রবিবার, ১৬ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা
স্মরণ

সৈয়দ রেজাউল হায়াত

কারার মাহমুদুল হাসান

সৈয়দ রেজাউল হায়াত

পাঁচ বছর আগে ১৬ এপ্রিল ২০১২ তারিখে ভোরবেলায় সৈয়দ রেজাউল হায়াত ইহজগৎ ত্যাগ করে অনেক স্মৃতি- অনেক কাহিনী পেছনে রেখে চলে গেলেন চিরদিনের জন্য না ফেরার দেশে। চলে যাওয়ার দুই দিন আগেও আমরা একসঙ্গে বসে অফিস করেছি। তার জীবনের শেষ অফিস চার্টার্ড ইনস্টিটিউট অব লজিস্টিকস অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট (সিআইএলটি) বাংলাদেশ কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি, যার কেন্দ্রীয় অফিস লন্ডনে অবস্থিত এবং স্থাপিত ১৯১৯ সালে।

যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে ১৯৯৫ সালের শেষদিকে আমার যোগদান বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ঘটনার কথা সবসময় মনে পড়ে। আমি তখন পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে উপসচিব হিসেবে বলা যায় সরকারের অস্বচ্ছ কর্মকাণ্ডের কারণে পদোন্নতি বঞ্চিত হয়ে অনাদিকাল থেকে কাজ করছি এবং এর মধ্যে ‘গণপদোন্নতি’র বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার (আমরা ১৩০ জন সিনিয়র কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে জুনিয়রদের যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি প্রদান বিষয়ে) রায় আমাদের পক্ষে হয় এবং অক্টোবর ১৯৯৫ মাসে অন্যদের সঙ্গে (৯২ সাল থেকে সিনিয়রিটি দিয়ে) যুগ্মসচিব হিসেবে আমাকেও পদোন্নতি প্রদান করা হয়, খবরের কাগজে সে তালিকা প্রকাশিত হয়। দীর্ঘ পৌনে চার বছর পর আমার পদোন্নতির খবর জেনে হায়াত স্যার বাসায় টেলিফোন করে আমার স্ত্রীকে বললেন ‘ভাবী, কারারকে টেলিফোনে পাওয়া খুবই কঠিন, তাই আপনাকেই অনুরোধ করছি,- কারারকে বলবেন, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে আমি কারারের সঙ্গে কাজ করতে চাই, সে যেন অন্য কোথাও যোগদানের চিন্তাভাবনা না করে’।

তার (জনাব হায়াত) ইচ্ছা অনুযায়ী যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে যুগ্মসচিব হিসেবে জারিকৃত আদেশ অনুযায়ী যথারীতি যোগ দেই এবং একটানা প্রায় চার বছর তার সান্নিধ্যে দায়িত্ব পালন করি, কাজ শিখি এবং তার কাছ থেকে আহরিত অভিজ্ঞতা শিক্ষা, বিদ্যা, বুদ্ধি, ইত্যাদি কর্মক্ষেত্রে অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে, আন্তরিকতার সঙ্গে প্রয়োগ করে যোগাযোগ সেক্টরে বিভিন্নমুখী উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের এক অবিচ্ছেদ্য-অংশীদার হিসেবে নিজেকে সমর্পণ করি। উপরে বর্ণিত ওই যে কয়েকটি শব্দ, ‘কারার-এর সঙ্গে কাজ করতে চাই’-এ কয়টি শব্দের ওজন যে কত হাজার টন, তা যিনি বলেছিলেন, তিনিই তা জানতেন।

সচিব মরহুম সৈয়দ রেজাউল হায়াত আপনাকে, আপনার সঙ্গে চাকরি করার দুর্লভ অভিজ্ঞতাকে অভিবাদন জানাই। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে আমার ওপর একাধিক গুরু দায়িত্ব, অন্য কথায় কঠিন দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। একদিন সম্ভবত ১৯৯৭ সালের জানুয়ারি মাসে আমাকে তার অফিস কক্ষে ‘চা’ খাওয়ার জন্য ডাকলেন। একান্ত আলাপ করার সময় তিনি বললেন, ‘কারার আপনার সঙ্গে কথা না বলেই আপনার ওপর এক অতি বড় মাপের দায়িত্ব অর্পণের বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি নিয়ে ফেলেছি। ঢাকা-কলকাতা বাস সার্ভিস চালুর বিষয়ে গত বেশ কয়েক মাস ধরে প্রধানমন্ত্রী ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দিচ্ছিলেন। যোগাযোগমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকেও বিষয়টির ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পদক্ষেপ নিতে বলেছেন কয়েকবার। কিন্তু আজ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে আমরা (সচিব ও মন্ত্রী) প্রধানমন্ত্রীকে এ মর্মে অবহিত করেছি যে এ গুরু দায়িত্ব পালনে আমার মন্ত্রণালয়ের সচিব কারার মাহমুদকে আজই দায়িত্ব অর্পণ করে অফিস আদেশ জারি করেছি।’ প্রধানমন্ত্রী এ কথা শুনে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে এ মর্মে নাকি মন্তব্য করেছেন যে, ‘এ কাজটি কারার সাহেব সফলতার সঙ্গেই সম্পাদন করতে পারবেন। আমি তাকে চিনি এবং এ বিষয়ে তার ওপরে আমার পূর্ণ আস্থা আছে’। হায়াত স্যার বললেন, ‘এ সুখবর তথা কঠিন দায়িত্ব অর্পণের বিষয়টি আপনাকে ‘জানান’ দেওয়ার জন্য আপনাকে ‘চা’ খেতে এ আমন্ত্রণ। চা-পান পর্ব শেষে তাকে আমার ওপর এতবড় আস্থা রাখার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে এবং এরপর মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে তার কক্ষে গিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে নিজ কক্ষে চলে এলাম।

এ ধাঁচের আরও অনেক বড় বড় দায়িত্ব সচিব হায়াত আমাকে দিয়েছেন সময় সময় এবং আমি চেষ্টা করেছি তার দেওয়া বিশ্বাস, আস্থা এবং দায়িত্ব প্রদান সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর যথাযথ মর্যাদা দিতে।

১৬ এপ্রিল ২০১২ সকালে আমার অনুজপ্রতিম সহকর্মী প্রাক্তন সচিব লুত্ফর রহমান তালুকদার টেলিফোনে আমাকে হায়াত স্যারের অনাকাঙ্ক্ষিত অকল্পনীয় মৃত্যুর খবরটি দিয়ে অঝরে কাঁদছিলেন। আর সে কান্নায় আমিও শরিক হলাম। চার্টার্ড ইনস্টিটিউট অব লজিস্টিকস অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট, বাংলাদেশ কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রায় তিন বছর ধরে দায়িত্ব নিয়ে সৈয়দ রেজাউল হায়াতের নির্দেশিত পথ ধরে বাংলাদেশের লজিস্টিকস, ট্রান্সপোর্ট ও সাপ্লাই চেইন সেক্টরের উন্নয়নের জন্য সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট সেক্টরের সম্পৃক্ততায় আমরা সামনে এগিয়ে যাচ্ছি। হায়াত স্যার বেঁচে থাকলে হয়তো সিআইএলটি বাংলাদেশ আরও ব্যাপক পরিসরে এ সেক্টরে অবদান রাখার সুযোগ আমরা নিতে পারতাম। তবে আমরা নিরলস চেষ্টা করে যাচ্ছি।

লেখক : সাবেক সচিব।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর