শুক্রবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

নবীজী ওকাজের মেলায় যেতেন দীন প্রচার করতে

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

নবীজী ওকাজের মেলায় যেতেন দীন প্রচার করতে

‘ওই এলোরে ওই এলো/নতুন বর্ষ ওই এলো।’ কবি গোলাম মোস্তফা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি বাঙালি সন্তানকে বর্ষবরণ ও বৈশাখ উদযাপনের জন্য আহ্বান করেছেন। বাংলা সনের প্রথম মাস বৈশাখ। বৈশাখের পয়লা তারিখ নানা সাজে ও কাজে দিনটিকে উৎসবমুখর করে রাখা আবহমান বাংলার আদি ঐতিহ্য।  ব্যবসার হালখাতা খোলা, মাছে-ভাতে বাঙালির চর্চা হিসেবে পান্তা-ইলিশ ভোজন (যদিও এটি এখন ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে), মঙ্গলজনক কাজের মাধ্যমে দিন পারসহ আরও কত উপায়ে যে, এ দিনটি পালিত হয়, তা জানার জন্য ইটপাথরের শহর ছেড়ে খোলা আকাশ আর ধান খেতের গ্রামে যেতে হবে।

বর্ষবরণ আমাদের ঐতিহ্যবাহী উৎসব। এ উৎসব পালনে পিছিয়ে থাকার সুযোগ নেই। ধর্মের নিয়ম রক্ষা করে উৎসব পালন নবীজী (সা.)-এর শিক্ষা। আমাদের দৈনিন্দন জীবনকে উৎসবে মাতিয়ে রাখার জন্য আল্লাহতায়ালা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ দিয়েছেন। তাই তো নামাজে এত প্রশান্তি। এত আনন্দ। আবার আছে বার্ষিক উৎসব হজ কিংবা ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। এসবই মনকে সতেজ ও সবুজ রাখার জন্য। তেমনি ধর্মের গণ্ডির মধ্যে থেকে বর্ষবরণেও আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। যে যে ধর্মের অনুসারী তাকে তার ধর্ম মতেই উৎসব পালন করতে হবে। এভাবে চলতে পারলে এদেশ বিশ্বের বুকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল মডেল হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।

বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে ধর্মমনাদের পিছিয়ে থাকার সুযোগে সংস্কৃতির নামে অনেক অপসংস্কৃতি ঢুকে পড়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই বলে অপসংস্কৃতির দোহাই দিয়ে সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা থেকে পিছিয়ে থাকা কোরআন ও নবীজীর শিক্ষা নয়। নবীজী (সা.)-এর সময় পুরো আরবে অপসংস্কৃতির জোয়ার বইছিল। কিন্তু তিনি কখনো এসবের বিরুদ্ধাচরণ করেননি। বরং এসবে মিশেই তিনি তার কাজ পুরো করে গেছেন। জাহেলি যুগের একটি ঐতিহ্যবাহী মেলার নাম ছিল ‘ওকাজ মেলা’। রসুল (সা.) দাওয়াতের উদ্দেশ্যে এ মেলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঘুরতেন। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রসুল (সা.) ওকাজ মেলায় এসে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে কোরআনের আহ্বান তুলে ধরতেন। এ মেলায় ইসলাম গ্রহণ করেছেন এমন সাহাবির সংখ্যাও কম নয়। এ মুহূর্তে হজরত আমর ইবনে আবাসা আস-সুলামির কথা মনে পড়ছে।

মদিনায় গিয়েও রসুল (সা.) দেখতে পেলেন মানুষ হাজারো অধর্ম ও অপসংস্কৃতিতে ডুবে আছে। কিন্তু তিনি এসব নিয়ে কখনো তর্ক-বিতর্ক করেননি। মানুষের চেতনায় আঘাত করেননি। কাউকে বলেননি তুমি কেন এসব করছ? এসব ভালো নয়। বরং তিনি কৌশলে মানুষের হৃদয়ে ধর্মের ফুল ফুটিয়েছেন। একটি উদাহরণ দেখুন। মদিনায় এসে তিনি দেখতে পেলেন মুসলামানরা দুটো উৎসব পালন করছে। নবীজী (সা.) জানতে চাইলেন, এ কিসের উৎসব? মদিনাবাসী বলল, এগুলো আমাদের পুরনো ঐতিহ্য। রসুল (সা.) বললেন, তোমাদের জন্য এরচেয়ে ভালো দুটি উৎসবের কথা বলতে পারি। তা হলো ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। (আবু দাউদ)। রসুল (সা.) কিন্তু কোনো ফতোয়াবাজি করেননি। মানুষকে গালাগালিও করেননি। তিনি দেখেছেন এ উৎসব মানুষের কোনো কল্যাণ বয়ে আাানছে না। তাই তিনি ঈদের মতো চির আনন্দময় দুটি উৎসব উপহার দিলেন বিশ্ব মুসলমানকে। সত্য সুন্দর কল্যাণময় যে কোনো জিনিসই গ্রহণ করার অনুমতি দেয় ইসলাম।

কোরআনের দাওয়াত ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য আমাদের রসুল (সা.)-এর সুন্নাহ-নিয়ম অনুসরণ করতে হবে। কোনো উৎসব-অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে বলে আমাদের কোনো লাভ হবে না। বরং এতে গুনাহ হবে। কোরআনের বিধান অমান্য করা হবে। আল্লাহ বলেন, ‘আমার প্রেমিক বান্দারা শোন! তোমরা যারা প্রেমময় প্রভুর রং ধারণ করে ধর্ম রঙের জীবনযাপন করছ, সাবধান! আমার অজ্ঞ বান্দাদের প্রতি প্রেমহীন আচরণ কর না। তারা না বুঝে আমার সঙ্গে অন্য দেব-দেবীর শরিক করছে। তোমরা যদি তাদের প্রতি দয়াপরবশ ও মায়াময় আচরণ না কর, তবে তারা শিরক থেকে আগে বেড়ে তোমাদের প্রেমময় প্রভুকে গালি দিয়ে বসবে। (সূরা আনআম : ১০৮)। হে ধর্মদরদি বন্ধু! কোরআনের এ আহ্বান নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় হয়েছে। সময় হয়েছে নবীজী (সা.)-এর জীবনাদর্শ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করার। ভিন্ন ধর্ম ও মতে বিশ্বাসী মানুষদের বিষয়ে কোরআন কত প্রেমময় ও যুক্তিসঙ্গত অধিকার দিয়েছে, আর রসুল (সা.) পুরো জীবনে কীভাবে তা বাস্তবায়ন করে গেছেন- সে দৃশ্য আজ মুসলমানের সামনে নেই। তাই তো আজ আমাদের মধ্যে এত দলাদলি ও লঙ্কাকাণ্ড।

বাংলা নববর্ষের পাশাপাশি আমাদের হিজরি নববর্ষকেও মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।  তরুণদের মাঝে হিজরি নববর্ষের চেতনা জাগাতে পারলে কোরআন-নবীজীবনীসহ অনেক বিষয় খুব সহজেই তারা জানতে পারবে।  এভাবে কৌশলী হয়ে দায়ী সংগঠন ও তাবলিগের মুরব্বিদের এগিয়ে আসতে হবে। তবেই তরুণদের মাঝে নতুন জীবনের নতুন স্বপ্নের আশা জাগাবে।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসিসরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

সর্বশেষ খবর