রবিবার, ৯ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

মাধ্যমিক শিক্ষার মান

অধ্যাপক মো. ওমর কাজী

সর্বজনবিদিত এবং  অতি জনপ্রিয় একটি সিস্টেম বহু বছর চলার পর মাধ্যমিক স্তরের পরীক্ষা পদ্ধতিতে ২০১০ সালে এক বিপুল পরিবর্তন আনা হয়। শিক্ষার্থীদের বইমুখী করে গড়ে তোলাপূর্বক মুখস্থ, গাইড বই এবং কোচিংনির্ভরশীলতা থেকে সরিয়ে পাঠ্যবই পড়ার মাধ্যমে জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা গ্রহণে আকৃষ্ট করাই ছিল এ নতুন সংস্করণের উদ্দেশ্য। উদ্দেশ্যটি ছিল মহৎ কিন্তু ফল হয়েছে উল্টো। কারণটা কী তা নিরূপণ অত্যাবশ্যক। ইদানীং দেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদরা এ নিয়ে চিন্তাভাবনা, আলোচনা-পর্যালোচনা শুরু করে দিয়েছেন, যদিও সরকার বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে বলে মনে হয় না।

প্রচলিত অর্থাৎ বিগত পরীক্ষা পদ্ধতির সবচেয়ে লক্ষণীয় ত্রুটি ছিল প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় যা দ্বারা শিক্ষার্থীর চিন্তন দক্ষতা পরিমাপ করা হয়। এ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা চূড়ান্ত পরীক্ষায় সম্মুখীন হওয়ার জন্য একটি সাজেশন তৈরিপূর্বক লিমিটেড কিছু নোট মুখস্থ করত। পাঠ্যবই না পড়লেও কিছু যেত আসত না। কারণ পাঠ্যপুস্তক পড়ার ওপর পরীক্ষায় ভালো ফল নির্ভর করত না, নির্ভর করত কার নোট কতটুকু মানসম্পন্ন এবং পরীক্ষার খাতায় তা কতটা নির্ভুলভাবে লিখে আসতে পারছে। কাজেই শিক্ষার্থীরা নোটবই, গাইড বই এবং প্রাইভেট টিউটরদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ত। এখানে আরও উল্লেখ্য, পাঠ্যসূচির যেসব চ্যাপ্টার, গল্প বা কবিতা থেকে এ বছর প্রশ্ন করা হয়েছে পরের বছর ওইসব চ্যাপ্টার, গল্প ইত্যাদি বাদ দিয়ে পাঠ্যসূচির বাকি অংশের ওপর প্রশ্ন করা হতো। এতে শিক্ষার্থীরা পাঠ্যসূচির অর্ধেকাংশ পড়াশোনা এমনকি স্পর্শই করত না। ফলে শিক্ষার্থীরা চিন্তন দক্ষতা ও শিক্ষাক্রমে অর্পিত মূল্যবোধ অর্জন করতে ব্যর্থ হতো। মাধ্যমিক স্তরের এহেন অবস্থা থেকে সরে এসে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মানসম্পন্ন শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণপূর্বক অনেক চিন্তাভাবনা করে ২০১০ সালে সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতির মূল লক্ষ্য চারটি :  শিক্ষার্থীদের ক. নোট মুখস্থ করার মতো কঠিন কাজ থেকে রেহাই দিয়ে তাদের পাঠ্যবইমুখী করে তোলা। খ. নোটবই, গাইড বই এবং প্রাইভেট টিউটরের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে পরিত্রাণ দেওয়া। গ. জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা গ্রহণে নিশ্চয়তা করা। ঘ. আহরিত জ্ঞান যেন বিশ্লেষণপূর্বক বাস্তব এবং কর্মজীবনে প্রয়োগ করতে পারে সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া। উল্লিখিত উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার লক্ষ্যে পরীক্ষার প্রশ্ন ও মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়। এখানে শিক্ষার্থীদের জন্য জ্ঞান, অনুধাবন, প্রয়োগ ও বিশ্লেষণ এ চারটি ক্ষেত্রে দক্ষতা পরিমাপের জন্য প্রশ্নপত্র দুটি ধারায় বিভক্ত— বহু নির্বাচনী প্রশ্ন এবং সৃজনশীল প্রশ্ন। বহু নির্বাচনী প্রশ্নপত্র প্রণয়নের একটি বড় উদ্দেশ্য ছিল যেন শিক্ষার্থীরা পাঠ্যসূচির সব বিষয় ভালোভাবে পড়ে। সব বিষয় বা চ্যাপ্টারের ওপর এ ধরনের প্রশ্ন থাকবে। সুতরাং শিক্ষার্থীদের পাঠ্যসূচির কোনো অংশ বাদ দিয়ে পড়ার সুযোগ থাকবে না। প্রশ্নগুলো এমনভাবে করতে হবে যেন শিক্ষার্থীদের চিন্তন দক্ষতার চারটি স্তর পরিমাপ করা যায়। সৃজনশীল প্রশ্নের অংশেও ওই চারটি স্তর পরিমাপ করার জন্য পাঠ্য বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি উদ্দীপকের মাধ্যমে প্রশ্ন প্রণয়ন করতে হবে। এ উদ্দেশ্য সামনে রেখে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষক ও প্রশ্নপত্র প্রণয়নকারীদের মোটামুটি প্রশিক্ষণ দেওয়া হলেও তারা যথার্থভাবে কাজটি করতে পারছে না বা করার জন্য যে মেধা ও শ্রম খরচ করার দরকার তা করছে না। বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত রেখে নতুন নতুন উদ্দীপক তৈরি এবং অভিনব প্রশ্ন প্রণয়নে তারা যথেষ্ট সচেতন বা সচেষ্ট নয়। জ্ঞান ও অনুধাবনের প্রশ্ন তারা ভালোভাবেই তৈরি করতে পারে, কিন্তু প্রয়োগ ও বিশ্লেষণমূলক প্রশ্ন তৈরি করতে তারা হিমশিম খায়। আবার দেখা গেছে প্রয়োগ ও বিশ্লেষণমূলক প্রশ্ন উলট-পালট করে ফেলে। কথা ছিল কোনো প্রশ্ন বা উদ্দীপক রিপিট হবে না। এটা করতে পারলে নোটবই, গাইড বই বন্ধ হয়ে যেত। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে প্রশ্ন রিপিট হচ্ছে এবং কখনো কখনো তা গাইড বই ও নোটবই থেকে তুলে দেওয়া হচ্ছে। প্রশ্নপত্র প্রণয়নের ত্রুটি শিক্ষাক্রমের উদ্দেশ্য হাসিলের পথে অন্যতম বাধা। শুধু প্রশ্নপত্র প্রণয়নই নয়, মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায়ও বেশ ত্রুটি রয়েছে। সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর শিক্ষার্থীরা যথার্থভাবে দিতে পারলে পূর্ণ নম্বর এবং না পারলে শূন্য পাবে। আংশিক উত্তর দিতে পারলে তাকে হার মতো পূর্ণ নম্বর দিতে হবে, ভগ্নাংশে বা অর্ধেক নম্বর দেওয়ার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা কোনোমতে বুঝিয়ে দিতে পারলেই পূর্ণ নম্বর পায়। ভাষাগত ত্রুটি যতই থাক না কেন তথ্যগত ভুল না হলে তার নম্বর কাটা যাবে না। ফলে সাধারণ শিক্ষার্থী ও অতি মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে তেমন পার্থক্য করা যায় না। অধিকাংশই জিপিএ-৫ পেয়ে পরীক্ষায় পাস করে। ভাষাগত দিক উপেক্ষা করার ফলে মাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়া অনেক শিক্ষার্থী সাধারণ একটি দরখাস্ত মাতৃভাষায় শুদ্ধভাবে লিখতে পারে না। বানানের দিকটা ঠিকমতো যাচাই না করার কারণে অতি সাধারণ বানানও তারা ভুল করে।

এ অবস্থা উত্তরণপূর্বক মাধ্যমিক শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য শিক্ষাবিদরা নানা পথ দেখিয়েছেন। তার একটি হলো প্রশ্ন ব্যাংক তৈরি করে পরীক্ষা নেওয়া এবং আর একটি হলো এমসিকিউ তুলে দেওয়া। প্রথমটির বিষয়ে আপত্তির যথেষ্ট কারণ আছে। আমাদের মনে আছে ১৯৯২ ও ১৯৯৩ সালের প্রশ্ন ব্যাংকের মাধ্যমে প্রশ্ন করায় বহু সাধারণ মানের শিক্ষার্থী স্টার মার্ক পেয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করে। দুই বছর পর তারাই যখন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেয় তখন বহু স্টারমার্ক পাওয়া শিক্ষার্থী তৃতীয় বিভাগ এবং অনেকে ফেল করে বসে। তা ছাড়া আমাদের দেশে অসাধু লোকদের কারণে প্রায়ই প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ঘটে। প্রশ্নব্যাংক তৈরি হলে তা যে ফাঁস হবে না সে নিশ্চয়তা কে দিতে পারে? দ্বিতীয়টির বিষয় হলো, এমসিকিউ পুরোপুরি উঠিয়ে না দিয়ে একে আরও কমিয়ে এনে ১০-১৫ নম্বরে সীমাবদ্ধ রাখা যায়। তদুপরি আগে উল্লিখিত দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে ওঠার নিমিত্ত শিক্ষক বিশেষ করে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের আরও ফলদায়ক প্রশিক্ষণ প্রদান এবং মূল্যায়নের ক্ষেত্রে শুধু তথ্যের ওপর নয়, ভাষার ওপরও জোর দেওয়া দরকার।  অধিকন্তু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যোগ্যতার ভিত্তিতে আরও মেধাসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া আবশ্যক। শুধু সংখ্যা দিয়ে নয়, গুণগতমান কতটুকু অর্জিত হলো তাও পরীক্ষার প্রকৃত ফলাফল নিরূপণের বিষয়।

লেখক : সরকারি কলেজের সাবেক উপাধ্যক্ষ এবং সাবেক শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ, এনসিটিবি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর