বুধবার, ১২ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

আমাদের সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য

রেজাবুদ্দৌলা চৌধুরী

আমাদের সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য

অন্যায়কে সহ্য না-করাই বাঙালি সংস্কৃতি। পাকিস্তানের পূর্বাংশের বাসিন্দা ছিলাম আমরা। তখন শাসকরা বলেছিল, বাঙালির রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। গোটা পাকিস্তানে পূর্বাংশের বাঙালিরা ছিল গরিষ্ঠ। গরিষ্ঠের ভাষার দ্বারাই উন্নত হয় সংস্কৃতি। সেই সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করে রাষ্ট্রভাষা বাংলা পেলাম ১৯৫২ সালে।  তারই ধারাবাহিকতায় সংগ্রাম করতে করতেই আমরা পেলাম স্বাধীন বাংলাদেশ। স্বাধীনতাকে ঘিরে বাঙালির ইতিবাচক স্বপ্ন ছিল নানারকম। নতুন রাষ্ট্রের সাধ যত ছিল সাধ্য তত ছিল না। ফলত নাগরিক মনে দেখা দেয় স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা। এরই মধ্যে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্মমভাবে সপরিবারে নিহত হলেন। ক্ষমতার পটপরিবর্তন হলো। কয়েকবারের পটপরিবর্তনের মধ্যেই আবির্ভূত হলেন, স্বনামখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল জিয়াউর রহমান বীরউত্তম। তিনি এ জাতিকে পুনরুদ্ধারে এগিয়ে এলেন। এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি থেকে দেশকে বাঁচালেন। তিনি জাতীয় সংস্কৃতির স্বকীয়তা রক্ষাকল্পে নানাবিধ গঠনমূলক পদক্ষেপ নিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর সামরিক যোদ্ধা থেকে তিনি হলেন এক জাতীয় নেতা, এক সফল রাষ্ট্রনায়ক।

জিয়াউর রহমান ‘এপার বাংলা ওপার বাংলা’ স্লোগনের অসারতা উপলব্ধি করে আমাদের সংস্কৃতি মাধুর্যগুলো বিকশিত করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিলেন। এতে করে আমরা আমাদের সংস্কৃতি বৈশিষ্ট্য ধারণ করতে থাকলাম। অনুভব করলাম আমরা একটি বাংলাদেশি জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা, মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র লড়াইয়ে অকাতরে নিজ জাতির মানুষের রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়ে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি, এর সঙ্গে ওপার-বাংলার বাঙালিদের অবস্থানগত ফারাক আকাশ-পাতাল এবং বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের পক্ষে জিয়াউর রহমানের ব্যাপক অধ্যয়নের মাধ্যমে আরও প্রমাণ করলেন— আমরা বাংলাদেশের বাঙালিরা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির স্বকীয়তা রক্ষায় যা পেরেছি তা আর কোনো দেশে অবস্থানরত বাংলাভাষী মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। এ দৃষ্টিভঙ্গিকে আবুল মনসুর আহমদসহ প্রখ্যাত বাংলাদেশি-জাতীয়তাবাদ অনুসরণকারী অন্য বুদ্ধিজীবীরাও সমর্থন জানালেন।

ভারতের বাঙালিদের সংস্কৃতি ভাবনা নিয়ে যে অবস্থান তা যদি অধ্যয়ন করি আমরা তাহলে দেখতে পাব, তাদের সামগ্রিক জীবনাচার, জীবন-সংস্কৃতি তার সঙ্গে আমাদের বাংলাদেশি বাঙালিদের  অবস্থানের কোনো মিল নেই। আমাদের ৯০ শতাংশ মুসলিম-অধ্যুষিত দেশটির নিজস্ব সংস্কৃতি কখনই পশ্চিমবঙ্গের (ভারতীয় অঙ্গরাজ্য) বাঙালিদের একই ধরনের হতে পারে না। সবারই জানা সোয়াশ কোটি মানুষের ভারতে ১০ কোটি বাঙালির অবস্থান নিতান্তই অনুজ্জ্বল। খোদ পশ্চিমবাংলায় বাংলা ভাষার ব্যবহার খুবই সীমিত, হিন্দি ও ইংরেজির ব্যবহার ব্যাপক, কলকাতা শহরে চলাচলের সময় মনে হবে না এটা একটি বাংলাভাষী অধ্যুষিত রাজ্যের রাজধানী। হিন্দি ও ইংরেজির ব্যবহার এতটাই দাপটের সঙ্গে চলমান যে, বাঙালিরা সেখানে অত্যন্ত অসহায়। ব্যবসায়-বাণিজ্য বেশির ভাগই অবাঙালিদের নিয়ন্ত্রণে। ফলে দৈনন্দিন জীবনে পশ্চিমবাংলার বাঙালিদের সার্বিক জীবন-সংস্কৃতি আর আমাদের স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের বাঙালিদের জীবন সংস্কৃতি পুরোপুরি ভিন্ন এবং সেটাই বাস্তবতা, যার অন্যথা হওয়াটা অসম্ভব। আরেকটি বিষয় বিবেচ্য— আমাদের বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ৯০ শতাংশ মুসলিম দেশের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য এবং ভিন্ন ধর্মীয় সংস্কৃতির পৃথক বাংলাভাষী অঞ্চলের অবস্থানের মাঝে বিশাল ব্যবধান থাকাটাই স্বাভাবিক, থাকতে বাধ্য। এটা এক সহজ ও স্বাভাবিক বাস্তবতা যে, ১৯৪৭ সালের ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী শক্তির কবলমুক্ত হয়ে পূর্ববাংলা স্বাধীন একটা ভূখণ্ডের অংশ হওয়ায় আমাদের বাংলাভাষী নাগরিকেরা মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রের মধ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত করার লড়াই চালানোর একটা সুযোগ পায়। একই বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য যে, অন্য কোনো ভূসীমানার বাংলাভাষী নাগরিকদের পক্ষে এ সুযোগ অর্জন পুরোপুরি অসম্ভব ছিল। বাংলাদেশ রাষ্ট্রে বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক যে স্বতন্ত্র সংস্কৃতি তাতে নিজস্ব ধারা সৃষ্টি হয় একাত্তরের স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে।

একাত্তরের স্বাধীনতা অর্জন আমাদের পদ্মা-মেঘনা-যমুনাবিধৌত অঞ্চলে একটা স্বাধীন-সার্বভৌম ভৌগোলিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছে যেখানে বাংলা ভাষা ও স্বকীয় সংস্কৃতি একটি পরিশীলিত নিজস্ব-ধারায় প্রবাহিত সুযোগ আমরা বাংলাদেশি বাঙালিরা পেয়েছি, যে সুযোগ বিশ্বের অন্য কোনো অঞ্চলের বাংলাভাষীদের পাওয়ার সম্ভাবনা নেই কখনো। জিয়াউর রহমান আমাদের সেই বিশেষ অর্জনটির সঠিক মূল্যায়ন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

বস্তুত, আমাদের ভাষা আন্দোলন যে মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠার একটি শক্তিশালী আন্দোলনে রূপলাভ করে তাই আমাদের পরবর্তীকালের রাজনৈতিক সংগ্রামের মূল ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

সেই আন্দোলন বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ষাট দশকের স্বাধিকার সংগ্রাম হয়ে সত্তর দশকের শুরুর স্বাধীনতা যুদ্ধ অবধি যে রাজনৈতিক সংগ্রাম তারপরে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ সবকিছুর মূলে আমাদের নিজস্ব এক সংস্কৃতি সাংগঠনিক কাজ করেছে এবং সেটাই বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের নিজস্ব স্বকীয় সংস্কৃতিরূপে প্রতিষ্ঠা পায়। এ সাংস্কৃতিক স্বকীয়তার মধ্যে আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ-জনতার ধর্মাচার, দৈনন্দিন জীবনাচার, আমাদের খাদ্যাভ্যাস, সার্বিক জীবনযাপন এক স্বাতন্ত্র্যের বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করে তা অনস্বীকার্য। তবে এ বাংলাদেশ আমাদের মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ও প্রায় অর্ধশত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী অধ্যুষিত একটি রাষ্ট্র যেখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিদ্যমান শতভাগ। আমরা মুক্তাগাছার হিন্দু-মিষ্টি-শিল্পীর মণ্ডা পছন্দ করি, ঢাকার হিন্দু মিষ্টি-শিল্পী মরণ চাঁদের দোকানের মিষ্টি অন্য ধর্মাবলম্বীদের পাশাপাশি মুসলিমদেরও খুবই পছন্দ, ঢাকার সূত্রাপুরের মুসলিম মিষ্টি-শিল্পী কালা মিয়ার মিষ্টিও মুসলিমদের পাশাপাশি অন্য ধর্মাবলম্বী সবার প্রিয়। আমাদের মুসলিম ঈদ উৎসবে হিন্দু ও অন্য ধর্মানুসারীরা দাওয়াত পেয়ে স্বচ্ছন্দে অংশ নেয়, তেমনি মুসলিমরাও শারদীয় দুর্গা পূজায় বা খ্রিস্টানদের বড় দিনের উৎসবে আমন্ত্রিত হয়ে অংশ নেয়। বৌদ্ধদের অনুষ্ঠানেও মুসলিমরা অকাতরে হাসিমুখে উপস্থিত হয়। এ জীবনচর্চা বাংলাদেশের সব ধর্মের ও নৃ-গোষ্ঠীর মানুষকে এক শান্তিময় সহৃদয়তার বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। এটাই আমাদের সংস্কৃতির স্বকীয়তাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে।  দিন দিন ঋদ্ধ করছে এবং করতেই থাকবে। কোনো ব্যত্যয় যেন না ঘটে সে ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে।

আমাদের জাতীয় সংস্কৃতি আমাদের নিজস্ব, তার স্বকীয়তা আমাদের জাতিরাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে নিশ্চিত করতে পারে নিরঙ্কুশভাবে, এর কোনো বিকল্প নেই। তাই আমাদের মনেপ্রাণে হতে হবে— বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক স্বকীয় সংস্কৃতির ধারক-বাহক, শতভাগ— জাতীয়তাবাদের চেতনায়। সেটিই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা।

লেখক : বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর সাবেক তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক।

সর্বশেষ খবর