রবিবার, ৯ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

আগে ঠিক করুন নির্বাচন পদ্ধতি

হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ

আগে ঠিক করুন নির্বাচন পদ্ধতি

আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সবচেয়ে বড় অবদান গণতন্ত্র। মানব জাতির জন্য আশীর্বাদস্বরূপ গণতন্ত্র আমাদের স্বাধীনতারও মূলমন্ত্র। রাষ্ট্র অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কারণেই মানুষ তার সব অধিকার ভোগ করতে পারে। সেক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণের অপরিহার্য উপাদান হলো নির্বাচন। এই নির্বাচনকে দেশে ও দেশের বাইরে গ্রহণযোগ্য করতে হলে একে অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ করতে হবে।  আর এটাকে কেন্দ্র করেই দেশে দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক অনাস্থা ও অবিশ্বাস চলে আসছে। যে কারণে একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনের পাশাপাশি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ প্রশাসন গড়ে তোলার জন্য নিরপেক্ষ সহায়ক সরকার গঠনের দাবিও আজ প্রবল হয়ে উঠেছে বাংলাদেশে। প্রতিহিংসা ও বিভাজনের রাজনীতির কারণে সমাজ ও রাষ্ট্র অভ্যন্তরে এমন একটা নীতিহীন অমানবিক শ্রেণি-গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে যাদের কাছে ভিন্ন আদর্শের বা মতামতের কোনো গুরুত্বই নেই।

বস্তুত নির্বাচনকে তখনই অবাধ-সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বলা যাবে যখন ভোটাররা নিরাপদে ও স্বচ্ছতার সঙ্গে তাদের নিজেদের প্রার্থীর অনুকূলে ভোট প্রদান করতে সক্ষম হবে। এর কোনো বৈপরীত্য ঘটলেই সে নির্বাচন অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ বলে গণ্য হবে। এ কারণেই নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা অর্থাৎ ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি না হলে সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে যেসব বিষয় অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে তা পাঠকদের বিবেচনায় নিম্নে উপস্থাপন করা হলো। প্রথমত. বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে। পূর্বের ধারাবাহিকতায় দেখা গেছে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে মাঠপ্রশাসনের সব পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পক্ষে কখনই নিরপেক্ষভাবে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বিগত নির্বাচনের অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, নির্বাচন কাজে যুক্ত প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে সেক্ষেত্রে একটা ভীতি কাজ করে। বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের অন্তর্ভুক্ত রাজনৈতিক দলগুলোর বড় একটি অংশ মনে করে নির্বাচন কাজে যুক্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সর্বদা গোয়েন্দা নজরদারিতে থাকতে হয় এবং ভবিষ্যতে তাদের চাকরি হারানোর আশঙ্কায় তাদের পক্ষে স্বাভাবিকভাবে ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করা কঠিন হয়ে পড়তে পারে।

দ্বিতীয়ত. নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র দাখিল ও বাছাইয়ের ক্ষেত্রে যে অগ্রাধিকার পান বিরোধী দলের প্রার্থীরা তা পান না। যা এই সরকারের আমলে বিগত নির্বাচনগুলোতে প্রত্যক্ষ করা গেছে। এমনকি প্রধান বিরোধী দলের অনেকের প্রার্থিতা বাতিল হওয়ায় তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। একক প্রার্থী হিসেবে সরকারি দলের প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। বিগত উজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এরকম ঘটনা দেখা গেছে। এমনকি ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী-নেতা-কর্মী-সমর্থক কর্তৃক বিরোধী প্রার্থীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, জীবননাশের হুমকি-ধমকির ফলে বিরোধী দলের অনেক প্রার্থী নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থেকেছে।

তৃতীয়ত. নির্বাচনী প্রচারে সরকারি বা ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতায় যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে বিরোধী প্রার্থীর ক্ষেত্রে তা ঘটে না। বিরোধী প্রার্থীদের ক্ষেত্রে নানারকম হয়রানি, ভয়ভীতির মধ্যে তাদের নির্বাচনী প্রচার কাজ চালাতে হয়। তাছাড়া সরকারি দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের বিরোধী দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের ওপর অহেতুক হামলা-মামলার আশঙ্কা থেকে এক ধরনের আতঙ্ক রয়েই যায়। বিগত ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ওপর নির্বাচনী প্রচারণার ক্ষেত্রে এ ধরনের হামলা ও গাড়ি ভাঙচুর আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।

চতুর্থত. এ সরকারের আমলে সারা দেশে বিরোধী জোটের অসংখ্য নেতা-কর্মী ও সমর্থকের বিরুদ্ধে হাজার হাজার রাজনৈতিক মামলা হয়েছে। পক্ষান্তরে সরকারি দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের ক্ষেত্রে নিজেদের দলীয় কোন্দলের কারণে সংঘটিত অপরাধের দুই-একটি মামলা ছাড়া কারও বিরুদ্ধে তেমন কোনো মামলা নেই। ফলে মামলা ও জেল-জুলুমের ভয় মাথায় রেখে দলীয় সরকারের অধীনে বিরোধী প্রার্থীসহ নেতা-কর্মীদের নির্বাচনী মাঠে টিকে থাকতে কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে সরকার সমর্থিত প্রার্থীরা নির্দ্বিধায় প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে নির্বাচনী মাঠে একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তার করতে পারে বলে অনেকে মনে করেন।

পঞ্চমত. মাঠপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরপেক্ষ আচরণের অভাব ঘটলে যেসব এলাকা বা মহল্লায় বিরোধী প্রার্থীর সমর্থক বেশি থাকে সেখানে সরকারি দলের প্রার্থীরা তাদের সন্ত্রাসী-মাস্তানদের দিয়ে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে নির্বাচনী কাজে ও ভোটকেন্দ্রে আসা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করতে দেখা যায়। ফলে ভয়ভীতির কারণে ভোটাররা কেন্দ্রে উপস্থিত হতে উৎসাহিত হয় না।

ষষ্ঠত : নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ প্রশাসন না থাকলে নির্বাচনী আচরণ বিধি কঠোর প্রয়োগের অভাবে ‘জোর যার মুল্লুক তার’— এ নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে নির্বাচনে অবৈধ ও কালো টাকার ব্যাপক ছড়াছড়ি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। যার ফলে অস্ত্রবাজি ও পেশিশক্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবং সরকার সমর্থিতরা বেপরোয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

সপ্তমত : নির্বাচনে মাঠপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরপেক্ষ আচরণের অভাব ঘটলে ভোটকেন্দ্রগুলোতে সরকারি দলের প্রার্থীর অনুকূলে নির্বাচনী এজেন্টরা অযাচিত ক্ষমতা প্রদর্শনের সুযোগ পায়। স্বভাবতই বিরোধী প্রার্থীর নির্বাচনী এজেন্টরা মানসিকভাবে দুর্বল থাকে। ফলে নির্দিষ্ট প্রার্থীর অনুকূলে জালভোট প্রদান, ভোট কেটে বাক্সবোঝাই করা, ব্যালট বাক্স পরিবর্তন, ব্যালট পেপার ছিনতাই, ভোটকেন্দ্র দখল ইত্যাকার অনিয়মগুলো সহজভাবে সংঘটিত হয়।

অষ্টমত : নির্বাচনের সময় ভোটকেন্দ্রগুলোতে নিয়োজিত প্রিসাইডিং-সহকারী প্রিসাইডিং ও পোলিং অফিসাররা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের চাপের কাছে নতিস্বীকার করতে দেখা যায়। ফলে ভোটকেন্দ্রে সংঘটিত অনিয়মের বিরুদ্ধে তারা সোচ্চার হতে পারে না।

নবমত : নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার না হলে গণমাধ্যমগুলো নানা জটিলতা ও হয়রানির আশঙ্কা থেকে নিরপেক্ষ নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় বাধার সম্মুখীন হতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রচার-প্রচারণায় সরকারি দলের প্রাধান্য থেকে যায়। ইতিমধ্যে যার নমুনা আমরা দেখতে পাচ্ছি। এমনকি নির্বাচনী আইনের কঠোর প্রয়োগের অভাবে অনেক গণমাধ্যম সরকারি ক্ষমতার প্রভাবে উল্টা-পাল্টা, মিথ্যা, বিষোদগার প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে নির্দিষ্ট একপক্ষকে এগিয়ে নেওয়ার প্রবণতা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

দশমত : নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার না হলে নির্বাচন কমিশনও তার বিধিবিধান-আইন কঠোরতার সঙ্গে প্রয়োগ করতে সক্ষম হবে না। ফলে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেওয়া নির্বাচন কমিশনের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়বে। এমনকি মিডিয়া ক্যু-এর মাধ্যমেও নির্বাচনী বিজয় ছিনিয়ে নেওয়ার আশঙ্কা থেকে যাবে।

অধিকন্তু আরও অনেক বিষয় আছে যেগুলো মীমাংসা না হলে জাতীয় নির্বাচনকে নিরপেক্ষ করা যাবে না। যেমন দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে বর্তমান মন্ত্রী-এমপিদের অনেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনের সময় তাদের প্রটোকল কী হবে? রাষ্ট্রীয় সব রকম সুবিধা কি তারা ভোগ করবেন? সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন করলে এমপিরা কি রাষ্ট্রীয় সুবিধা ভোগ করবে না? এসব বিষয় নিষ্পত্তি না হলে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ কীভাবে তৈরি হবে— এ বিষয়ে অনেকের প্রশ্ন রয়ে গেছে। বিএনপি বলছে, সরকার চাচ্ছে বিএনপিকে মনস্তাত্ত্বিক চাপে রেখে বেকায়দায় ফেলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করা। আর এর অংশ হিসেবে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ দলটির শীর্ষ নেতাদের মামলার বিচার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে সাজা দেওয়া। এমনকি বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা দুর্বল, আন্দোলনের ক্ষমতা নেই ইত্যাকার কথা বলে মামলা-হামলায় জর্জরিত বিএনপি নেতা-কর্মীদের মনোবল ভেঙে দেওয়ার চেষ্টারও কমতি নেই। কিন্তু বিশাল জনসমর্থন ও বিপুলসংখ্যক ত্যাগী নেতা-কর্মীর এই দল ‘শিয়াল ও কাকের গল্পের’ মতো সরকারের ফাঁদে পা না দেওয়ার নীতিতে এখনো অটল।

বলাবাহুল্য, আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ও আস্থা-বিশ্বাসের জায়গাটি এতটাই ভঙ্গুর যে, মার্কিন রাষ্ট্রদূত বার্নিকাটের কথায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কিছু দিন আগে সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে আলোচনার এক পর্যায়ে বার্নিকাট বলেছেন, ‘তার ৩৫ বছরের কূটনৈতিক জীবনে এমন জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি তিনি পৃথিবীর কোনো দেশে দেখেননি। এর সঙ্গে আরও বলেছেন, নির্বাচন অনুষ্ঠান শুধু একদিনের নিরপেক্ষ থাকার বিষয় নয়, সর্বোপরি সামগ্রিক প্রক্রিয়াকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করা। তাই জাতীয় স্বার্থেই প্রতিহিংসা, বিভেদ ও বিভাজনের রাজনীতির অবসান হওয়া উচিত। যা আমাদের গভীর সংকটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে এবং এভাবে আর কতদিন! ভারত, পাকিস্তানসহ সার্কভুক্ত অনেক দেশ নানা অর্থনৈতিক-সামাজিক অস্থিরতা ও প্রতিকূলতার মধ্যেও নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে একটা উন্নত গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি তৈরি করতে পেরেছে। তাদের দেশের জনগণকে আস্থার জায়গায় নিয়ে যেতে পেরেছে কিন্তু আমরা তা পারিনি। এ দৈন্যতা আমাদেরই। সবাইকে অনুধাবন করতে হবে, দেশের অভ্যন্তরে দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতা বজায় থাকলে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রাই শুধু ব্যাহত হয় না সেই সঙ্গে অর্থনীতি, সমাজ শৃঙ্খলা, নাগরিক নিরাপত্তা সবকিছুই ব্যাহত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এমনকি উগ্র-সন্ত্রাসবাদ তথা জঙ্গিবাদের প্রসার ঘটাও অমূলক নয়। বাংলাদেশের গণতন্ত্রে যে আস্থার সংকট চলছে এটা থেকে বেরিয়ে আসার প্রধান হাতিয়ার হলো স্বচ্ছ নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা।  আর এ ক্ষেত্রে সরকারি দলের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি।

পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রধান সংকট হলো একটা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের অভাব। কেননা জাতি ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো একতরফা নির্বাচন আর দেখতে চায় না।  নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার, শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের পাশাপাশি বর্তমান রাজনৈতিক সমস্যা নিরসনকল্পে সবপক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে। আলোচনায় বসে কীভাবে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব হবে সে পথ রচনায় উদ্যোগী হতে হবে।

 

লেখক : চেয়ারম্যান ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর