মঙ্গলবার, ১১ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

বন্ধু কবি সায্যাদ কাদির নেই ভাবতেও পারি না

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

বন্ধু কবি সায্যাদ কাদির নেই ভাবতেও পারি না

বড় বেশি ভারাক্রান্ত মন নিয়ে লিখছি। এমন ভাঙা হৃদয়ে কখনো কোনো দিন লিখব কল্পনাও করিনি। কিন্তু মানুষের কল্পনার বাইরেও অনেক ঘটনা ঘটে যা সে চিন্তাও করতে পারে না। বাবা চলে গেছেন প্রায় দেড় যুগ। মাও নেই যুগ পেরিয়ে কয়েক মাস। মা যখন বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে মারা যান তখন তার দুই পা বুকে চেপেছিলাম। কয়েক ঘণ্টা আগে লাইফ সাপোর্ট দেওয়া হয়েছিল। ডাক্তাররা যখন লাইফ সাপোর্ট তুলে নিতে চাচ্ছিলেন তখন আমি কোথায়, দুনিয়ায় না অন্য কোনো জগতে ছিলাম বলতে পারব না। শুধু ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ’ উচ্চারণ করছিলাম। শেষ মুহূর্তে সব মুসলমান মৃত্যুপথযাত্রীকে কালেমা শোনায়। এমন বেসামাল ছিলাম যে আমি আমার মায়ের কানে আল্লাহর কালাম দিতে পারিনি। তার দুই পা বুকে চেপে কত শতবার আল্লাহর কালাম উচ্চারণ করেছিলাম বলতে পারব না। মাকে ছাড়তে ইচ্ছা হচ্ছিল না। তবু তিনি চলে গেছেন। বাবার মৃত্যুর সময় পাশে ছিলাম না, ছিলাম ঢাকায়। দুই দিন আগে আমার বাসা হয়ে টাঙ্গাইলে গিয়েছিলেন। তখন সংসদ চলছিল। এক বিকালে বাবার ফোন পেয়েছিলাম, ‘বজ, বাসায় আয়।’ সঙ্গে সঙ্গে ছুটেছিলাম। তার ডাকে সাড়া দিতে সামান্য দেরি হলেও তিনি সহ্য করতেন না। না-বুঝের মতো রাগ করতেন। বাবার রাগারাগিতে অল্প বয়সে মন খারাপ হতো। কিন্তু যখন বড় হয়েছিলাম, বাবা হয়েছিলাম তখন আর তার রাগারাগিতে মন খারাপ হতো না। একসময় মনে হতো সন্তানের ওপর বাবা-মার রাগ করা অধিকার। মা কখনো রাগ করতেন না, আঁচলে আগলে রাখতেন। কিন্তু বাবা ছিলেন বিপরীত, উঠতে-বসতে গালাগাল করতেন, রাগ করতেন। মারা যাওয়ার কয়েক বছর আগে একবার জামালপুর-শেরপুরে প্রায় ১৫ দিন সাংগঠনিক সফর করে বাড়ি ফিরে বাবার ঘরে না গিয়ে মার ঘরে কেন প্রথম গেলাম এ নিয়ে ঠিকানাহীন কুকুর-বিড়ালের মতো গালাগাল করেছিলেন। আশপাশে বহু মানুষ ছিল বলে বড় কষ্ট পেয়েছিলাম। মনের দুঃখে ১০-১২ দিন বাবার কাছে যাইনি। কেমন যেন শূন্যতায় সব ভরে গিয়েছিল। সব থাকতেও খালি খালি বুকটা ফাঁকা মনে হচ্ছিল। হঠাৎই মনে হয়েছিল রাজনীতি করি, কতজন কত সমালোচনা, গালাগাল করে আর জন্মদাতা পিতা, তিনি না হয় রাগ করে খারাপ কিছু বলেছেন। বুকের জ্বালায় থাকতে না পেরে একদিন মাগরিবের পর কাচুমাচু হয়ে হাত কচলাতে কচলাতে তার বিছানায় গিয়ে বসেছিলাম। তিনি বিছানা থেকে উঠে মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, ‘লোকজনের সামনে বকাঝকা করেছি বলে মন খারাপ হয়েছে? আমারও খারাপ লেগেছে। তোদের কিছু করার নেই। তোরা কী করবি। আমাকে ছেড়ে তোর মায়ের কাছে আগে গেলে আমার মাথা ঠিক থাকে না। কেমন জানি লাগে। তাই অমন গালাগাল করি। এসে ভালো করেছিস। তুই না এলে আমিই যেতাম।’ বাবার কথায় বুক ফেটে গিয়েছিল। তার পরও দু-এক বার রাগারাগি-বকাঝকা করেছেন। কিন্তু তেমন কিছু না। তাই বাবার ফোন পেয়ে সংসদ থেকে বলতে গেলে উড়ে এসেছিলাম। এসে দেখি, মা-বাবা একসঙ্গে বসে আছেন। মা-বাবাকে ও রকম পাশাপাশি বসে গল্প করতে খুব একটা দেখি না। আমাকে দুজনের মাঝে বসিয়ে বলেছিলেন, ‘বজ, চোখ আর ভালো হবে না। তুই বল, দেখতে না পেলে বেঁচে থেকে কী লাভ?’ বাবাকে বলেছিলাম, হতাশ হচ্ছেন কেন। টাঙ্গাইল থেকে ঢাকা আসতে যতক্ষণ, ঢাকা থেকে দিল্লি যেতে তার চেয়ে ৫-১০ মিনিট কম লাগে। দিল্লির রামমনোহর লহিয়া হাসপাতালে অটল বিহারি বাজপেয়ির যে ভাগ্নে আপনার অপারেশন করেছে, সে তো আছে। চলুন তাকে দেখিয়ে আসি। বাবা কিছুটা নিমরাজি হয়ে বিদায় নিয়েছিলেন। নিচে নেমে দেখি, বড় ভাইয়ের ডাবল কেবিন পিকআপ। তাতে বাবা টাঙ্গাইল যাবেন। বলেছিলাম, এটা কেন? এ তো শক্ত গাড়ি। যেতে কষ্ট হবে। আমার গাড়িতে যান। তিনি বলেছিলেন, ‘না, আরজুও তার ভালো গাড়ি দিতে চেয়েছিল। আমি এটা চেয়ে এনেছি।’ কী আর করা, বাবার কথার ওপর কথা চলে না। সেদিনও সাহস করে বলিনি। কে যেন সঙ্গে ছিল। তাকে সারা রাস্তা বলতে বলতে গিয়েছিলেন, ‘জানো, আমি বজকে ভয় পাই। ও তো আমার ছেলে না। ও তো আমার বাপ। আরজু ছাড়া আমার সব ছেলেমেয়ে বজ  মানুষ করেছে। তাই যখন ওর সামনে থাকি ভয়ে থাকি।’ আরও কত কথা। পরদিন কোর্টে গিয়ে বন্ধু-বান্ধবদের বলেছিলেন, পরের সপ্তাহে চোখ দেখাতে দিল্লি যাবেন। তার আর যাওয়া হয়নি। পরদিন রাত ১১টায় হাসপাতালে গিয়েছিলেন। কয়েক মিনিট পর আমাদের সবার মায়া কাটিয়ে তিনি চলে যান। রাত দুই-আড়াইটায় আকস্মিক বাবার মৃত্যুর খবরে একেবারে এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলাম। মা বাবর রোডে ছিলেন। দীপ-কুঁড়ির মা মাকে নিয়ে সকালে টাঙ্গাইল গিয়েছিল। সেই কবে ২০০০ সাল, আর এখন ২০১৭।

৬ এপ্রিল বুধবার সকাল ৮টা ৩৪ মিনিটে হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে। ওই রকম সময় সাধারণত ফোন ধরি না। ফোনের দিকে তাকাতেই দেখি সায্যাদ কাদির বাবর। ‘হ্যালো’ বলতেই বাবরের কণ্ঠ, ‘বজ, হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ৬ নম্বর ওয়ার্ডে।’ এ পর্যন্ত বলতেই কেটে যায়। আমি আবার ৮টা ৩৫ মিনিটে ফোন করি। এবার বলল, ‘বন্ধু, অধ্যাপক মাহাবুবুর রহমানের অধীনে ৬ নম্বর ওয়ার্ডে আছি।’ বলেছিলাম, আমি এখনই দেখছি, খবর নিচ্ছি। সঙ্গে সঙ্গে তুহিনকে পাঠিয়েছিলাম। হৃদরোগের পরিচালক এবং অন্যদের ফোন করেছিলাম। তুহিন গিয়ে নাশতা খাইয়ে আমায় জানিয়ে ছিল, ‘বাবর স্যার ভালো আছেন। এই মাত্র নাশতা খাইয়েছি।’ ১৫-২০ মিনিট পর আবার তুহিনের ফোন, ‘বাবর স্যারের অবস্থা ভালো না। যে রকম দেখছি ফিরবেন কিনা বলতে পারি না।’ জানিয়েছিল, তাকে আইসিওতে নেওয়া হয়েছে। শক দেওয়া হচ্ছে, প্রেসার দেওয়া হচ্ছে। একটু পরে শুনলাম সব শেষ। মনে হয় বাড়িটা ঘুরছে। মাথা ভনভন করছে। সারা ঘর-দুয়ার দুলছে। নাই নাই কিছু নাই, একটা হাহাকার। কিছুক্ষণ নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না। পরপর কবি সামাদ, সাদেক সিদ্দিকী আরও কে কে যেন ফোন করে। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর সংবাদে যেমন বুকটা ভেঙে খানখান হয়ে গিয়েছিল। বেসামাল এলোমেলো হয়ে পড়েছিলাম। মাকে হারিয়ে যেমন গভীর শূন্যতায় অস্তিত্ব হারিয়েছিলাম। বাবরের আকস্মিক মৃত্যুসংবাদ আমাকে তেমন করে ফেলেছিল। রক্তের সম্পর্কহীন কোনো মানুষের অন্য কোনো মানুষের ওপর এমন প্রভাব থাকে ভাবা যায় না। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার কোনো রক্তের সম্পর্ক ছিল না, ছিল না হুজুর মওলানা ভাসানীর সঙ্গে। কিন্তু তারাই আমার অস্তিত্ব, তাদের জন্য আমার হৃদয় ভেঙে খানখান হয়ে যায়। ঠিক বাবরও আমার জন্য অনেকটাই তেমন।

শাহ নুর মোহাম্মদ বাবর, একই পাড়ায় আমাদের জন্ম। এতকাল জানতাম বাবর আমার থেকে ২-৩ বছরের ছোট। পড়ত তিন-চার ক্লাস উপরে। আমি বেশ বড়সড় হয়ে চার-পাঁচটা স্কুল অদলবদল করে প্রথম শ্রেণিতে পড়া শুরু করেছিলাম। বাবর কখনো কোনো স্কুল বদলায়নি। সব ক্লাসে ফার্স্ট ছিল কিনা জানি না। কিন্তু দারুণ ভালো ছাত্র ছিল। পৃথিবীতে এমন মেধাবীর সঙ্গে নিরেট গর্দভের এত গভীর সম্পর্ক হয় ভাবা যায় না। মনে হয় কোনো নজিরও নেই। বাবর কোনো দিন পরীক্ষায় খারাপ করেনি আর আমি কোনোভাবে টেনেটুনে পাস করেছি। বাবরও দুষ্ট ছিল, আমিও ছিলাম। ওর দুষ্টুমি ছিল এক রকম, আমার ছিল অন্য রকম। কিন্তু আমরা বড় বেশি ঘনিষ্ঠ ছিলাম। আইয়ুব খানের শাসনামলে ’৫৯-৬০ সালে আমার কলেরা হয়েছিল, ওরও হয়েছিল। ’৬২-তে আমার বসন্ত হয়েছিল, ওরও হয়েছিল। আমার টাইফয়েড হয়েছে, একই সঙ্গে ওরও হয়েছে। এটা কেন কীভাবে হতো বলতে পারব না। কিন্তু হতো। আমরা এক পাড়ার মানুষ। আমাদের বাসা থেকে ওদের বাসা ২০০-৩০০ গজ। বাড়িঘরের ভিতর দিয়ে যেতে ৪-৫ মিনিটের পথ। ছেলেবেলায় আমাদের আকুরটাকুরপাড়া এবং বিশ্বাস বেতকায় প্রতি বছর নাটক হতো, বিচিত্রা অনুষ্ঠান হতো। সব সময় ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাটমিন্টন, বলি খেলা হতো। গান-বাজনা-নাটক-থিয়েটারে তেমন মুখ্য ভূমিকা না থাকলেও খেলাধুলায় সব সময় আমার প্রধান ভূমিকা থাকত। বিশেষ করে ফুটবল এবং বলি খেলায়। ৪-সাড়ে ৪টায় ঘুম থেকে উঠে প্রায় পাঁচ মাইল পুংলী পর্যন্ত এক দৌড়ে যেতাম এবং কিছুক্ষণ পরে ফিরে আসতাম। সকাল বেলায় ১০ মাইল ছোটায় পাড়ার অনেকেই সাথী হতো। বড়দের নিয়ে সমস্যা হতো না। সমস্যা হতো মায়েরা যখন পাঁচ-ছয়-সাত বছরের বাচ্চাদের হাতে দিতেন তখন। অতদূর ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চারা দৌড়াতে পারে? কিন্তু মায়েরা বুঝতে চাইতেন না। দু-চারটি বাচ্চা একদিন দৌড়ে সারা দিন যখন বিছানা থেকে উঠত না, তখন অনেক মা বজকে গালি দিতেন। আবার ১-২ দিন পর সেই ছোট্ট বাচ্চারা সাথী হতো। ও রকম কদিন করতে করতে সব ঠিক হয়ে যেত। দু-এক মাস পর নাদুসনুদুস চনমনে নীরোগ বাচ্চাদের নিয়ে অধিকাংশ মা-বাবা আমাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করতেন। আমাদের পাড়ায় নাটক-থিয়েটারে অগ্রণী ছিলেন ফারুক কোরায়েশী, সাহাপাড়ার পরিতোষ বাবুর ছেলে বিশু, কালিদাস রায়, বাগচীবাড়ির সুধীর, আনু, সুবিনয় দাস, আজিজুল হকসহ আরও অনেকে।

ছেলেবেলায় আমরা আলহেলাল ক্লাব করতাম। ফুটবলের জন্য ক্রিকেটের জন্য অথবা ব্যাটমিন্টনের জন্য মাঝেমধ্যে চাঁদা তুলতে বেরোতাম। একবার আমাদের বাড়ির সামনে জুট অফিসে ফরিদপুরের মন্ত্রী ভবানী শঙ্কর বিশ্বাস এসেছিলেন। তখন মোনায়েম খানের আমল। আমরা প্রায় ২০-২৫ জন চাঁদা তুলতে গেছি। আমাদের কিচিরমিচিরে জুট ইন্সপেক্টর নির্মল সাহা মনে হয় কিছুটা বিরক্ত হয়েছিলেন। নির্মল সাহার পরিচিত বলেই সেদিন তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। আমাদের তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছিল। কিন্তু আমরা কিচিরমিচির করছিলাম। ‘মন্ত্রীর কাছে যাবই, চাঁদা নেবই।’ ফাঁক থেকে মন্ত্রীকে দেখছিলাম। তখন মন্ত্রীরা ছিলেন বিরাট কিছু। একসময় তিনি বলেছিলেন, ‘বাচ্চারা কেন এসেছে? ওদের ডাকো।’ আমরা কিলবিল করে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। তিনি বললেন, ‘কী চাই? তোমরা কেন এসেছ?’ আমাদের ক্লাব আছে। ক্লাবের জন্য চাঁদা চাই। তিনি বড় চমৎকার করে বললেন, ‘বেশ তো কয় টাকা চাই?’ বললাম, ১০ টাকার কম কোনোমতেই নেব না। মাননীয় মন্ত্রী বললেন, ‘ঠিক আছে। রসিদ দাও।’ বাবর ঘজঘজ করে ১০ টাকার রসিদ লিখে দিল। রসিদ হাতে মাননীয় মন্ত্রী ভবানী শঙ্কর বিশ্বাস বেশ কয়েকবার দেখলেন। আমরা ভাবলাম, টাকার পরিমাণ বেশি হয়েছে বলে হয়তো বার বার দেখছেন। কয়েকবার রসিদ দেখে বললেন, ‘এটা কে লিখেছে?’ আমরা ছোটখাটো কবি সায্যাদ কাদির বাবরকে এগিয়ে দিলাম। দেখতে শুনতে সে ছিল আমাদের সবার ছোট। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এটা তুমি লিখেছ?’ বাবর বলল, ‘হ্যাঁ স্যার।’ মনে হয় মন্ত্রী তাকে টু-থ্রির ছাত্র মনে করেছিলেন। তাই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কোন ক্লাসে পড়?’ বাবর বলল, ‘টেনে’। ও যেই বলল ‘টেনে’, মন্ত্রীর চোখ চড়কগাছ। তিনি বললেন, ‘কী বল!’ কাগজ বের করে তিন-চার লাইন লেখালেন। বাবরের হাতের লেখা ছিল গোটা গোটা মুক্তোর মতো ঝকঝকে। মন্ত্রী খুশি হয়ে আমাদের প্রত্যেককে এক টাকা করে হাতে দিয়ে মিষ্টি খাইয়ে ১০ টাকার জায়গায় ২০ টাকা চাঁদা দিলেন। আমরা ২০-২৫ জন যুদ্ধজয়ের আনন্দে নাচতে নাচতে চলে এলাম।

ছোট বোন শাহানার স্বামী ’৭৫-এর প্রতিরোধ সংগ্রামী, বীর মুক্তিযোদ্ধা আরিফ আহমেদ দুলাল এসেছিল। বন্ধুর বিয়োগ ব্যথায় টুটাফাটা বুকে লিখতে ভালো লাগছিল না। তাই দুলালকে এগিয়ে দিতে দোতলা থেকে গেটে গিয়েছিলাম। বাইরে বেরোতেই দুই রিকশাওয়ালা ছুটে এসে হাত ধরে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘কেমন আছেন?’ ভালো। ‘তবে কি সাহেব, শেষ পর্যন্ত আমরা ভারতের কাজের বুয়া হলাম?’ আমি কিছু বুঝতে পারিনি। একটু থতমত খেয়েছিলাম, কেন? কী হয়েছে? ‘না, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভারতের প্রেসিডেন্টের বাড়িতে গিয়ে ভাপা ইলিশ রেঁধে খাওয়ালেন— এটা কেমন হলো?’ তাজ্জব বনে গিয়েছিলাম দুজন রিকশাওয়ালার কথা শুনে। বলেছিলাম, তা হবে কেন? ব্যাপারটা ওভাবে ভাবিনি। বর্তমানে জীবিতদের মধ্যে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি শ্রী প্রণব মুখার্জি আমার খুবই প্রিয়। একজনকে মায়ের মতো দেখি, আরেকজনকে বড় ভাইয়ের মতো। প্রায় ৪০ বছর সুখে-দুঃখে সব সময় ভারতের রাষ্ট্রপতি একই রকম যত্ন করেছেন, গুরুত্ব দিয়েছেন। তাই প্রিয় মানুষদের সম্পর্কে অপ্রিয় কিছু ভাবতে মন সায় দেয় না। লেখাটা শেষ করতে তার পরও আরও প্রায় দুই ঘণ্টা লেগেছে। এ দুই ঘণ্টাই ভেবেছি, কী বললেন দুজন শ্রমজীবী সাধারণ মানুষ। নিশ্চয়ই প্রণবদাকে জননেত্রী শেখ হাসিনা রান্না করে খাওয়াতে পারেন। আমার দেশে এলে হয়তো চলত। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাষ্ট্রীয় সফরে ভারতে গিয়ে রাষ্ট্রপতি ভবনে অবস্থান নিয়ে তাকে রেঁধে খাওয়াতে পারেন? তাতে আমার দেশের মর্যাদা বাড়ে না কমে মনটা বড় তোলপাড় করছে। সুস্থভাবে ভাবতে পারছি না। পরে এ নিয়ে লিখব, আজ নয়। এত নাজুক অবস্থায় কখনো কিছু করিনি, আজকেও আর না।

সমাজসেবা করতে গিয়ে আমরা মজা পুকুরের পানা তুলতাম। ওসব কাজে আমি ছিলাম যেমন নিবেদিত, বাবর ছিল ধরি মাছ না ছুঁই পানি। আমরা যখন কচুরিপানা তুলতাম ও দু-চার বার পানা তুলে পাড়ে বসে থাকত। সবকিছুতে অংশ নিত। কুচিন্তা মাথায় ছিল না। আলহেলাল ক্লাব থেকে আমরা বহুবার ৪ ফুট ১০ ইঞ্চির খেলায় অংশ নিয়েছি। শুরুর দিকে মাজায় বেল্ট বেঁধে দু-এক বার আমি খেলায় অংশ নিয়েছি। পরে আর আমার জায়গা হয়নি। ৪ ফুট ১০ ইঞ্চির টিমে বাবর ছিল আমাদের ম্যারাডোনা, পেলে, মেসি, রোনাল্ডোর মতো। একবার ঘারিন্দায় কার্তিক বসাকের ৪ ফুট ১০ ইঞ্চি টিমের সঙ্গে সিল দিয়ে খেলা দিয়েছিলাম। সেখানে আমরা ৩ বা ৪ গোলে জিতেছিলাম। সেদিন বাবর একাই দিয়েছিল ৫ গোল। ওকে আমরা দুই-আড়াই মাইল তিন-চার জনে কাঁধে করে এনেছিলাম। বড় হয়ে ছেলেমেয়ে কোলেকাঁধে নিলে যেমন মনে হতো, বাবরকে আমরা যখন কাঁধে নিতাম অন্যদের কেমন লাগত বলতে পারব না, আমার ছেলেমেয়েদের কাঁধে নেওয়ার মতোই লাগত।

     লেখক : রাজনীতিক।

সর্বশেষ খবর