বৃহস্পতিবার, ৬ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

নদীর সুখ-দুঃখ

সাইফুর রহমান

নদীর সুখ-দুঃখ

ক’দিন আগে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছিলাম সড়কপথে। ঢাকায় জন্ম ও বসাবস হলেও নাড়ির টানে প্রতিবছর বার বার ছুটে যাই গ্রামের বাড়িতে। কোনো কাজে নয় আমার ভালো লাগার জন্য। গ্রাম-নদী-বিল-গ্রামের মানুষ জনপদ, মেঠোপথ, জঙ্গল, পাহাড়, সমুদ্র আমার অতিপ্রিয়। আমার পৈতৃক নিবাস পাবনার সুজানগরে। গাড়ির ড্রাইভারকে বললাম, যমুনা সেতু নয় এবার পাবনা যাওয়া যাক আরিচা-গোয়ালন্দ তারপর ধাওয়াপাড়া ফেরিঘাট থেকে পদ্মা পার হয়ে ওপাশে নাজিরগঞ্জ তারপর সুজানগর। প্রমত্ত পদ্মার কিছুটা রূপ আরিচা থেকে ফরিদপুরের গোয়ালন্দ পর্যন্ত যাওয়ার পথে চোখে পড়ল তবে এর অন্যতম কারণ বোধহয় যমুনা নদীও এখানে এসে মিশেছে পদ্মার সঙ্গে। কিন্তু পদ্মার করুণ দশা চোখে পড়ল ধাওয়াপাড়া নৌঘাট থেকে ফেরিতে ওঠার পর। ফেরির ডেকে দাঁড়িয়ে নদীবক্ষে দৃষ্টি দিতেই চোখে পড়ল অনেকটা নিশ্চল নদীর জলে বিক্ষিপ্তভাবে ভাসছে হরিদ্রাভ পুরীষ। আরিচা থেকে গোয়ালন্দ পর্যন্ত নৌপথটুকুতে আমার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছিন্ন পত্রাবলীর দু-চারটে লাইন মনে পড়ে গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ তার ছিন্ন পত্রাবলীতে লিখেছেন— ‘এই নদীর উপরে, মাঠের উপরে, গ্রামের উপরে সন্ধেটা কী চমৎকার, কী প্রকাণ্ড, কী প্রশস্ত, কী অগাধ সে কেবল স্তব্ধ হয়ে অনুভব করা যায়, কিন্তু ব্যক্ত করতে গেলেই চঞ্চল হয়ে উঠতে হয়।’ কিন্তু পদ্মার এই অংশ দেখে আমার নিদারুণ আশা ভঙ্গ হলো। রবীন্দ্রনাথ আজ বেঁচে থাকলে হয়তো বিদীর্ণ হতো তার মানসপট। এ যেন ভাবতেও কষ্ট হচ্ছিল।

পদ্মার করাল গ্রাসে কত শত একর ভূমি হয়েছে নিশ্চিহ্ন। কত মানুষকে ভিটে ছাড়া করেছে এককালে এ নদীটি। আজ সেজন্যই সম্ভবত মানুষের কুদৃষ্টি পড়ে কী হাল হয়েছে নদীটির। অথচ পদ্মা নামক এই নদীটির আরেকটি নাম-ই তো কীর্তিনাশা। নবাব সিরাজউদ্দৌলার সময়কার বণিক সেই সঙ্গে ঢাকা-ফরিদপুর ও বরিশাল অঞ্চলের খ্যাতনামা ভূস্বামী রাজা রায়বল্লভের অনেক সৌধ ও কীর্তি ধ্বংস করেছিল বলে রাজা রায়বল্লভ এ নদীটির নামকরণ করেছিলেন কীর্তিনাশা। সিংহ বুড়ো হয়ে গেলে যেমন নবীন সিংহগুলো বুড়ো সেই সিংহকে তাড়িয়ে দেয় তাদের অঞ্চল থেকে। সেই সঙ্গে শক্তিমান সিংহগুলো মূত্র নির্গত করে এর নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের সীমানা নির্ধারণ করে রাখে যাতে করে দুর্বল ও শিকারে অক্ষম বৃদ্ধ সেই সিংহটি শক্তিমানদের অঞ্চলে ঢুকতে না পারে। আজ পদ্মারও যেন ঠিক সেরকম অবস্থা। তবে আজকের পদ্মার এমন রুগ্ন ও বয়োবৃদ্ধ অবস্থার জন্য দায়ী ফারাক্কা বাঁধ। তা না হলে যৌবন বয়সেই কেন নদীটি এমন বুড়িয়ে যাবে। পদ্মা নামক এই নদীটির জন্ম কিন্তু খুব বেশি দিন আগে নয়। আশ্চর্যের মতো শোনাচ্ছে তাই না! বিস্ময়কর শোনালেও এটাই সত্য। হিমালয় পর্বত থেকে উত্পন্ন হয়ে গঙ্গা নদী দীর্ঘ পূর্বমুখী যাত্রার শেষে ডান পাশে রাজমহল পাহাড়কে রেখে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করে। রাজমহল পেরিয়ে ৭২ কিলোমিটার এলে ফারাক্কা ব্যারাজ। সেখান থেকে ভাটির দিকে ৪০ কিলোমিটার এগিয়ে গঙ্গা দু’ভাগ হয়েছে। ভাগীরথী নামের একটি ধারা (নদীয়া জেলার মায়াপুরে জলঙ্গীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার পর থেকে মোহনা পর্যন্ত যার নাম হুগলি) পশ্চিমবঙ্গের মধ্য দিয়ে প্রায় ৫০০ কিলোমিটার পথ বেয়ে দক্ষিণবাহিনী হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। পদ্মা নামের অন্য ধারাটি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত ধরে প্রায় ৬০ কিলোমিটার গিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে। সেখান থেকে ১৩০ কিলোমিটার গিয়ে যমুনা (ব্রহ্মপুত্র) ও আরও ১০০ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে চাঁদপুরের কাছে মেঘনার ধারার সঙ্গে মিলে একত্রে ১২৫ কিলোমিটার বয়ে পৌঁছেছে বঙ্গোপসাগরে।

পণ্ডিতদের অভিমত, পদ্মা এক সময় গৌড় দিয়ে বইত। বিশিষ্ট ইংরেজ ঐতিহাসিক ও জরিপবিদ মেজর হার্স্ট মনে করেন ১৫০৫ সালে ভয়ানক এক ভূমিকম্পের কারণে পদ্মা গৌড় থেকে দক্ষিণে সরে যায়। গৌড় হচ্ছে বাংলাদেশে একটি প্রাচীন জনপদ অধুনা মুর্শিদাবাদ মালদহ প্রভৃতি অঞ্চল ছিল গৌড়ের অন্তর্গত। মেজর রেলন্ড (ইতিহাসবিদ ও ভূ-জরিপবিদ) ও মেজর হার্স্ট দুজনেই মনে করেন এক সময় পদ্মা নাটোর অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে এসে মিশেছিল। কিন্তু ১৫০৫ সালের ভূমিকম্পে সেটি দক্ষিণে সরে এসে প্রথমে রাজশাহী পরে কুষ্টিয়া, ঈশ্বরদী ও পাবনার রাজবাড়ী প্রভৃতি জেলার পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে যমুনায় গিয়ে মিশেছে। এক সময় পদ্মার শাখা নদীগুলো যেমন, নারদ নদ, আত্রাই, মধুমতি, আড়িয়াল খাঁ প্রভৃতি নদী ছিল ভীষণ রকম যৌবনবতী ও প্রাণবন্ত কিন্তু সেসব এখন শুধুই অতীত। পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় জন্মেছিলেন বাংলাদেশের মাদারীপুরে। আর মাদারীপুরের একটি বিখ্যাত নদী আড়িয়াল খাঁ। সুনীল তার ‘আমাদের ছোট নদী’ বইটিতে তার শৈশব ও কৈশোরের অনেক স্মৃতিচারণ করেছেন এই আড়িয়াল খাঁ নদীটিকে ঘিরে। তিনি লিখেছেন— “আমাদের সময়ে প্রধান দ্রষ্টব্য ছিল আড়িয়াল খাঁ নদী। কেউ বলত আড়িয়েল, কেউ বলত আড়িয়াল। এপার থেকে ওপার দেখা যেত না, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? তবে শীত আর বর্ষার তফাত ছিল অনেকখানি। বর্ষাকালেই ফুটে উঠত তার প্রকৃত রুদ্র রূপ। প্রচণ্ড জলের প্রবাহের মধ্যে যেন শোনা যেত একটা গর্জন! মাঝে মাঝে ঝপাস ঝপাস করে ভেঙে পড়ত পারের মাটি। একটু-আধটু মাটি নয়, অনেকখানি। একটু আগে দেখলাম, নদীর ধারে একটা আমগাছ, হঠাৎ লাফিয়ে লাফিয়ে উঠতে লাগল ঢেউ। ওই আমগাছটার ওপর নদীর খুব লোভ হয়েছে। এরপর ওই আমগাছটাকে বাঁচানোর সাধ্য কারোর নেই। ঠিক যেন অতিকায় এক জলজ প্রাণীর মতো ঢেউ সেই গাছটাকে টেনে নিয়ে গেল, নদীতে ওলটপালট খেতে খেতে সেই গাছটা চলে গেল কোথায়। সঙ্গে চলে গেল কয়েকটা পাখির বাসা। পাখিরা করুণভাবে ডেকে ডেকে ঘুরতে লাগল জলের ওপর। হয়তো সেই গাছের বাসায় তাদের ছানা-পোনারা রয়ে গিয়েছিল।

ঢাকায় একবার শুধু একজন বলেছিল, তুমি আড়িয়াল খাঁ নদীর কথা এত বল। সে নদী তো আমি গত বছর দেখেছি। ওরকম দুর্দান্ত কিছুই না। বেশি চওড়াও নয়। মাঝখানে চর পড়ে গেছে, কেমন যেন মরা মরা ভাব। তুমি এখন দেখলে চিনতেই পারবে না। আমি আর দেখতেও চাই না। বাল্যকালের দেখা ছবিটাই থেকে যাক মনের মধ্যে।” আমার মাঝে মাঝে মনে হয় নদী কী শুধুই একটি নদী। আসলে তো তা নয়। নদী মানে মানুষের অস্তিত্ব, সমাজ, সভ্যতা, সংস্কৃতি, সাহিত্য সর্বোপরি সবকিছু। মানুষের জন্ম তো পানি থেকেই। সমস্ত সভ্যতাই যেহেতু নদীকে কেন্দ্র করে সেহেতু মানুষ তার বেঁচে বর্তে থাকার প্রথম অবলম্বন নিশ্চয়ই মৎস্য শিকারের মাধ্যমেই শুরু করেছিল।

এ জন্যই বোধকরি এখন থেকে চল্লিশ হাজার বছর আগে ব্যবহৃত হাড়ের তৈরি মাছ ধরার বড়শি আবিষ্কৃত হয়েছে। পৃথিবীর সমস্ত সভ্যতাই নদীকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছিল। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যেতে পারে মেসোপটেমিয়া, মিসরীয় কিংবা সিন্ধু সভ্যতা। মেসোপটেমিয়া সভ্যতা গড়ে উঠেছিল ইউফ্রেতিস আর তাইগ্রিস নামে দুটি নদের মধ্যবর্তী দোআব অঞ্চলে। আশপাশের ভূখণ্ডে বিস্তৃত ছিল দেশটি। ইউফ্রেতিস-তাইগ্রিস অঞ্চলে ‘মেসোপটেমিয়া’ নামটা দিলেছিলেন গ্রিক ঐতিহাসিকরা। ওই অঞ্চলের অধিবাসীরা কিন্তু নিজেরা কখনো ও-নাম ব্যবহার করেনি। মেসোপটেমিয়া নামটি কিন্তু বেশ অদ্ভুত। বাংলা করলে এর মানে দাঁড়ায়- দ্বি-নদমধ্যা অর্থাৎ দু’নদের মধ্যখানে অবস্থিত এমন দেশ। পঞ্চনদের (সুতলেজ, বিয়াস, রবি, চেনাব, ঝিলাম) সমাহারে যেমন ‘পাঞ্জাব’ নামের উদ্ভব, ঠিক তেমনই। তবে পাঞ্জাব নামটি ফার্সি। পাঞ্জি মানে পাঁচ আর আব মানে পানি বা নদী অর্থাৎ পাঁচ নদীর সমাহার বলেই ভারত ও পাকিস্তানে ওই নির্দিষ্ট অঞ্চলের নাম পাঞ্জাব। তবে মহাবীর আলেকজান্ডার যখন ভারত জয় করেছিলেন তখন গ্রিকরাও কিন্তু পাঞ্জাবকে তাদের মতো করে একটি গ্রিক নাম দিয়েছিলেন। সেই নামটিও অনেকটা মেসোপটেমিয়া নামের মতোই। সেই নামটি হলো- পেন্টাপটেমিয়া, অর্থাৎ পাঁচ নদীর দেশ। কিন্তু পরবর্তীকালে পার্সিদের দেওয়া নামটি-ই ইতিহাসে টিকে যায়। খ্রিস্টের জন্মের প্রায় তিন হাজার বছর আগে সিন্ধু সভ্যতাও (হরপ্পা-মাহেঞ্জদার) কিন্তু গড়ে উঠেছিল ইন্ডাস (সিন্ধু) নদীর তীরবর্তী অঞ্চলগুলোতে। ইন্ডিয়া নামটির উত্পত্তিও এই ইন্ডাস নামটি থেকেই। ভারতের আর একটি নাম যে ইন্ডিয়া এর পেছনের ইতিহাসটি ছোট করে বলতে গিয়ে বলতে হয় ৩২৬ খ্রিস্টপূর্বে আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের সময় গ্রিকের লোকেরা যেহেতু সিন্ধু নামটি ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারত না সেহেতু আলেকজান্ডার Sindঁ শব্দটি থেকে S বর্ণমালাটি বাদ দিয়ে উচ্চারণ করত Indu এবং নামটি আরও সহজকরণ করতে Indu-কে তারা তাদের মতো করে উচ্চারণ করতে শুরু করে Indus বলে। পরবর্তীতে সিন্ধু উপকূলবর্তী অঞ্চল বোঝাতে তারা ব্যবহার করত Indus Valley। এভাবেই India নামটির উত্পত্তি। সেই সঙ্গে হিন্দুস্তান নামটিও এসেছে নদীর নাম থেকেই। হিন্দুদের পুরাণ ঋগবেদ এ ভারতীয় উপমহাদেশের এই অঞ্চলকে চিহ্নিত করতে ব্যবহৃত হয়েছে ‘সপ্ত সিন্ধাভা’ শব্দটি। যার অর্থ হচ্ছে- সাত নদীর দেশ।

আলেকজান্ডারের ভারত জয় করার আগে আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও ভারতীয় এ অঞ্চলগুলো এক সময় পার্সিয়ান সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৫১৫ অব্দে পারস্য রাজা প্রথম দারিউস ভারতীয় এ উপমহাদেশ তার সাম্রাজ্যভুক্ত করেছিলেন। এ অঞ্চলে বসবাসকারী অধিবাসীদের পারস্যের লোকেরা বলত- হিন্দুদের দেশ। এই হিন্দু নামটি এসেছিল সংস্কৃত নাম সিন্ধু থেকে। পার্সিরা সম্ভবত ‘ঝ’ বর্ণমালাটি সঠিকরূপে উচ্চারণ করতে সক্ষম ছিল না আর এ জন্যই তারা সিন্ধু না বলে বলত হিন্দু। ঠিক তদুপরি মিসরীয় সভ্যতাটিও গড়ে উঠেছিল নীল নদের তীরে এবং নীল নদকে কেন্দ্র করেই। এটা বোধকরি আমরা সবাই কমবেশি জানি। আমাদের ছোটবেলায় আমরা অনেকেই বাংলাদেশের অধিকাংশ নদ-নদীর যে জেল্লা-জৌলুস দেখেছি এখন তার ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই। খুব ছোটবেলায় সেটা সম্ভবত ১৯৮৪ কিংবা ৮৫ সাল হবে। গয়না নৌকোয় যাচ্ছিলাম বিক্রমপুরে আমার মায়ের বাবার বাড়ি। আমার মা খালাদের জন্ম ঢাকায় হলেও তাদের পৈতৃক ভিটেমাটি বিক্রমপুরের শ্রীনগরে। তো হয়েছে কি গয়না নৌকোটি যেই না ধলেশ্বরী নদীতে কেবল উঠেছে অমনি বড় বড় ঢেউয়ের কারণে শুরু হয়েছে প্রচণ্ড দুলুনি। আমরা যারা ছোট ছোট ছেলেপুলে তারা তো কেঁদে কেটে যা তা অবস্থা। কান্নাকাটি অবশ্য নদীতে ডুবে মরার জন্য নয়। শিশু আর ক্ষমতাসীনদের কখনো মৃত্যু ভয় থাকে না। এরা সব সময় ভাবে আমরা অমর। আসল ভয়টা হচ্ছিল নদীর ভিতর থেকে কিছুক্ষণ পর পর ভুসভুস করে ভেসে উঠছিল শুশুক। উপরে উঠে ডুব দেওয়ার সময় তাদের কালো মিশমিশে পৃষ্ঠটি শুধু আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম। আমরা যারা ছোট তাদের ধারণা নৌকাটি ডুবে গেলেই তো শুশুক মাছগুলো এসে আমাদের খেয়ে নেবে। অথচ আমরা যে কেউই সাঁতার জানি না সে বিষয়টি কিন্তু একেবারেই মাথায় আসেনি।

এক সময় বাংলাদেশের ওপর দিয়ে কমবেশি আটশর মতো নদী প্রবাহিত হতো। কিন্তু বেশিরভাগ নদীই এখন মরে গেছে। কোন কোনটি অর্ধমৃত। কোনটি আবার কর্কট রোগীর মতো ধুঁকে ধুঁকে এগিয়ে যাচ্ছে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে। আমাদের বোধশক্তিও যেন লোপ পাচ্ছে দিন দিন। নদী যে আমাদের জীবনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে রয়েছে সেই বোধটিই তো কখনো জন্মায়নি আমাদের। আর সেজন্য নদীখেকোদের উদরে চলে গেছে আমাদের নদীর অধিকাংশ অংশ। যত্রতত্র আমরা নির্মাণ করেছি নানাবিধ কল-কারখানা ফলে বর্জ্য গিয়ে নদীর পানির সঙ্গে মিশে সেই নদীটি এখন হয়ে উঠেছে অস্পৃশ্য। অথচ আমাদের নদীভিত্তিক জীবন ব্যবস্থার ফলে নদীকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে কতশত গান, কবিতা, গল্প-উপন্যাস। স্থানসংকুলানের কথা ভেবে শব্দের অক্ষরে সব কিছু হয়তো এখানে লিপিবদ্ধ করা সম্ভব নয় কিন্তু তারপরও বলতে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন মহাকাব্য ‘গিলগামেশ’ তো এক প্রকার তাইগ্রিস ও ইউফ্রেতিস নদী ও নদীর তটবর্তী মানুষ ও একজন নৃপতির উপকথা। ইতিহাসবিদদের ধারণা ‘গিলগামেশ’ নামের এই মহাকাব্য খ্রিস্টপূর্ব দুই হাজার বছর আগে রচিত। তখন তো কাগজের আবিষ্কার হয়নি তাই মেসোপটেমিয়ার অধিবাসীরা এঁটেল মাটির তৈরি তক্তিতে তারা ছুচলো কাঠি দিয়ে দাগ কেটে কেটে লিখতো। এই লিপির নাম বাণমুখ বা কীলকলিপি, ইংরেজিতে বলে কিউনিফর্ম। সর্বমোট ১২টি তক্তির উপরে বাণমুখ লিপিতে গিলগামেশ কাব্যটি লিপিবদ্ধ হয়েছিল। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এর চেয়ে প্রাচীন আর কোন সাহিত্য আমাদের হাতে নেই। শুধু গিলগামেশ-ই নয় হোমারের ‘ইলিয়াড’ ও ‘ওডিসি’র প্রেক্ষাপটও সমুদ্র ও সমুদ্রপকূলীয় মানুষ ও এর রাজ্যসমূহ। আমরা দেখি ওডিসির নায়ক ইউলিসিস তো ভ্রমিয়ে বেড়ায় এক সাগর থেকে অন্য সাগরে কোনো না কোনো অভিযানে। এ ছাড়া ইংরেজ সাহিত্যের কিংবদন্তিতুল্য সাহিত্যিক চার্লস ডিকেন্স লন্ডন শহরের ভিতর দিয়ে বয়ে চলা টেমস নদীকে নিয়ে লিখেছেন তার অনবদ্য শেষ উপন্যাস ‘আওয়ার মিচুয়্যালফ্রেন্ড’ শব্দের মাধ্যমে যে একটি নদীর দুঃখ-দুর্দশা এভাবে আঁকা যায় তা বোধ করি ডিকেন্সের এই উপন্যাসটি পাঠ না করলে বোঝা যেত না। একটি উপন্যাস যে একটি নদীকে দূষণের হাত থেকে সম্পূর্ণরূপে বাঁচিয়ে তুলতে পারে সেটাও ডিকেন্স আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন ‘আওয়ার মিচুয়্যালফ্রেন্ড’ উপন্যাসটির মাধ্যমে। নদীকে উপজীব্য করে বাংলা ভাষায়ও লিখা হয়েছে উল্লেখযোগ্য কিছু উপন্যাস। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ অদৈত্ব মল্ল বর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ সৈয়দ ওয়ালীউল্লার ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ হরিশংকর জলদাসের ‘জলপুত্র’ ইত্যাদি। পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসে যৌবনবতী পদ্মা এবং এর রুপালি শস্য ইলিশ মাছ ধরার যে চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তা সাহিত্যে বিরল। এ ছাড়াও বাদ যায়নি নদীকে অবলম্বন করে বেঁচে থাকা মানুষগুলোর কথাও। কাঁদো নদী কাঁদো উপন্যাসটি অবশ্য সরাসরি কোনো নদীকে উদ্দেশ্য করে রচিত হয়নি। তবে এখানে বলা হয়েছে নদীর তীরবর্তী কুমুরডাঙ্গার অসহায় অধিবাসীদের কথা। এ জন্যই আমরা দেখি উপন্যাসের শেষ অংশে উপন্যাসের কথক বলছেন- “স্টিমার ঘাটে ভিড়নোর জন্য অন্য যাত্রীদের সঙ্গে অপেক্ষা করছি তখন তবারক ভূইয়ার শেষোক্তিটি সহসা মনে পড়ে। কিছুক্ষণ আগে ওপারে সে বলেছিল নদী সর্বদাই কাঁদে, বিভিন্ন কণ্ঠে, বিভিন্ন সুরে নদী কাঁদে সবার জন্যই। নদী যদি কেঁদেই থাকে তবে সেটা নিজের দুঃখে নয়, কুমুরডাঙ্গার অসহায় অধিবাসীদের দুঃখেই কেঁদেছিল।”

অদৈত্ব মল্লবর্মণ তার তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসের এক জায়গায় বর্ণনা এরকম— ‘নদীর একটা দার্শনিক রূপ আছে। নদী বহিয়া চলে; কালও বহিয়া চলে। কালের বহার শেষ নাই। নদীরও বহার শেষ নাই। কতকাল ধরিয়া কাল নিরবচ্ছিন্নভাবে বহিয়াছে। তার বুকে কত ঘটনা ঘটিয়াছে। কত মানুষ মরিয়াছে। ...আবার শত মরণকে উপেক্ষা করিয়া কত মানুষ জন্মিয়াছে। অদৈত্ব মল্লবর্মণের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে হয় নদী বয়ে চলে কালও বয়ে চলে। যেহেতু সময় বয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের প্রায় বহু নদীর জীবন সঙ্গীন হয়ে আসছে সেহেতু আমাদের নদী রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে এখনই। নিতে হবে যথাযথ পদক্ষেপ।

     লেখক : গল্পকার ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।

ই-মেইল :  [email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর