শুক্রবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা
নববর্ষ

বাঙালিত্বই রুখবে জঙ্গিবাদ

অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান

বাঙালিত্বই রুখবে জঙ্গিবাদ

জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেস্কো)-এর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে বাংলা নববর্ষের অন্যতম অনুষঙ্গ ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। ইউনেস্কোর নির্বাচিত ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এ শোভাযাত্রা।

গত বছর (নভেম্বর ৩০, ২০১৬) ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবায় বিশ্বের ঐতিহ্য রক্ষায় আন্তঃদেশীয় কমিটির একাদশ বৈঠকে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে ইউনেস্কো। মঙ্গল শোভাযাত্রা ‘রিপ্রেজেন্টেটিভ লিস্ট অব ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটিস’-এর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ১৯৮৯ সালে শুরু হওয়ার সময় অবশ্য এর নাম ছিল আনন্দ শোভাযাত্রা, পরবর্তীতে ১৯৯৬ সাল থেকে চারুকলার এ আনন্দ শোভাযাত্রা ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ হিসেবে নাম লাভ করে। ইতিপূর্বে ইউনেস্কোর ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজের তালিকায় বাংলাদেশের কারুশিল্প  জামদানি এবং বাউল গানও স্থান পায়। এ ছাড়া ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় বাগেরহাটের ‘ষাট গম্বুজ মসজিদ’, ‘পাহাড়পুরের বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষ’ এবং বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের নাম রয়েছে।

বাংলাদেশের কোনো উৎসবই এত দ্রুত ব্যাপকতা পায়নি, যেমনটি পেয়েছে পয়লা বৈশাখ। বাঙালির নববর্ষ উৎসব এবং তার অন্যতম অনুষঙ্গ ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। মাত্র ১৯৮৯ সালে সূচনাকৃত মঙ্গল শোভাযাত্রা, ঢাকার চারুকলা থেকে যার সূচনা, সিকি শতাব্দীর মধ্যেই সার্বজনীনতা অর্জন করেছে। এক হিসাবে আন্দাজ করা গেছে গত বছর এ ধরনের মঙ্গল শোভাযাত্রা ১০ হাজারে দাঁড়িয়েছিল। এবার সরকারিভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করতে বলা হয়েছে। এই নির্দেশনা আংশিক বাস্তবায়ন হলেও পঞ্চাশ হাজারে দাঁড়িয়ে যাবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন। যদিও অনেকে বলেছেন, এ ধরনের নির্দেশনার আদৌও প্রয়োজন ছিল না। যা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই হচ্ছিল এবং দিন দিন ব্যাপকতার দিকে যাচ্ছে, তা বাস্তবায়নে সরকারি নির্দেশনা অপ্রয়োজনীয় ছিল।

বাংলা নববর্ষ আমাদের এখন প্রধান জাতীয় উৎসব, এর ব্যাপকতা দিন দিন বাড়ছেই। আমাদের আবেগ আর ভালোবাসার বাঙালিত্বের এ শ্রেষ্ঠ দিনটিকে এভাবে পেতেও আমাদের কম ঝামেলা পোহাতে হয়নি। কারণ পাকিস্তান আমলে পূর্ব-বাংলার বাঙালিকে এ উৎসব পালনে বাধা দেওয়া হতো। বলা হতো, বাংলা নববর্ষ উদযাপন পাকিস্তানি আদর্শের পরিপন্থী। তারপরও বাঙালিরা বাংলাকে যেমন ছাড়েনি, তেমনি বাংলা নববর্ষ পালনও বন্ধ করেনি। বরং স্বল্পসংখ্যক বাঙালি শত্রু বাদে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ নববর্ষে সরকারি ছুটি ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছিল। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগের ব্যাপক ভরাডুবির মাধ্যমে যুক্তফ্রন্টের সরকার গঠিত হলে মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের সরকার বাংলা নববর্ষে সরকারি ছুটি ঘোষণা করে এবং নববর্ষ উপলক্ষে প্রথম সরকারিভাবে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান। তবে সে অর্জন স্থায়ী হয়নি। অল্প সময়ের মধ্যেই যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে সামরিক সরকার ক্ষমতা দখল করলে নববর্ষের সরকারি স্বীকৃতিও রহিত হয়। তবে এতে বাঙালির বাঙালিত্ব বিকাশে এ বাধা প্রবল শক্তি সঞ্চয়ের আধার হিসেবে আবির্ভূত হয়। সরকারি বাধার কারণে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। ১৯৫৮ সালে বাঙালির নববর্ষের সরকারি ছুটি বাতিল করে দেওয়া হয়। বাঙালিরা সংস্কৃতির ওপর এ সন্ত্রাস মেনে নেয়নি। সবচেয়ে সুসংগঠিত ও সুপরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ করে ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ‘ছায়ানট’। প্রতিষ্ঠানটি ১৯৬৭ সালে রমনার পাকুড়মূলে (বটমূলে) বর্ষবরণের অনুষ্ঠানের আয়োজনের মধ্য দিয়ে প্রতিবাদী বর্ষবরণের সূচনা করে। ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’ রবীন্দ্র সংগীত দিয়ে শুরু হয় বাঙালির প্রাণের উৎসব এবং কিছুদিনের মধ্যে এ গানটি স্থান করে নেয় বাঙালির সবচেয়ে বেশি গাওয়া জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ এবং একুশের গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’-এর কাতারে।

বাংলা নববর্ষ বাঙালির সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। একুশের চেতনার মতো নববর্ষ উদযাপনও বাঙালিত্বকে শাণিত করতে ভূমিকা রাখছে—এটা পাকিস্তানিরা ভালোভাবে বুঝেছিল। এখনো তাদের ভাবধারার সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো সেই একই দৃষ্টিতে বাংলা নববর্ষকে দেখে। পাকিস্তানি ও তাদের এ দেশের দোসরদের (আজকের জঙ্গি) বিরোধিতার মধ্য দিয়েই আয়োজন শুরু হয় প্রতিবাদী বৈশাখ উদযাপন। বাধা এলে অতিক্রমের প্রয়াশ আরও জোরালো হয়। পয়লা বৈশাখ এখনো আমাদের অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম হাতিয়ার। মঙ্গল শোভাযাত্রায় ব্যবহৃত টেপা-পুতুল থেকে শুরু করে বাঘ, হাতি, কুমির, পেঁচা, কবুতর, কচ্ছপের বিরোধিতাও কম হয়নি। অনেক প্রতিবন্ধকতা ও সমালোচনা অতিক্রম করেই আজকের সার্বজনীন মঙ্গল শোভাযাত্রা।

বাংলা নববর্ষে মহামিলনের এ আনন্দ উৎসব থেকেই বাঙালিকে ধর্মান্ধ ও জঙ্গিবাদের কূট ষড়যন্ত্রের জাল ভেদ করে সব কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে লড়াই করার অনুপ্রেরণা নিতে হবে। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে শপথ নিয়ে ‘মাছে-ভাতে’ সমৃদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক, বঞ্চনামুক্ত, বৈষম্যহীন জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।

লেখক : উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর