মঙ্গলবার, ১১ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

লীগে-দলে এক্সট্রাদের বাড়তি কদর

মোস্তফা কামাল

লীগে-দলে এক্সট্রাদের বাড়তি কদর

গত মার্চ ছিল স্বাধীনতার মাস। মহান স্বাধীনতার মাসে আরও মহান হয়ে উঠেছিলেন বড় দুই দলের খুচরা দোকানিরা। যেন আরও স্বাধীন সার্বভৌমও। প্রেস ক্লাব, রিপোর্টার্স ইউনিটিসহ রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় তাদের মজমা ছিল প্রায় প্রতিদিনই। তাদের অনেকেরই ঠিকানা ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউর আওয়ামী লীগ কার্যালয়। ওজন বাড়াতে কোনো কোনোটির সাইট অফিস রয়েছে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার ধানমন্ডি তিন নম্বর কার্যালয়ের আশপাশে।  দোকানগুলোর বেশির ভাগের নামের সঙ্গে ব্যবহার করা হয় আওয়ামী, লীগ, বঙ্গবন্ধু, নৌকা, জয় বাংলা,  দেশ,  মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতা, প্রজন্ম, একাত্তর, চেতনা ধরনের শব্দ। নামকরণে বেশি বরকত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব, শেখ রাসেল, শেখ কামাল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনায়। ডিজিটাল শব্দের ডিমান্ডও ভালো। কয়েকটিতে শোভা পায় প্রধানমন্ত্রীপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের নামও। পোস্টার-ব্যানারে বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা, সজীব ওয়াজেদ জয়ের পাশে আতি-পাতিদের ছবি। সাইজে বড় নিজের ছবিটার। এসব দোকান মালিকের কারও কারও দাপট মূল দোকানের মহাজনদের চেয়ে কম নয়। তদবির, চাঁদাবাজির সঙ্গে টেন্ডারবাজির বাজার ভালো। অনেকে বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়ে গেছেন কবেই। এসব সংগঠন মাঝেমধ্যে পদক-সংবর্ধনাও দেয়। এ ব্যবসায়ও জব্বর মুনাফা। মহানগর ও থানা কমিটিও আছে এদের কারও কারও, কয়েকটির তো আছে বিদেশ শাখাও। মরুর দেশ সৌদি আরব, কাতার, কুয়েতেও আছে কৃষক লীগ। তাঁতী লীগের শাখা রয়েছে সুদূর যুক্তরাষ্ট্রেও। ওইসব দেশে কৃষক, তাঁতী, মৎস্যজীবীদের কী কাজ আলিমুল গায়েবই জানেন। তাতে কী? বিদেশ শাখার দাওয়াতে বাংলাদেশ থেকে ছুটে যান মূল লীগের নেতারা। অথচ ওপরে ওপরে ধান্দাবাজ, চান্দাবাজ, হাইব্রিড নামে তাচ্ছিল্য করা হয় তাদের। এমন চোগলখুরিতে তারা মর্মাহত। তাচ্ছিল্যের অন্তরালে তাই এদের লাগাম টেনে না ধরে দেওয়া হয় মদদ ও বৈধতার কারসাজি। 

যদ্দুর জানি, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আওয়ামী লীগের সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম গোত্রভুক্ত সংগঠন নয়টি। এগুলো হচ্ছে : ছাত্রলীগ, জাতীয় শ্রমিক লীগ, যুবলীগ, কৃষক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ, যুব মহিলা লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ ও তাঁতী লীগ। কিন্তু প্রতি সন্ধ্যা বা রাতে অ্যাসাইনমেন্টের জন্য আসা অনুরোধপত্রের লিস্ট ভয়াবহ। শুধু বঙ্গবন্ধুর নামযুক্ত কত প্যাড যে হাতে পড়ে মনে রাখা কঠিন। যেমন : বঙ্গবন্ধু প্রজন্ম লীগ, বঙ্গবন্ধু একাডেমি, বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন, বঙ্গবন্ধু লেখক লীগ, বঙ্গবন্ধু নাগরিক সংহতি পরিষদ, বঙ্গবন্ধু গবেষণা পরিষদ, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও চেতনা গবেষণা পরিষদ, বঙ্গবন্ধু আদর্শ পরিষদ, বঙ্গবন্ধু শিশু একাডেমি, বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদ, বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদ, বঙ্গবন্ধু ডিপ্লোমা প্রকৌশলী পরিষদ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক পরিষদ, বঙ্গবন্ধু যুব পরিষদ, বঙ্গবন্ধু জাতীয় লেখক পরিষদ, বঙ্গবন্ধু ছাত্র পরিষদ, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ, বঙ্গবন্ধু বাস্তুহারা লীগ, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী হকার্স ফেডারেশন, বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারা বাস্তবায়ন পরিষদ। ভ্যান-ঠেলাগাড়ির সঙ্গেও বঙ্গবন্ধু বা লীগকে জড়ানোর বাকি নেই। চেতনায় মুজিব, আমরা মুজিব সেনা, বঙ্গবন্ধুর সৈনিকের মতো দোকানও আছে। বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের নামের সংগঠনগুলোর মধ্যে প্রায়ই চোখে পড়ে রাসেল মেমোরিয়াল একাডেমি, শেখ রাসেল শিশু পরিষদ, শেখ রাসেল শিশু সংসদ, জননেত্রী পরিষদ, জননেত্রী শেখ হাসিনা কেন্দ্রীয় সংসদ, বঙ্গমাতা পরিষদ, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব পরিষদ, ড. এম এ ওয়াজেদ ফাউন্ডেশন। এদিকে, বিএনপির বাজারদর খারাপ হলেও দোকানগুলোর মন্দ নয়। ক্ষমতার সময় একপর্যায়ে শতাধিক ছাড়ালেও এখন গোটা বিশেকের মতো। ওয়ান-ইলেভেনের ঝড়ের তোড়ে এগুলোর বেশির ভাগই উধাও হয়ে যায়। পরে নতুন উদ্যমে মাঠে নামে কয়েকটি। ক্ষমতায় না থাকায় এখন সংখ্যা কম হলেও তত্পরতা কম নয়। মূল দলের কোনো কোনো নেতা কিছুটা তাচ্ছিল্য করলেও এসব সংগঠনের ডাকা মজমায় জায়গা নেন নানাভাবে। মিডিয়া কাভারেজ বিশেষ করে টিভি স্ক্রিনে জায়গা মেলে এদের সুবাদে। স্থায়ী কমিটির সদস্য থেকে শুরু করে অঙ্গসংগঠনের শীর্ষ নেতারাও এসব আয়োজনে চেয়ার কব্জা করছেন। ওয়ান-ইলেভেনে বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ শীর্ষ নেতাদের হয়রানির প্রতিবাদে মানববন্ধন, সেমিনার, গোলটেবিল চাঙ্গা রাখে কয়েকটি দোকান। অনেকটা গর্বের সঙ্গে তখন এই দোকান মালিকরা বলতেন, বিএনপির স্বীকৃতির দরকার নেই। বিএনপির নাম-গন্ধ জিইয়ে রাখছে তারাই। দলের যুগ্ম-মহাসচিব রিজভীর নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে এদের উপস্থিতি দেখা যায় এখনো। সমসাময়িক কোনো বিষয়কে শিরোনাম করে সভা-সেমিনার ডাকে তারা। অতিথি থাকেন বিএনপির সিনিয়র নেতারা। সিনিয়র নেতার পাশে বসানোর ব্যবস্থা বাবদ অল্পকিছু খরচ করলেই হয়। বিএনপির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন রয়েছে ১১টি। এর বাইরে কেউ যেন জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া, তারেক রহমান বা বিএনপির নাম ভাঙিয়ে কর্মকাণ্ড চালাতে না পারে এমন নির্দেশনা জারি হয়েছিল। তা মিডিয়ায়ও পাঠানো হয়। সেটি এখন তামাদি। এক্সট্রা হিসেবে জিয়া পরিষদ ছাড়াও জিয়া ব্রিগেড, জিয়া সেনা, জিয়া সাংস্কৃতিক সংগঠন—জিসাস, জিয়া স্মৃতি সংসদ, জিয়া নাগরিক ফোরাম, জিয়া আদর্শ একাডেমি, জিয়া সাইবার ফোর্স, জিয়া মঞ্চ তত্পর। বেগম খালেদা জিয়ার নামযুক্ত দোকানের মধ্যে রয়েছে দেশনেত্রী পরিষদ, দেশনেত্রী সাংস্কৃতিক পরিষদ। এর বাইরে হৃদয়ে বাংলাদেশ, জাতীয়তাবাদী মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম, সচেতন নাগরিক পরিষদ, জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক দল, চেতনায় ’৭১, চেতনায় মুক্তিযোদ্ধা, আমরা ’৭১, গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক জোট, প্রজন্ম একাডেমির মতো কয়েকটি। এ ছাড়া রয়েছে স্বাধীনতা ফোরাম, জাগ্রত জনতা ফোরাম, গণতান্ত্রিক ঐক্য ফোরাম, সুশীল ফোরাম, বাংলাদেশ ইয়ুথ ফোরাম, ফ্রি থিঙ্কারস ফোরাম। তবে তত্পরতায় সবচেয়ে এগিয়ে স্বাধীনতা ফোরাম। এটির একক মালিকানা আবু নাসের মোহাম্মদ রহমতুল্লাহর। ডা. মতিনের বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির মহাসচিব থেকে বিএনপিতে যোগদানকারী রহমতুল্লাহ প্রায়ই কোনো না কোনো এন্তেজাম করছেন। দলের নেতাদের কেউ কেউ মনে করেন বাজারের হালচাল বিবেচনায় আরও কিছু সংগঠন গজানো দরকার। এর মধ্যে অবশ্যই থাকতে হবে নারীদের দোকান। মাশা আল্লাহ।

লেখক : সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর