রবিবার, ১৬ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

আমির ভাই, যার কাছে আমাদের অশেষ ঋণ

সোহরাব হাসান

আমির ভাই, যার কাছে আমাদের অশেষ ঋণ

আমির ভাইয়ের যাপিত জীবন যতটা নাটকীয় ছিল, তার মৃত্যু তার চেয়ে বেশি নাটকীয়। অফিসে কাজ করতে করতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নিয়েছেন তিনি। এ প্রজন্মের সাংবাদিকদের অনেকেরই হয়তো তিনি অচেনা। কিন্তু গত শতকের ষাট ও সত্তরের দশকের সাংবাদিকেরা তাকে জানতেন। কেবল সাংবাদিক কেন, রাজনৈতিক অঙ্গনের অনেক বিশিষ্টজনের সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। 

আমির ভাই। সাংবাদিক আমির হোসেন। তার সর্বশেষ ঠিকানা ছিল ডেইলি সান। তিনি এ পত্রিকার সম্পাদক, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বা উপদেষ্টা সম্পাদক ছিলেন, সেটি তার বড় পরিচয় নয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বাংলার বাণীর সম্পাদক ছিলেন তিনি। স্বাধীনতার পর পত্রিকাটি দৈনিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলে তিনি এর যুগ্ম সম্পাদক হন। তারও আগে পাকিস্তান আমলে দৈনিক ইত্তেফাকের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রতিবেদক ছিলেন। ছাত্রজীবনে তিনি ছাত্রলীগে সক্রিয় ছিলেন। সেই সুবাদে বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতাদের সান্নিধ্যে আসেন। সাংবাদিকেরা তখন আর্থিকভাবে সচ্ছল ছিলেন না। কিন্তু  সাংবাদিকতা স্বচ্ছ ছিল। রাজনীতি ও সাংবাদিকতা উভয়ের লক্ষ্য ছিল বাঙালির মুক্তি।

আমির ভাইয়ের সাংবাদিকতা শুরু পিপিআই নামে একটি সংবাদ সংস্থার মাধ্যমে। এরপর ইত্তেফাকে যোগ দেন। একই সঙ্গে সাপ্তাহিক বাংলার বাণীতে লিখতেন। বাংলার বাণী ছিল তখন আওয়ামী লীগের মুখপত্র।

অনুজ সহকর্মীদের স্নেহ-ভালোবাসায় কাছে টানা মানুষ ছিলেন আমির ভাই। তার সঙ্গে আমার পরিচয় আশির দশকের মাঝামাঝি; তখন দৈনিক বাংলার বাণীতে বার্তা বিভাগে কাজ করি। সবে বিয়ে করেছি। পত্রিকাটিতে বেতন-ভাতা অনিয়মিত হয়ে পড়ায় আরেকটি খণ্ডকালীন কাজ জুটিয়ে নিতে হলো। এরবা গ্রুপের ইংরেজি সাপ্তাহিক ছিল হেরল্ড। ছুটি নামে তারা একটি বাংলা সাপ্তাহিক বের করলে রাশিদুল হক পাশা আমাকে খণ্ডকালীন কাজের ব্যবস্থা করে দেন। আমির ভাই হেরল্ডের কার্যত নির্বাহী সম্পাদক। সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় লিখতেন। রিপোর্ট দেখে দিতেন। দুটি পত্রিকারই সম্পাদক ছিলেন জাওয়াদুল করিম। পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রেস সচিব হয়েছিলেন।

একদিন আমির ভাই জিজ্ঞেস করলেন, ব্যবসায়ী আবুল খায়ের চৌধুরী কনক নামে সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করছেন এবং তিনি তার সম্পাদক হচ্ছেন, আমি সেখানে কাজ করব কি না। আবুল খায়ের এরশাদের দল করতেন। পরে প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন। বললাম, ‘আমির ভাই, আমার কাজ দরকার। তবে নীতিগত কারণে আমি সামরিক সরকারের পক্ষে কিছু লিখতে পারব না।’ তিনি আপত্তি করলেন না।

ওই সাপ্তাহিকে যোগ দিয়েছিলেন একঝাঁক তরুণ- কমল মমিন, নঈম নিজাম, আসিফ নজরুল, মঞ্জুরুল হক, সালাম জুবায়ের, ফাহিম রেজা নূর প্রমুখ। প্রবীণদের মধ্যে এলেন আহসানউল্লাহ, কাজী রাশিদা আনওয়ার, নজরুল ইসলাম। শাহ আলমগীর ও ফরিদা ইয়াসমিনও লিখতেন। কিছুদিনের ব্যবধানে ‘তরুণ তুর্কিরা’ অন্য পত্রিকায় চলে গেলেন। বলতে গেলে আমির ভাই একাই পত্রিকাটি টিকিয়ে রাখলেন। এরশাদ সরকার বাংলার বাণী বন্ধ করে দিলে আমি নতুন ঠিকানা খুঁজে নিলাম দৈনিক আজাদে।

বছর দুই পর আমির ভাই ফের খবর দিলেন। বললেন, বন্ধুদের সহযোগিতায় এবার তিনি নিজেই পত্রিকা করছেন— এই সময়। নঈম নিজামও যুক্ত হলেন। আমার কাজ ছিল খণ্ডকালীন। সকালে বাংলার বাণী করে দুপুরে এই সময়ে গেলে, অবধারিতভাবে আমির ভাইয়ের সঙ্গে দুপুরে খেতে হতো। বাসা থেকে ভাবী একজনের ভাত পাঠাতেন, সেটাই দুজনে ভাগ করে খেতাম। অনেক দিন আমির ভাই, নঈম ও আমি তিনজনে ভাগ করেও খেয়েছি।

সে এক সময় ছিল, স্বপ্ন ছিল। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এরশাদকে হটাতে হবে। বাইরে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন হচ্ছে আর আমরা পত্রিকায় সেই আন্দোলনের রিপোর্ট করছি, বিশ্লেষণ লিখছি। আন্দোলনকারী শরিক দলগুলোর মধ্যে ঝামেলা চলছে। তিন জোটে বিরোধ বাড়ছে। ভাবছি, সেটি দূর করা আমাদের দায়িত্ব। বছরখানেক পর এই সময় আর্থিক সংকটে পড়ে। যারা বিনিয়োগ করেছিলেন, তারা হাত গুটিয়ে নিলেন। কিন্তু আমির ভাই কখনো কর্মীদের বেতন-ভাতা বাকি রাখেননি। নিজে বেতন না নিয়ে অন্যদের বেতনের ব্যবস্থা করতেন। সহকর্মীদের বিপদে-আপদে এগিয়ে আসতেন। এই সময়ে থাকতেই তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হলে কলকাতায় অস্ত্রোপচার করালেন।

আমির ভাইয়ের অনেক দুঃখ ছিল। যাপিত জীবনের দুঃখ। তার চেয়ে বেশি ছিল রাজনীতির দুঃখ। তিনি চাইলে অনেক কিছু হতে পারতেন। হননি অথবা পরিবেশ-পরিস্থিতি তাকে বারবার দুর্বিপাকে ঠেলে দিয়েছে। রাজনীতির সূত্রে তিনি আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, শেখ ফজলুল হক মণির ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। ষাটের দশকে ছাত্রলীগের উদ্যোগে যে নিউক্লিয়াস গঠন করা হয়েছিল, তারও সদস্য ছিলেন তিনি। আমির ভাইয়ের মৃত্যুর পর তোফায়েল আহমেদ কলকাতায় তাদের একসঙ্গে থাকার কথা বলেছেন।

আমির ভাই ছিলেন শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেনের স্নেহধন্য। ২৫ মার্চ রাতে পত্রিকা অফিস থেকে তারা একসঙ্গেই চামেলীবাগের বাসায় এসেছিলেন। সেই গল্প তিনি অনেকবার আমাদের শুনিয়েছেন।

স্বাধীনতার পর আমির ভাই বাংলার বাণীর যুগ্ম সম্পাদক হলেও তার রাজনৈতিক গুরু আবদুর রাজ্জাক তাকে সরাসরি রাজনীতিতে নিয়ে এলেন। তিনি মাদারীপুর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। তাকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হবে। কিন্তু তিনি মনোনয়ন পেলেন না। তারপরও দলের প্রতি তার অকুণ্ঠ আনুগত্য ছিল।

কিন্তু পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের ট্র্যাজেডি আরও অনেকের মতো তার জীবনকেও গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দেয়। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মামলা দিয়ে তাকে হেনস্তা করতে থাকলে একপর্যায়ে তিনি কলকাতায় চলে যান। দেশে ফিরেও তিনি বেশ কিছুদিন আত্মগোপন অবস্থায় ছিলেন। পরে মামলা প্রত্যাহার হলে নতুন করে সাংবাদিকতা শুরু করেন।

আর্থিক কারণে এই সময়ে অচলাবস্থা দেখা দিলে ফের বাংলার বাণীতে ফিরে আসেন। একসময় বাংলার বাণীও বন্ধ হয়ে যায়। আবার আমির ভাই বেকার হয়ে পড়লেন। অথচ তিনি বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই দক্ষ ছিলেন। ভালো লিখতেন। আজকের অনেক নামকরা সাংবাদিক-সম্পাদক তার শিষ্য বা সতীর্থ ছিলেন। অনেকে সাংবাদিকতার আড়ালে ব্যবসা-তদবির করেন, কিন্তু আমির ভাই সাংবাদিকতা বা লেখালেখির বাইরে কিছুই করেননি।

সেই কঠিন সময়ে আমির ভাই বাংলাদেশ টুডেতে যোগ দিলে তার চেয়ে বয়সে কনিষ্ঠ এক সাংবাদিক তাকে সরানোর জন্য চক্রান্ত করতে থাকেন। পরে অবশ্য তাকেই চলে যেতে হয়। আমির ভাই বার্তা বিভাগের দায়িত্ব নেন। কিন্তু দুর্বিপাক তাকে ছাড়ে না। বাংলাদেশ টুডে অন্য মালিকের কাছে হস্তান্তর হয়ে যায়। বেতন-ভাতাও অনিয়মিত হয়ে পড়ে।

সে সময় প্রায়ই রাতে তার সঙ্গে টেলিফোনে কথা  হতো। আর্থিকভাবে সচ্ছল কোনো পত্রিকায় একটি কাজ পাওয়া যায় কিনা জানতে চাইতেন। তার সঙ্গে একদা একাধিক ঘনিষ্ঠজনকে অনুরোধ করেছি। সাড়া পাইনি। একবার আমির ভাইয়ের সমস্যাটি নিয়ে বন্ধু আবু তৈয়ব ও নঈম নিজামকে জানালে তারা দুজনই বিষয়টি আন্তরিকতার সঙ্গে নেন। নঈম ও আমি আমির ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করেছি। তৈয়ব ভাইও তাকে ভালো জানতেন। তাদের উদ্যোগেই আমির ভাইয়ের ডেইলি সানে যোগ দেওয়া এবং ৪০ বছর পর ফের কোনো দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক হওয়া।

শেষদিকে আমির ভাইয়ের শরীর ভালো যাচ্ছিল না। তারপরও তিনি দুই বেলা অফিস করতেন। বসুন্ধরা সিটি থেকে শান্তিনগরে তার বাসায় আসতে-যেতে দুই-আড়াই ঘণ্টা লেগে যেত। তিনি সেই কষ্ট মেনে নিয়েছিলেন স্ত্রী-কন্যার দিকে তাকিয়ে। কয়েক মাস আগে তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম ডেইলি সানে। আগের মতোই হৃদয়ের উষ্ণতা দিয়ে গ্রহণ করলেন।

সাংবাদিকতা সূত্রে সংবাদপত্র জগতের অনেক ‘জ্যোতিষ্কের’ সঙ্গেই মেশার সুযোগ হয়েছে। অনেক সাংবাদিক নেতাকেও কাছ থেকে দেখেছি।  কিন্তু আমির ভাইয়ের মতো এ রকম নিজেকে আড়াল করে রাখা, নিজের উজ্জ্বল অতীত নিয়ে বড়াই না করা মানুষ দ্বিতীয়টি পাইনি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে আমির ভাইয়ের সম্পর্ক ছিল নিবিড় ও গভীর। তিনি মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে স্মৃতিকথা ও উপন্যাস লিখেছেন। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন নামে তার দুটি জনপ্রিয় বইও আছে। এতে সেই সময়ের রাজনীতির চালচিত্র যেমন পাওয়া যাবে, তেমনি বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সংযোগ ও সৌহার্দ্যের বিষয়টিও উঠে এসেছে। বিভিন্ন ঘটনায় এসব বিবৃত হলেও তিনি নিজেকে জাহির করেননি কখনো, কোথাও।

আমির ভাই, আপনার অশেষ স্নেহ-ভালোবাসা পেয়েছি। প্রতিদানে কিছুই দিতে পারিনি। এই অক্ষমতা ক্ষমা করবেন।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর