বৃহস্পতিবার, ৬ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছেন প্রিয় বান্দারা

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছেন প্রিয় বান্দারা

সব ভুল ভুল নয়। কিছু ভুল ফুল হয়ে ফুটে ওঠে। যেমন হজরত ওমর (রা.) এর কথাই ধরি। কী ভুলটাই না করতে বসেছিলেন তিনি! মুহাম্মদ (সা.)-এর মাথা কেটে পুরস্কার আনবেন ভেবেছিলেন। নাম লেখাবেন ইতিহাসের পাতায়। কিন্তু কী করে যেন নিজের মাথাই অবনত হয়ে গেল মুহাম্মদের (সা.)-এর নূরানী কদমে। ভুলই তাকে ইতিহাসের বাগানে অমর ফুল করে ফুটিয়ে রাখল।

বাবা আদম। তিনিও ভুলকে পেয়েছিলেন ফুল হিসেবে। ভুলের আগে তিনি ছিলেন সাধারণ আদম। ভুলের ফুল তাকে উপহার দিল নবুয়াতি বাঁধন। আদম সফিউল্লাহ ভুল করে হয়ে গেলেন নবীউল্লাহ। বলতে পারি মা হাওয়ার কথা। ভুলের আগে ছিলেন জান্নাতের বাসিন্দা। ভুলের পর জান্নাত হয়ে গেছে তার সাজানো ঘর। নবীজী (সা.) বলেছেন, ‘আলজান্নাতু তাহতা আকদামিল উম্মাহাত। জগতে যত মা আছে, জান্নাত তাদের পায়ের নিচে।’ (আদাবুল মুফরাদ)।

‘ভুল’ থেকে জীবনের ফুল ফোটে। এ কথার প্রমাণ দিয়েছেন আল্লাহর রসুল। কোরআনে বলা ইউনুস নবীর গল্পের এটিই সারকথা। উম্মতের হঠকারিতায় অসহ্য হয়ে তিনি ভাবলেন, আজাব বুঝি খুব কাছে। লক্ষণও প্রকাশ পেতে শুরু করেছে ধ্বংস যজ্ঞের। এমন সময় আল্লাহ হিজরতের নির্দেশই দিয়ে থাকেন। যেমন দিয়েছেন আগের নবী হজরত লুতকে। ঠিক আছে আমি আগে থেকেই হিজরতের পথ ধরি। নবী হিসেবে কাজটি ঠিক হলো না তার। কারণ, নবীরা কখনো ধারণার বশবর্তী হয়ে উম্মতকে ত্যাগ করতে পারেন না। পারেন না কোনো গুরুত্ব্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে। এমন পরিস্থিতিতে আল্লাহর ওহি বাণীর জন্য অপেক্ষা করাই নবীর কাজ। ভুল করলেন ইউনুস নবী। কিন্তু এ ভুল-ই হলো তার জীবনের ফুল। ফুল হলো উম্মতের জন্য। ঘোর অবিশ্বাসী উম্মতের মনে ভয় জাগল। আরে! ইউনুস নবীতো সত্যিই আমাদের ছেড়ে চলে গেল। তাহলে কি তার দেওয়া আজাবের কথা সত্যে পরিণত হতে যাচ্ছে? এই ভয়ই এক সময় হঠকারী উম্মতকে ইমান আনতে বাধ্য করল। নবীর ভুল উম্মতের জন্য হয়ে গেল ফুল। ইউনুস নবীর কী হলো তবে? শুনি প্রভুর ভাষায়- ‘ওহে আমার প্রিয় বন্ধু মুহাম্মদ (সা.)! এক পাগল মাছওয়ালার গল্প শুনুন। সে রাগ করে মাতৃভূমি ও উম্মত ছেড়ে চলে যাচ্ছিল। ভেবেছিল, আমি তাকে কিছু বলব না। কিন্তু যখন আমি তাকে গভীর সমুদ্রের অন্ধকারে ফেলে দিলাম, তখন তার ভুল ভাঙল। সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ডাক দিল- ‘লাইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজজোয়ালিমিন।’ হে আল্লাহ! আপনি ছাড়া আর কেউ বিপদের বন্ধু নেই। আপনি মহান পূত ও পবিত্র। আসলেই আমি ভুল করে ফেলেছি।’ ‘বন্ধু শোন! তারপর কী মজার ঘটনাই না ঘটল। আমি ওই মাছওয়ালাকে উদ্ধার করেছি। শুধু তাই নয়, কেয়ামত পর্যন্ত আমার যত বান্দা ভুল করবে আর ইউনুসের মতো প্রার্থনা করবে তাদের সবাইকে আমি বিপদমুক্ত করব বলে ওয়াদাও করেছি।’ (সুরা আম্বিয়ার ৮৭ ও ৮৮ নম্বর আয়াতের ভাব তরজমা)।

পাঠক! লক্ষ্য করুন, ইউনুস নবীর ভুলের আলোচনা করতে গিয়ে আল্লাহতায়ালা তার নাম নিলেন না। বলেছেন ‘মাছওয়ালা’। যেমনিভাবে আমাদের নবীজীকে ডেকেছেন ‘কম্বলওয়ালা’ বলে। এভাবে ডাকা আদর ও মর্যাদার চিহ্ন। তারপর নবীর ভুলকে ফুল বানানোর জন্য একটা পরিবেশ সৃষ্টি করলেন। কায়েকদিন তাকে মাছের পেটে রেখে দিলেন। ওই ভয়ঙ্কর পরিবেশে নবী আল্লাহকে ডেকে ডেকে কান্নাকাটি করলেন। আর আল্লাহ নবীকে উদ্ধার করলেন। শুধু কি তাই? কেয়ামত পর্যন্ত বিশ্বাসী বান্দাদের বিপদমুক্তির জন্য ইউনুস নবীর দোয়াকে আদর্শ বানিয়ে দিলেন। তাইতো যে কোনো বিপদেই আমরা ইউনুস নবীর দোয়াটি পড়ি। এখন থেকে দোয়া পড়ার সময় ইউনুস নবীর কথাও একটু মনে করবেন। কারণ আল্লাহই বলেছেন, ‘মাছওয়ালার কথা মনে করুন...’।

হে দরদি পাঠক! আমার আপনার জীবনও ভুলে ভরা। জেনে না জেনে কত ভুলই না করে ফেলেছি আমরা। আচ্ছা! আমরা কি পারি না আমাদের জীবনের ভুলকে ফুল বানাতে। যেমন বানিয়েছেন আদি বাবা-মা। ইউনুস নবী। কিংবা ওমরসহ (রা.) খোদার সব প্রিয় বান্দারা। আমাদের নবী কী বলেছেন শুনুন। ‘কুল্লু বনি আদামু খাত্তাউন। খায়রুল খাত্তাউনা আত্ত্বাউবুন। সব আদম সন্তানই ভুল করে। তবে শ্রেষ্ঠ ভুলকারী সে যে, ভুলের জীবনে ‘তওবা ফুলে’র গাছ রোপণ করে।’ (বুখারি)। আসুন! আমরাও আমাদের ভুল-চুক, গোনা-খাতা নিয়ে প্রভুর দুয়ারে হাজির হই। চোখের অশ্রু ঝরিয়ে তাওবার বীজে পানি সিঞ্চন করি। দেখবেন, একদিন ঠিকই ইউনুস নবীর মতো আমাদের ভুলও ফুল হয়ে ফুটে উঠবে। আমরাও হতে পারব যুগের ওমর। রঙিন ফুলের বাহারি নেয়ামতে সাজবে আমাদের ধূসর জীবন।

হে তরুণ! ভুলের এই করুণ আহ্বান কী তোমার হৃদয়ে দোলা দেয় না? তবে ফিরে আসো প্রভুর দুয়ারে। তিনি বসে আছেন ক্ষমার ডালি বিছিয়ে। তুমি চাইলেই ক্ষমা করবেন তিনি।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসিসরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর