বুধবার, ১২ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

নববর্ষের পান্তা-ইলিশ

তপন কুমার ঘোষ

নববর্ষের পান্তা-ইলিশ

এখন চৈত্রের শেষ। ক’দিন পরই বৈশাখের শুরু। এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে বাংলা নববর্ষ ১৪২৪ উদযাপনের প্রস্তুতি।  এখন চলছে বৈশাখের কেনাকাটা। বিপণি বিতানগুলোতে এখন বৈশাখী হাওয়া। ক্রেতার ভিড়ে ঠাসা। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নববর্ষ ভাতা চালু হয়েছে গত বছর থেকে। ফিবছর বড় হচ্ছে নববর্ষের অর্থনীতি।

নববর্ষ বাঙালির প্রধান সামাজিক উৎসব। এক সময় রাজধানীসহ বড় কয়েকটি শহরে সীমাবদ্ধ ছিল নববর্ষের অনুষ্ঠান। কিন্তু এখন এর বিস্তৃতি ঘটেছে। মফস্বলের ছোট-বড় সব শহরেই ছড়িয়ে পড়েছে এ উৎসব। পাড়া-মহল্লায় ছোট-বড় নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নববর্ষকে বরণ করে নেওয়া হবে। গ্রামগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে বসবে বৈশাখী মেলা।

পহেলা বৈশাখ সরকারি ছুটির দিন। এদিন সকাল থেকেই বর্ষবরণের উৎসবে মেতে উঠবে দেশ। প্রভাতী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সেই সাতসকালেই বৈশাখী সাজে বেরিয়ে পড়বেন অনেকেই। একদিনের জন্য হলেও বাঙালি সাজবেন।

নববর্ষে মানুষ প্রকৃতির কাছে আসতে চায়। তাই বর্ষবরণের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয় উন্মুক্ত স্থানে-পার্কে অথবা উদ্যানে। আমাদের জীবনে প্রকৃতি এতটাই প্রাসঙ্গিক যে, কর্মক্লান্ত মানুষ সুযোগ পেলেই ছুটে যান সমুদ্রের কাছে, পর্বতের কাছে। এবারও এর ব্যতিক্রম হবে না। দেশের পর্যটন ও বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে ভিড় জমাবেন লাখো মানুষ। ক্লাব-সমিতিগুলো নববর্ষ উদযাপন করবে নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। বর্ষবরণের এ আয়োজনে ভূরিভোজের ব্যবস্থা তো থাকবেই।

পহেলা বৈশাখে এক শ্রেণির বিত্তবান মানুষের মাঝে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার বিলাসিতা লক্ষ করা যায়। নববর্ষের মুখে বাজারে ইলিশ এখন উত্তাপ ছড়াচ্ছে। প্রতি বছর এমনটিই হয়। বিক্রেতারা ইলিশের দাম হাঁকাচ্ছেন ইচ্ছামতো। চড়ামূল্যে তা বিকাচ্ছেও। এক শ্রেণির ক্রেতার কিচেনে এবং বড় বড় হোটেল-রেস্তোরাঁয় সরাসরি পৌঁছে যাচ্ছে শখের ইলিশ। মিডিয়া কর্মীরা ইলিশের বাজার দরের ওপর নজর রাখছেন। দিনকয়েক ব্যস্ত থাকবেন ইলিশের উচ্চমূল্য নিয়ে রিপোর্ট করতে। ইলিশের নাম শুনলে যাদের জিভে জল আসে তারা ছুটবেন নামিদামি হোটেল-রেস্তোরাঁয়, তা দাম যাই হোক না কেন। উৎসব এখন এক শ্রেণির মানুষের অর্থ-বিত্ত প্রকাশের উপলক্ষ হয়ে উঠেছে, যা অনেকের মনঃকষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মাধ্যমে অর্থনীতির অন্তর্নিহিত বৈষম্যই প্রকাশ পাচ্ছে। আমাদের অর্থনীতি ক্রমশ বিকশিত হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু আয় বৈষম্য রয়েই গেছে। বৈষম্যের কারণে নববর্ষের এ সর্বজনীন উৎসব কতটা সর্বজনের হয়ে উঠেছে, সে প্রশ্ন আজ উঠে আসছে। ধনী-নির্ধন সব মানুষের অংশগ্রহণ ছাড়া উৎসব অর্থবহ হয় না। সমাজের বঞ্চিত মানুষের জন্য বেদনাদায়ক হয় এমন কোনো আচরণ সঙ্গত আচরণের পর্যায়ে পড়ে কিনা তা সমাজের বিত্তবানদের একবার অন্তত ভেবে দেখা দরকার।

এটা ইলিশের মৌসুম নয়। বর্ষাকাল হচ্ছে ইলিশের ভরা মৌসুম। জাটকা নামে পরিচিত ‘খোকা ইলিশ’ এখন ধরা পড়ছে জালে। জাটকা ধরা নিষিদ্ধ। সেদিন পত্রিকায় পড়লাম, ঢাকার এক মাছের আড়তে অভিযান চালিয়ে কয়েক টন জাটকা জব্দ করা হয়েছে। দুজনকে কারাদণ্ড এবং জরিমানাও করা হয়েছে। মা ইলিশ ধরা ও জাটকা নিধন বন্ধে সরকারি পদক্ষেপে গেল বছর হাতেহাতে ফল পাওয়া গেছে। বাজারে ইলিশের প্রচুর আমদানি হওয়ায় ‘সুলভ মূল্যে’ ইলিশ কিনে ক্রেতারা রসনা তৃপ্ত করেছেন।

আমাদের গ্রামীণ সমাজে এক সময় পান্তার চল ছিল। রাতের উদ্বৃত্ত ভাতে জল ঢেলে রাখা হতো যেন পচন না ধরে। খুব ভোরে কৃষক কাঁচা লঙ্কা আর পিঁয়াজ সহযোগে পান্তা খেয়ে মাঠে যেতেন হাল চাষ করতে। কিন্তু পান্তা-ইলিশের চল কোনো কালেই ছিল না।

আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতিতে জোয়ার এসেছে। কিছুই আর আগের মতো নেই। এখন অনেক পরিবর্তন চোখে পড়ে। মাটির তৈজসপত্রের জায়গা দখল করে নিয়েছে অ্যালুমিনিয়াম, মেলামাইন আর প্লাস্টিক সামগ্রী। গ্রামের কৃষক এখন আর বাসি পান্তা খেয়ে কাজে যান না। সকালে ভিড় করেন চায়ের দোকানে। টোস্ট বিস্কুট আর গরম চা খেয়ে দিনের কাজ শুরু করেন। পহেলা বৈশাখে মাটির পাত্রে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার শখ অন্য অনেকের কাছেই আদিখ্যেতা বই কিছু নয়।  জাতীয় মাছ রুপালি ইলিশকে নির্বংশ করার হাত থেকে রক্ষা করতে হলে মা ইলিশ এবং জাটকা ধরা বন্ধের চলমান অভিযানের পাশাপাশি এই আদিখ্যেতারও অবসান কাম্য।

লেখক : সাবেক উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক, জনতা ব্যাংক লিমিটেড।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর