বৃহস্পতিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

বৈশাখকে ঘিরে ভাবনা

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

বৈশাখকে ঘিরে ভাবনা

সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ অর্থনীতির সার্বিক উন্নয়ন প্রয়াসে জাতীয় বাজেটকেন্দ্রিক মতবিনিময় সভাসমূহে আলোচনায় বাংলাদেশের অর্থবছরের মেয়াদ পুনর্নির্ধারণের প্রস্তাব উঠে আসছে। পয়লা বৈশাখ থেকে অর্থবর্ষ গণনার প্রথা প্রবর্তন করেছিলেন মোগল সম্রাট আকবর মূলত রাজস্ব আহরণ তথা অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেই। ইতিপূর্বেকার চান্দ্র মাসের ভিত্তিতে প্রচলিত হিজরি সন এবং সৌরবর্ষ গণনার পদ্ধতি প্রক্রিয়ার মধ্যে সমন্বয় ও সাযুজ্য সাধনের তাৎপর্য ও যৌক্তিকতাকে বিচার-বিশ্লেষণের ভার তার নবরত্ন সভার সবচেয়ে বিজ্ঞ বিচক্ষণ সদস্য, মশহুর ইতিহাসবেত্তা আবুল ফজল (১৫৫১-১৬০২) এবং অর্থ ও রাজস্ববিষয়ক সদস্য রাজা তোডর মলকে তিনি অর্পণ করেছিলেন এ বিবেচনায় যে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডই রাজ্য কিংবা সরকারের অন্যান্য কর্মকাণ্ডের ওপরে অধিষ্ঠান, নিয়ন্ত্রক ও প্রভাবক ভূমিকায় থাকে। তাদের নির্দেশনায় ফতেহ উল্লাহ সিরাজী যে সমন্বিত প্রস্তাব প্রণয়ন করেন সে ভিত্তিতে ফসলি সন নামে নতুন বর্ষগণনার রীতি প্রবর্তিত হয় ৫৯৪ হিজরি সনের জুলিয়ান ক্যালেন্ডার মোতাবেক ১২ এপ্রিল, গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার মোতাবেক ১৪ এপ্রিল, সোমবার। প্রবর্তনের খ্রিস্টীয় সনটি ১৫৮৪ হলেও ফসলি সনের প্রবর্তক সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহণের সন ১৫৫৬ থেকে এর ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা প্রদান করা হয়। প্রজাদের উৎপাদিত ফসলের ওপর সেস বা কর রাজস্ব আরোপ, হিসাবায়ন এবং যথা মৌসুমে তা সংগ্রহের সুবিধার্থে মূলত ফসলি সনের প্রবর্তন। এই ফসলি সনই পঞ্জিকা তথা অর্থবছর হিসেবে বিবেচিত হতো। ভারতের দিল্লিতে বসে প্রবর্তিত রাজস্ব আয় ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ নির্দেশক এই ফসলি সনই পরবর্তীকালে সুবা বাংলায় (বর্তমানের বাংলাদেশ) বঙ্গাব্দ বা বাংলা সন হিসেবে অব্যাহতভাবে ব্যবহূত হয়ে আসছে।

মোগলের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে রাজস্ব আহরণের উদ্দেশ্য অভিপ্রায় ও প্রক্রিয়া ছিল মূলত বেনিয়া বাণিজ্য বোধ বিশ্বাসের ভিত্তিতে। সে সময় আর্থ-প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে ফসলি সনের ব্যবহারিক গুরুত্ব হ্রাস পায়। তৎকালীন ব্রিটিশ ভাবধারায় অর্থবছর পৃথকভাবে গণনার রেওয়াজ চালু হয়। বাংলার প্রজাদের শস্য উৎপাদনের মৌসুমের সঙ্গে মিলিয়ে রাজস্ব আহরণের দৃষ্টিভঙ্গিতে আসে পরিবর্তন। মুনাফা ও রাজস্বলোভী মুত্সুদ্দি মানসিকতার কাছে বাঙালির আবহমানকালের শাশ্বত সংস্কৃতির ধারকবাহক হিসেবে অর্থবছর হিসেব বাংলাসন অনুসরণে চিড় ধরে। গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকাবর্ষের বিপুল ব্যবহার ফসলি সনের কদরকে ফিঁকে করে দেয় আর পুরো আর্থ-প্রশাসনিক অবস্থা ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন মাত্রা দান করে। কোম্পানি বাংলার মৌসুমি জলবায়ু তো দূরের কথা ফসল উৎপাদনের সময়সূচিকে রীতিমতো অবজ্ঞাভরে দেখতে শুরু করে। 

১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের পর ভারতের রাজদণ্ড কোম্পানির হাত থেকে খোদ ব্রিটিশ সরকারের হাতে চলে যায়। ওয়েস্টমিনস্টার পদ্ধতিতে পরিচালিত ভারতে ব্রিটিশ সরকারের প্রথম বাজেট আনুষ্ঠানিকভাবে আইনসভায় পেশ করা হয় ৭ এপ্রিল ১৮৬০। অর্থবছরের ধারণাটা বাংলা সনের অনুগামী রাখার পক্ষপাতী ছিলেন ভারতবর্ষে প্রথম অর্থমন্ত্রী জেমস উইলসন (১৮০৫-১৮৬০)। স্বনামধন্য ‘ইকনোমিস্ট’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বিভাগের সচিব, অর্থ সচিব, ব্রিটিশ আইনসভার প্রভাবশালী সদস্য, ফ্রি ট্রেড আন্দোলনের কর্মী, পেপার কারেন্সির প্রবর্তন প্রবক্তা জেমস উইলসন ভারতে ভাইসরয়ের কাউন্সিলে অর্থ সদস্য (মন্ত্রী সমতুল্য) হিসেবে নিযুক্তি পেয়ে কলকাতায় যোগদান করেন ১৮৫৯ এর ২৯ নভেম্বর। সিপাহি বিদ্রোহের পর ভারতে নতুন ব্রিটিশ সরকারের আর্থিক সংকটের মোকাবিলায় উইলসনকেই উপযুক্ত ভেবেছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী Lord Palmerston। ইতিহাসসচেতন বিচক্ষণ অর্থনীতিবিদ উইলসন ভারতের আর্থ-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা নিয়ে ১৮৬০-এর ৭ এপ্রিল উপস্থাপিত ভারত সরকারের প্রথম বাজেট বক্তৃতায়ই ভারতে আধুনিক আয়কর প্রবর্তনের প্রস্তাব করেন। প্রাচীন ভারতের মনুসংহিতা থেকে রাজস্ব আদায়ের সূত্র উল্লেখ করলেও তিনি মূলত ব্রিটেনের আয়কর আইনের কাঠামোয় এদেশে আয়কর আরোপের রূপরেখা দেন। এপ্রিল মাস থেকেই তার বাজেটটির বাস্তবায়ন শুরু হয়ে যায়, প্রচলিত বাংলা সনের সঙ্গে ছিল যার যৌক্তিক সাজুয্য। পরিতাপের বিষয়, ভারতে ব্রিটিশ সরকারের প্রথম অর্থমন্ত্রী, ভারতে আধুনিক আয়কর প্রবর্তনের মাত্র তিন মাসের মাথায় ডিসেন্ট্রিতে ভুগে মারা যান আগস্ট মাসের ১১ তারিখে, কলকাতায়ই। পরবর্তী চার বছর বাজেট এপ্রিল মে এমনকি জুন মাসে উপস্থাপিত হলেও ১৮৬৫ সাল থেকে স্থায়ীভাবে ১ এপ্রিল থেকে অর্থবছর শুরুর বিধানটি কার্যকর হয়।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর ভারতীয় প্রজাতন্ত্র ১ এপ্রিল-৩১ মার্চকে অর্থবছর অনুসরণ অব্যাহত রাখে, কিন্তু পাকিস্তান সরকার জুলাই-জুনকে অর্থবছর সাব্যস্ত করে। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসনে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রাধান্য থাকায় পূর্ব বঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তান বা বর্তমানের বাংলাদেশ প্রাদেশিকতায় পর্যবশিত হয়। সুতরাং বাংলার কৃষি ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মৌসুম অনুগামী বাংলা সন অর্থবছরের সাজুয্যতায় মর্যাদার প্রশ্নে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। সে সময় পশ্চিম পাকিস্তানের কৃষি বা উৎপাদন মৌসুম অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সবকিছুই ছিল পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভিন্ন। সে কারণে এপ্রিল-মার্চ এর স্থলে জুলাই-জুন কে অর্থবছর সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সিদ্ধান্তই একচ্ছত্র হয়ে যায়। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলে অর্থবছরকে বাংলার আবহমান সংস্কৃতির প্রতিফলক বাংলা সনের অনুগামীকরণের বিষয়টি যৌক্তিক বিবেচনায় এসেও যেন আসেনি। দুঃখজনকভাবে পাকিস্তান আমলে প্রবর্তিত জুলাই-জুন এখনো বাংলাদেশের অর্থবছর হয়ে আছে। উপযুক্ত কারণ পরীক্ষা পর্যালোচনা করে এটি পরিবর্তনের আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্যোগ গ্রহণের আবশ্যকতা অনুভূত হয়।

বাংলাদেশের মৌসুমি আবহাওয়া ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বার্ষিক কর্মযোজনার নিরিখে এটা খুবই স্পষ্ট যে, জুলাই-জুন অর্থবছর হিসেবে যোগ্যতর নয়, হতে পারে না। বাংলাদেশে অর্থবছর শুরু হয় ১ জুলাই বা ১৬ আষাঢ়, ভরা বর্ষা আর শেষ হয় ৩০ জুন বা ১৫ আষাঢ়। বিদ্যমান অর্থবছর শুরু হয়েই প্রথম তিন চার মাস বর্ষাজনিত কারণে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড শুরু করা যায় না। আয়কর আইন অনুযায়ী আগের অর্থবছর শেষ হওয়ার তিন মাসের মাথায় ঠিক এ সময়টাতে আয়কর প্রদানের বাধ্যবাধকতা চলে আসে, আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে প্রায়শ বড় বন্যা তথা প্রাকৃতিক দুর্যোগ অর্থনৈতিক জীবনযাত্রায় দুর্গতি বয়ে আনে এবং এ সময়টা ফসল বপনের, ফসল তোলার নয়; ফলে আয়কর হিসাবায়ন, পরিশোধ তথা রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতায় বিব্রত বোধ করে রাজস্ব প্রদানকারীরা, নানা কারণে প্রায় প্রতিবছর আয়কর প্রদানের সময় বাড়ানোর দাবি ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে গত অর্থবিলে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত স্থায়ীভাবে সময় বাড়ানো হয়েছে। অর্থবছর শেষ হওয়ার পর ৩ মাসের স্থলে ৫ মাস পর্যন্ত সময় বাড়ানোর ফলে সামস্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় টানাপড়েন সৃষ্টির সম্ভাবনা পরিব্যাপ্ত হতে পারে ।   

অর্থবছরের প্রথম তিন-চার মাস এক ধরনের কর্মহীন অতিবাহিত হওয়ার পর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ হাতে নেওয়া হয়। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে কার্য কিংবা সরবরাহের আদেশ দিতে দিতে এপ্রিল-মে। সরবরাহ সেবা কিংবা ভৌত কর্মকাণ্ড শুরু যখন হয় তখন বর্ষা শুরু হয়ে যায়। কাজের, সরবরাহের, সম্পাদনের গুণগতমান বজায় রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়ায় বাংলাদেশের বর্ষাকালে। এ সময় মেরামত সংস্কার কাজে জনভোগান্তি যেমন বাড়ে, কাজের গুণগতমান পরিবীক্ষণেও ঘটে বিপত্তি। অর্থবছরের শেষে বরাদ্দ অনুযায়ী কাজ শেষ করার তাগিদে কিংবা প্রকল্প বাস্তবায়ন দেখানোর জরুরিয়তায় নানা অনিয়ম-অনৈতিকতার আশ্রয় নেওয়াটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। অনিচ্ছাসত্ত্বেও এ সময়টায় অপব্যয়-অপচয়ের অবকাশ হয় অবারিত। শুধু কৌশলগত অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের অর্থবছরের পাঁচ-ছয়টি মাস অর্থনীতির জন্য অনুকূল না হয়ে প্রতিকূল হয়ে ওঠে।           

অথচ অর্থবছরের এই ব্যাপ্তিটা জুলাই-জুনের পরিবর্তে যদি এপ্রিল-মার্চ (বাংলা সনের কাছাকাছি) হয় তাহলে প্রথম মাসেই কাজ শুরু করে পরবর্তী তিন-চার মাস বর্ষাকালে আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন ব্যয় করে অক্টোবর-মার্চ এই ছয় মাস পুরোটাই নিরবচ্ছিন্নভাবে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজে পরিপূর্ণ ব্যবহার সম্ভব হতে পারে। বাংলাদেশের জন্য এই সময়টিই সব কাজের জন্য অনুকূল, সহনশীল ও উৎপাদনমুখী। ব্যক্তি ও ব্যবসা উভয় শ্রেণির করদাতার জন্যও মে-জুন মাসে করের হিসাবায়ন, কর প্রদান তথা রিটার্ন দাখিলে বিড়ম্বনা স্বাভাবিকভাবে হবে কম। কৃষিপ্রধান অর্থনীতির এই দেশে উৎপাদন মৌসুম, অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে আবহাওয়া ও আবহমান সংস্কৃতির সুসময়কে শনাক্ত করেই অর্থবছরের ব্যাপ্তিকাল নির্ধারিত হওয়া উচিত।

লেখক : সরকারের সাবেক সচিব এবং এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান।  

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর