বৃহস্পতিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা
কলকাতার চিঠি

মমতা ব্যানার্জির উদ্দেশ্য কী

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

মমতা ব্যানার্জির উদ্দেশ্য কী

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি এলেন, চার দিন সফর করে ঢাকায় ফিরে গেলেন। তার আসার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল উভয় দেশের মধ্যে তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন করা। যা শুরু করেছিল ইউপিএ সরকারের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং। ভারতের প্রধানমন্ত্রী হাসিনাকে পাশে বসিয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিশ্রুতি দিলেন তিস্তা চুক্তি হবেই। পাশে ছিলেন মমতা ব্যানার্জিও। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা যেতে না যেতেই দিল্লিতে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে হাসিনার সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে এসে সাংবাদিকদের বললেন, তিস্তা নয়, কিছুতেই নয়। আমার বিকল্প প্রস্তাব। তোরসা থেকে বাংলাদেশকে জল দেওয়া হোক।

হঠাৎ তিনি এ কথা কেন বললেন, তা নিয়ে ভারতের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তিস্তা-তোরসার পার্থক্যটাই বোঝেন না বা না বোঝার ভান করেছেন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিতর্ক তৈরি করার জন্য। তোরসার উৎপত্তি ভুটানে। তিস্তার উৎপত্তি ভারতের সিকিম রাজ্যে। সেক্ষেত্রে তিনি কী চাইলেন। তৃতীয় পক্ষকে এনে বিরোধটাকে জিইয়ে রাখতে। কেন? এই প্রশ্নের জবাব ইতিমধ্যে কূটনৈতিক মহলে আসতে শুরু করেছে।

ভুটান একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ এবং সার্কের সদস্য। ভুটানের সঙ্গে তিনি কি এ ব্যাপারে কোনো কথা বলেছেন? ভুটানের কলকাতার কনস্যুলেটের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ডেপুটি কনসাল জেনারেল বলেন, আমরা কাগজেই দেখলাম। আমরা তো কিছুই জানি না। তিনিও বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, এ ব্যাপারে মমতা যা বলেছেন, তার উত্তর দিতে পারবে থিম্পু। আর তোরসার উৎপত্তি যেহেতু ভুটানে। উত্তরবঙ্গের হাসিমারা এবং জলদাপাড়া হয়ে জল পশ্চিমবঙ্গে ঢোকে।

উত্তরবঙ্গে বসবাসকারী সাধারণ লোকই নয়, বাংলাদেশে সুপরিচিত সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার বলেছেন, তোরসা নদীতে বছরে মাত্র তিন মাস জল থাকে। বাকি নয় মাস শুষ্ক থাকে। তখন এপার-ওপার যাতায়াত করা হয়। মমতার এই প্রস্তাব দেখে মনে হচ্ছে ভাতের বদলে ফ্যান। ভারতের কূটনৈতিক মহল মনে করে, গোটা সমস্যাটা মমতা জিইয়ে রাখতে চান। কেন জিইয়ে রাখতে চান, তার ব্যাখ্যাও পাওয়া গেছে। মমতার মদদদাতা এবং কোনো পশ্চিমি দেশ বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ এবং হাসিনা সরকার পুনরায় যাতে জনগণের রায় নিয়ে ক্ষমতায় ফিরতে না পারে সেই উদ্দেশে মমতা বিষয়টি জট পাকিয়ে দিলেন।

উল্লেখ করা যেতে পারে, ২০১১ সালে মমতা বাধা দেওয়ায় ড. মনমোহন সিং খালি হাতে ফিরে আসার পর তৃণমূলের একাধিক নেতা বিবৃতি দিয়ে সংবাদ মাধ্যমকে বলেছিলেন, হাসিনাকে জেতানোর জন্য আমরা তিস্তা চুক্তি করতে দেব না। তখন তাদের পাল্টা প্রশ্ন করা হয়েছিল, তাহলে বাংলাদেশের কোন দলকে আপনাদের পছন্দ। তার উত্তর না দিয়ে বলেছিলেন, আপনারা বুঝে দেখুন। এখন সাত বছর পর সেই কথাই মনে পড়ছে। তোরসা নদী যেহেতু ভুটানের। সুতরাং ভুটানকে জড়িয়ে দিয়ে মমতা কী ফায়দা লুটতে চাইছেন, এ প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, তার এবং হাসিনা ক্ষমতায় থাকার মধ্যেই তারা এই চুক্তি করতে চান। ভারতের রাষ্ট্রপতি মমতাকে খুব স্নেহ করেন।

কংগ্রেস মহলের খবর— প্রণব মুখার্জি তার এই একগুঁয়েমি ত্যাগ করে ভারতের প্রাক্তন ও বর্তমান সরকার যা চাইছে তাতে সায় দিয়ে উভয় দেশের মধ্যে শান্তি, সম্প্রীতি ও সহমর্মিতা সেটাই বজায় রাখতে চান। দিল্লিতে বিজেপি সূত্রে বলা হয়, মমতা নাকি প্রস্তাব দিয়েছেন তার এবং তার দলের নেতাদের বিরুদ্ধে সিবিআই যে তদন্ত করছে তা প্রত্যাহার করতে হবে। মমতার এই প্রস্তাবে মোদি তো রাজি নন, এমনকি তার দল ঘোরতর আপত্তি তুলেছে।

তারা বলেন, দুর্নীতিহীন সরকার গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মোদি ক্ষমতায় এসেছেন। সেক্ষেত্রে তারা বলেন, মমতার সঙ্গে দুর্নীতির বিষয়ে আপস করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য মনে করেন, তামিলনাড়ুর প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জয়জলিতা এবং বিহারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব যদি জেল খাটতে পারেন, তাহলে মমতা দোষী সাব্যস্ত হলে কেন জেলে যাবেন না? শমীক বাবু রাখঢাক না করেই বলেন, মমতার সঙ্গে বাংলাদেশের জামায়াত ও বিএনপির যে গোপন আঁতাত ২০০১ সাল থেকে চলে এসেছে সে ব্যাপারে মোদি সরকার সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল। তিনি হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে তাদের দেশে অপদস্থ করে বিএনপি-জামায়াতকে ক্ষমতায় আনার জন্য নবান্নে বসে যেসব ষড়যন্ত্র করছেন সে ব্যাপারে আমাদের কাছে নির্দিষ্ট তথ্য আছে। উত্তর-২৪ পরগনায় সীমান্ত এলাকাগুলোতে ওই সন্ত্রাসবাদীদের কেন আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে, কারা দিচ্ছে, তাদের ভোটার কার্ড কে করে দিচ্ছে এগুলো আমরা প্রচারে নিয়ে আসছি। হঠাৎ তিস্তা নয়, তোরসা! এই প্রসঙ্গ এলো কী করে? কী উদ্দেশ্যে তা কিন্তু এই লেখা পর্যন্ত মমতা ব্যাখ্যা করেননি। অপরদিকে মমতার আরেক মুখপাত্র অধ্যাপক দেব নারায়ণ সরকার রবিবার বলেছেন, কংগ্রেস ও সিপিএম ফারাক্কার জলবণ্টন চুক্তি করে যে অপূরণীয় ক্ষতি করেছে, আমরা চাই সে ব্যাপারে নতুন করে একটা কমিশন করে তদন্ত করা হোক। তিনি এ কথা বলেননি, বাংলাদেশে মুজিব হত্যার পরে জেনারেল জিয়া ভারতের বিরুদ্ধে নালিশ জানাতে জাতিসংঘে গিয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে এ ধরনের অনেক লোক আছেন, যারা উভয় দেশের সম্পর্ক নষ্ট করতে চান। মমতার এক মন্ত্রী বলেছেন, আমরা কয়েকটি গবেষণা কেন্দ্র করেছি। গবেষণা করে বের করা হবে পুকুরেও ইলিশ মাছ চাষ করা যায় কিনা। এখন সেই মন্ত্রী নিজেও ঠিক বুঝতে পারছেন না কী বলেছেন। এদিকে জোরদার দাবি উঠেছে তোরসা নয় তিস্তাই হোক দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক। মমতা যদি এ ব্যাপারে তার একগুঁয়েমি বজায় রাখেন তাহলে মোদি নিশ্চয়ই তার প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্য অন্য ব্যবস্থা নেবেন।

 

লেখক : প্রবীণ ভারতীয় সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর