শুক্রবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

পহেলা বৈশাখ নতুন বার্তা নিয়ে আসে

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

পহেলা বৈশাখ নতুন বার্তা নিয়ে আসে

নববর্ষ আমাদের জীবনে একবার নয়, দুবার আসে। একবার পহেলা বৈশাখে, আরেকবার পহেলা জানুয়ারিতে। এ দুয়ের ভিতর দিনক্ষণের হিসাবে একটা দূরত্ব আছে, আরও বড় দূরত্ব কিন্তু চরিত্রে। এটা মোটেই তাত্পর্যহীন নয় যে, পহেলা বৈশাখ শুরু হয় খুব ভোরে আর ফার্স্ট জানুয়ারির কাজকর্মের সূত্রপাত মধ্যরাতে। দুয়ের ভিতর চরিত্রগত তফাত্টা এ রকমেরই, সকালের সঙ্গে মধ্যরাতের।  সকালের আলোটাই স্বাভাবিক মধ্যরাতের আলো তা সে যতই উজ্জ্বল হোক, হোক বিদ্যুতের কি আতশবাজির, ওই আলো কৃত্রিম বটে। সকালে আমরা গাছপালা, পশুপাখি, ঘরের লোক, পাড়া-প্রতিবেশী সবার সঙ্গে মিলেমিশে জেগে উঠি, মধ্যরাতে বিচ্ছিন্নভাবে আলো জ্বেলে কষ্ট করে জেগে থাকতে হয়। কষ্টটাই বুঝিয়ে দেয় যে সে কৃত্রিম। কিন্তু কৃত্রিমতা এখন আক্রমণ করেছে স্বাভাবিকভাবে। জানুয়ারির পহেলা তারিখ অনেক বেশি জরুরি হয়ে উঠেছে পহেলা বৈশাখের তুলনায়। বৈশাখী হালখাতার রেওয়াজ কম, হিসাব-নিকাশটা শুরু হয় জানুয়ারি থেকেই, খানিকটা এগিয়ে তবে বৈশাখের সঙ্গে দেখা। ওই সংযোগটাতে যে খুশি হই তা নয়, বলি, উঃ বড্ড গরম।

মধ্যরাত প্রবল হচ্ছে, কোণঠাসা হচ্ছে সকালবেলা। জানুয়ারি এগিয়ে আসছে, পিছিয়ে পড়ছে বৈশাখ। ধরা যাক একুশে ফেব্রুয়ারির কথাই। একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের অতিশয় নিজস্ব দিবস, আমাদের মাতৃভাষার অধিকারের সঙ্গে জড়িত। তার উদযাপন এখন শুরু হয় মধ্যরাতে। আগে হতো সকালে। মধ্যরাত অন্ধকারই প্রধান, মধ্যরাতে নিরাপত্তার অভাব। বাংলাদেশে এখন যখন প্রখর আলো অন্ধকারাচ্ছন্ন, তখন আমরা সবাই মিলে রাতের অন্ধকারকে নিয়ে এসেছি সকালবেলাতে এবং সবাই ভুগছি নিরাপত্তাহীনতায়। এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। একে তাত্পর্যবিহীন বলার কোনো উপায় নেই। গ্রীষ্ম আমাদের স্বাভাবিক ঋতু। আমরা শীতের জন্য অপেক্ষা করি, বর্ষা এলে খুশি হই, কিন্তু জানি যে অনিবার্য হচ্ছে গ্রীষ্ম। সে আসে; স্বাভাবিকভাবেই আসে, কিন্তু এখন সে অস্বাভাবিক হয়ে পড়ছে। তার ক্ষমতা কমছে, দাপট বাড়ছে। এটাই নিয়ম। ক্ষমতা কমলে দাপট বাড়ে। বৈশাখ যতই কোণঠাসা হচ্ছে, ক্ষমতা হারাচ্ছে, ততই তার দাপট বাড়ছে। সে আচরণ করছে অস্বাভাবিক রকমের। প্রকৃতির নাতিশীতোষ্ণতা হারিয়ে যাচ্ছে গ্রীষ্মের নিচে। ধরণী তপ্ত হচ্ছে। খাল বিল হাওর জলাভূমি শুকিয়ে চৌচির। নদী কাবু দখলবাজদের অত্যাচারে। পানির দেশে পানির জন্য হাহাকার পড়ে গেছে। ওদিকে শত্রুর মতো ফুলে ও ফুঁসে উঠছে সমুদ্রের পানি। আমরা গাছপালা কেটে সাবাড় করেছি। প্রতিবেশী পাখিরা এখন যখন-তখন ডাকাডাকি করে না, তারা পলাতক অবস্থায় রয়েছে। আর মাছ? ধরা যাক ইলিশ মাছের কথা। সে ছিল গরিব মানুষের স্বাভাবিক খাদ্য, পান্তা ভাতের সঙ্গে মিশিয়ে লবণ-মরিচ ও পিয়াজসহ খেয়ে পেট ভরত, মন জুড়াত। এখন একটি ইলিশ ১৬ হাজার টাকায় নিলামে উঠেছে। আর ছোট ছোট মাছ, পুঁটি, খলসে, টেংরা, শিং বড় মাছের চেয়েও দুর্মূল্য। কিন্তু কারণ কী? কেন এই বিপদ? কে দায়ী এই অস্বাভাবিকতার জন্য? অনেক কারণের, দায়িত্বের কথা বলা যাবে, বলা হচ্ছে, হতে থাকবে। সেগুলোর কোনোটাই মিথ্যা নয়। কিন্তু আসলে কারণ এক ও অভিন্ন। সেটা হলো পুঁজিবাদের আগ্রাসন। অন্যগুলো ছোটখাটো রোগ, ক্ষেত্রবিশেষে তারা রোগও নয়, রোগের লক্ষণ মাত্র, আসল ঘটনা হলো পুঁজিবাদের নির্মম অত্যাচার। ওই শত্রুকে চিহ্নিত না করতে পারলে প্রকৃত ঘটনা বোঝা যাবে না, তার হাত থেকে মুক্তির জন্য সমষ্টিগত যে চেষ্টা সেটাও গড়ে উঠবে না। এরই মধ্যে প্রতি বছর পহেলা বৈশাখ আসে। এসে ডাক দেয়। ডাকটা কীসের? সেটা অন্যকিছুর নয়, স্বাভাবিক হওয়ার। স্বাভাবিক হওয়ার অর্থ সহজ হওয়া, সরল হওয়া; চারপাশের মানুষ, প্রকৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্যের সঙ্গে সংলগ্ন হওয়া। পহেলা বৈশাখ বলে সংবেদনশীল হতে; বিচ্ছিন্নতাপ্রবণ বুদ্ধির ওপর সবকিছুর দায়িত্বভার চাপিয়ে না দিয়ে হৃদয়কেও সঙ্গে নিতে। এক কথায়, পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে। পুঁজিবাদ আমাদের উৎপাটিত ও বিচ্ছিন্ন করেছে; সংবেদনশীলতাকে দিচ্ছে সংকীর্ণ করে। এর প্রবল প্রতাপে সে রাজত্ব করছে অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতির সবকিছুর উপরে। অর্থনীতিতে পুঁজিবাদের তত্পরতায় কোনো রাখঢাক নেই। সবকিছু বাজারে চলে গেছে। চিকিৎসা ও শিক্ষাপণ্যে পরিণত হয়েছে। ন্যায়বিচারের একই দশা। যাদের সামর্থ্য আছে তারা কেনে, অন্যরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে, বেদনায় কাতর হয়, বঞ্চিত থেকে যায়। রাষ্ট্র কোনো কিছুরই নিরাপত্তা দেয় না। রক্ষকের ছদ্মবেশে ভক্ষকেরা চতুর্দিকে শিকার খুঁজে বেড়ায়। প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে কে কতটা ভোগ করবে তাই নিয়ে। ক্ষমতালিপ্সু ধনীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতাই হয়ে দাঁড়ায় রাজনীতির মূল ধারা। যে যখন ক্ষমতায় আসে সে তখন রাজনৈতিক সমস্যাকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি হিসেবে খাড়া করে এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সাহায্যে প্রতিপক্ষের ওপর যতভাবে পারা যায় নিপীড়ন চালায়; স্বার্থগত বিভাজনকে মতাদর্শিক বিভাজন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে জনগণকে এদলে ওদলে ভাগ করে ফেলে। জনগণের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তি যাতে বিকশিত হতে না পারে সে ব্যাপারে শাসক শ্রেণির সব পক্ষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করে। এমন ঐক্য অন্য কোনো ক্ষেত্রে তারা কখনোই দেখায় না, দেখাতে পারে না। উন্নতি হচ্ছে। উন্নতিতে খরা বেশি, বৃষ্টি কম; খরাকবলিত মানুষেরা বৃষ্টি চায়। তাদের বৃষ্টি দরকার। পাকিস্তানি ধনীদের আমরা তাড়িয়ে দিয়েছি, এখন পড়েছি বাঙালি ধনীদের খপ্পরে। তারা বিনিয়োগ করে না, ব্যবসা করে; বাজার উন্মুক্ত করে দেয় বিদেশি পণ্যের জন্য; প্রতারণা ও লুণ্ঠনের ব্যাপারে কোনো প্রকার সংকোচ করে না। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিল্প কারখানার অনেকগুলো হস্তগত ও বন্ধ করে দিয়েছে।

যত বাড়ে উন্নতি তত বাড়ে বৈষম্য এবং সমানুপাতে কমতে থাকে দেশপ্রেম। ওদিকে হু হু করে বৃদ্ধি পাচ্ছে বেকারের সংখ্যা। জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে শাসকদের কোনো উদ্বেগ নেই, কেননা সস্তা শ্রমে তাদের জন্য খুব সুবিধা, বিদেশে সরবরাহ করা যায়, নিজেদের কাজেও লাগে, গার্মেন্টে দরকার, ঘর-গেরস্থালিতে প্রয়োজন। রাষ্ট্র যারা শাসন করে সেই ধনীরা এখন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে অধিক পরিমাণে বিদেশিদের মুখাপেক্ষী। এ দেশের কোনো ভবিষ্যৎ আছে বলে তারা ভরসা করে বলে মনে হয় না। দল-মত-নির্বিশেষে তারা বিশ্বায়নের ভক্ত এবং পুঁজিবাদের উপাসক।

সংস্কৃতিতেও একই অস্বাভাবিকতা। বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের ভীষণ গৌরব; কিন্তু বাংলা ভাষার চর্চায় বিত্তবানদের রয়েছে অনীহা, বিত্তহীনদের আছে অক্ষমতা। উত্কৃষ্ট সাহিত্য আমরা কমই সৃষ্টি করেছি। বাংলা ভাষায় জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা ক্ষীণপ্রাণ। পুঁজিবাদ পুরুষতান্ত্রিক সে মাতৃভাষার মূল্য দেয় না, বাণিজ্যের ভাষাকে তুষ্ট করে। এমনকি পহেলা বৈশাখের উদযাপনও তো পুঁজিবাদের দ্বারা আক্রান্ত। আমাদের বৈশাখী মেলার অন্তরের সত্যটা কখনোই কেনাবেচার বাণিজ্য ছিল না, কেন্দ্রে স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক আনন্দ ছিল। সে মেলা নিজে ছিল মানুষের সঙ্গে মানুষের মেলামেশার পরিসর। ছেলেমেয়েরা আসত। আসত বয়স্করা। সার্কাস ম্যাজিক নাগরদোলা সবকিছু থেকে উপচে পড়ত আনন্দ। পণ্যের কেনাবেচা চলত, কিন্তু সেও ছিল হাসিখুশির ব্যাপার, দর কষাকষির নয়।

আমরা পারিনি। জীবনকে স্বাভাবিকভাবে রক্ষা করতে পারিনি। পহেলা বৈশাখ কোণঠাসা ও কৃত্রিম হয়ে পড়েছে। বৈশাখ কেবল আমাদের নয়, এ অঞ্চলের অনেকেরই। উত্তরে পাঞ্জাব কাশ্মীর, দক্ষিণে তামিলনাড়ু কর্ণাটক হয়ে সিংহল, পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম নেপাল থাইল্যান্ড ভিয়েতনাম হয়ে জাভা পর্যন্ত বৈশাখ ছিল, এখনো আছে। কিন্তু সর্বত্রই আক্রান্ত সে। আর শত্রু ওই একই, নাম যার পুঁজিবাদ।

বৈশাখের স্বাভাবিকতা রক্ষা করার বিশেষ দায়িত্ব বাংলাদেশের। কেননা সংখ্যায় আমরা অনেক। বিশ্বে বাংলাভাষীর সংখ্যা বিপুল, তাদের বড় অংশ বাংলাদেশের বাসিন্দা। পহেলা বৈশাখ এদের সবার। উৎসব আরও আছে, কিন্তু পহেলা বৈশাখের মতো ধর্মনিরপেক্ষ, ইহজাগতিক, সর্বজনীন উৎসব আর দ্বিতীয়টি নেই। এ উৎসব কেবল একটি দেশের নয়, অনেক দেশের। ধর্ম, বর্ণ ও শ্রেণির ভেদ সে মান্য করে না বরং ভাঙতে চায়। পহেলা বৈশাখের ডাকে সাড়া দেওয়ার দায়িত্ব তাই আমাদের কাঁধে রয়েছে। দায়িত্বটা, আবারও স্মরণ করা যাক, স্বাভাবিক হওয়ার এবং পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর। আমরা শুনব কি শুনব না, সাড়া দেব কি দেব না, সেটা আমাদের ব্যাপার; কিন্তু বৈশাখ আসবেই, সে বলবেই তার বলার কথা। বলবে পুঁজিবাদকে পরাভূত করতে না পারলে আমাদের মুক্তি নেই।

     লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর