসলমান হয়েও অনৈসলামিক কাজ যারা করে, তাদেরও হত্যা করে। ১৪০০ বছর আগে যা ঘটেছে, তা এখন যে করেই হোক, আত্মহত্যা করে হলেও ঘটাতে হবে বলে অনেকের বিশ্বাস। এই ধারণা যে করেই হোক, প্রচুর মুসলমানের মধ্যে ঢুকে গেছে। এটা অনেকটা ভাইরাসের মতোই। সংক্রামক রোগের মতো।

ভারতের একজন কৃষক খরার কারণে ফসল না হওয়ায় আর ধারদেনা বেড়ে যাওয়ায় আত্মহত্যা করেছে, অমনি তার দেখাদেখি এক এক করে লক্ষ কৃষক আত্মহত্যা করেছে। আত্মঘাতী বোমা হামলায় শত্রু হত্যা করতে পারলে সরাসরি বেহেস্তে হাওয়ার সুযোগ জুটবে— এই তথ্যটি গভীরভাবে বিশ্বাস করে একজন আত্মঘাতী বোমারু হলো, এক এক করে তারপর অনেকেই হলো। একজন মৃত্যু ভয় কাটিয়ে উঠছে দেখলে অনেকেই ভয়টা কাটিয়ে ওঠে। কেউ একজন শহীদ হলো, আরো লোক শহীদ হওয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। ধর্মীয় বিশ্বাসের জন্য কেউ শহীদ হতে চাইলে হতেই পারে। কিন্তু মুশকিলটা হচ্ছে যখন নিরীহ মানুষদের সঙ্গে নিয়ে মরতে চায় তারা। আরো ভয়ঙ্কর, যখন শিশুদের গায়ে আত্মঘাতী বোমা বেঁধে বাবা মা’ই ওদের মরতে বলে। সেদিন সিরিয়ার আট আর দশ বছরের দুটো শিশুকন্যাকে এভাবেই সাজিয়ে দিয়েছে বাবা-মা, দামাস্কাসের পুলিশ-স্টেশনে ঢুকে যেন ওরা বোমার বোতামে চাপ দেয়। শিশুদের গালে চুমু খেয়ে শেষ বিদেয় জানিয়েছে তারা। বলেছে, বেহেস্তে গিয়ে দেখা হবে তাদের। এরা কি সত্যি বাবা-মা? এরা সত্যি বাবা-মা। এরা বিশ্বাস করে জিহাদে যাদেরই মৃত্যু হচ্ছে, তাদের জন্য বেহেস্ত নিশ্চিত। বাংলাদেশেও সম্প্রতি আত্মঘাতী বোমারুদের দেখেছি নিজের সন্তানদের হত্যা করতে তারা সামান্যও দ্বিধা করে না। ধর্মীয় উন্মাদনা এদের নিষ্ঠুর, অবিবেচক, হিংস্র, নৃশংস, লোভী, স্বার্থপর, খুনি বানিয়েছে। ধর্মের উত্পত্তির কারণ যাই হোক না কেন, মানুষ ধর্মকে মানবিক হিসেবেই দেখতে চায়। কিন্তু দিন দিন যেন ধর্মকে খুন-খারাবির ধর্ম হিসেবে দেখছে কিছু মানুষ। বেশ কিছু আত্মঘাতী বোমারু তরুণ তো বলেই ফেলেছে ইহকালের ইতি ঘটিয়ে পরকালে পরমানন্দে বেহেস্তের সুন্দরী হুরদের সান্নিধ্য পেতে যাচ্ছে। একটা অদ্ভুত রূপকথার জগৎ তারা কল্পনা করে নেয়। অনেকে বলে যারা আত্মহত্যা করে অন্যকে হত্যা করার উদ্দেশে, যারা বিশ্বাস করে তারা এই অপকর্মটি করলে পুরস্কৃত হবে, তারা মানসিক রোগী। আমার কিন্তু ওদের মানসিক রোগী বলে মনে হয় না। মানসিক হাসপাতালের যারা রোগী, তারা কিন্তু কেউ ধর্মান্ধ নয়, ধর্মের কারণে কাউকে খুনও করে না।

 

 

এই খুনোখুনিটা বিশ্বাসের কারণে ঘটে। যুক্তিবুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে কিছুকে বিশ্বাস করলে বিপদ বাধে। ১৪০০ বছর আগে যুদ্ধ দরকার ছিল বলে যুদ্ধ এখনো দরকার, তা তো নয়। এখন পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম ইসলাম, ইসলাম বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে সবচেয়ে দ্রুতগতিতে। ইসলামকে শত্রুর হাত থেকে বাঁচাতে হবে, এই সংকল্প করার কোনও কারণ নেই। পিউ রিসার্চ বলেছে ২০৫০ সালের দিকে ইসলাম পৃথিবীর বৃহত্তম ধর্ম হয়ে উঠবে। ইসলাম নিয়ে দুশ্চিন্তা করার মুসলমানদের কোনও কারণ নেই। পৃথিবীকে দারুল ইসলাম বানানোর জন্য এখনই জিহাদে নামলে এ লাভের চেয়ে বরং ক্ষতিই করবে। দুনিয়াতে মুসলিমদের নিয়ে অনেকের এখন ভয়। ভয় জাগিয়ে সামনে এগোনোর চেয়ে ভালোবেসে সামনে এগোনো নিশ্চয়ই ভালো। মন্দ কাজ করে অর্থাৎ খুন খারাবি করে বেহেস্তে যাওয়ার চেয়ে ভালো কাজ করে, মানুষের উপকার করে বেহেস্তে যাওয়া নিশ্চয় অনেক বেশি স্বস্তিকর। ইসলামকে একটি খুনের নিষ্ঠুরতার বর্বরতার ধর্ম হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করছে সন্ত্রাসীরা। ইসলামের যারা ভালো চায়, তাদের সবার আগে যে কাজটি করতে হবে, তা হলো, এই সন্ত্রাসীদের হাত থেকে ইসলামকে বাঁচাতে হবে। নাস্তিকেরা ধর্মকে ধ্বংস করে না, করতে পারে না। ধর্মের সর্বনাশ করে ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীরা।

বাংলাদেশের মতো শান্ত স্নিগ্ধ ধর্মনিরপেক্ষ দেশটি উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে ধর্মান্ধতে, জঙ্গিতে। এই জঙ্গিদের যারাই তৈরি করেছে, কোনও ভালো উদ্দেশে করেনি। তারা দেশের এবং দেশের মানুষের স্বাধীনতা এবং স্বকীয়তায় বিশ্বাস করে না। যত বেশি ধর্মান্ধ হয়েছে মানুষ, তত বেশি সন্ত্রাসী হয়েছে। সন্ত্রাসের চর্চা চলতে থাকলে মানুষ বেপরোয়া হয়ে আত্মঘাতী সন্ত্রাসের পথে পা বাড়ায়।

মানুষের অনিষ্ট করে ধর্মের সেবা করার যে নিয়ম শুরু হয়েছে, তা শুরুতেই শেষ না করলে আমরা সব মরে শেষ হয়ে যাবো, পৃথিবীতে শুধু বেঁচে থাকবে দজ্জালের মতো কিছু খুনি। আমাদের কি তেমন এক পৃথিবীর দিকে এই পৃথিবীকে যেতে দেওয়া উচিত? রুখে দাঁড়াবার সময় কি এখনও আসেনি?

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

সর্বশেষ খবর