মঙ্গলবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা
প্রতিবেশীনামা

ভালোবাসায় সিক্ত পানিতে রিক্ত...

আলম রায়হান

ভালোবাসায় সিক্ত পানিতে রিক্ত...

ভারতের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব কেবল ভৌগোলিক অবস্থানে প্রতিবেশী হওয়ার কারণে নয়। বিরাজমান সম্পর্কের ভিত্তি সৃষ্টি হয়েছে ’৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ ও পরাজিত করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ভারতের সহযোগিতার মধ্য দিয়ে। স্বাধীনতাযুদ্ধে দুই দেশের বীর যোদ্ধাদের রক্তের স্রোতধারার ওপর তৈরি হয়েছে বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বের ভিত্তি। আর এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে সুগভীর আবেগ।

এর পরও সবকিছু ছাপিয়ে মানুষের হৃদয়ের বীণায় বেজেই চলছে পানি নিয়ে হতাশার করুণ সুর! কারণ, পানি বাংলাদেশের জীবন-মরণ প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত। ছোট-বড় মিলিয়ে ৫৪টি নদীর পানি নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এক রকম অস্থিরতার মধ্যে আছে। এ ক্ষেত্রে প্রায় অর্ধযুগ ধরে বড় রকমের উদ্বেগের কারণ হয়ে আছে তিস্তার পানি প্রসঙ্গ।

জনপ্রত্যাশা ছিল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের ভারত সফরে অন্তত তিস্তার পানিপ্রাপ্তির ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হবে। কিন্তু তা হয়নি। এদিকে নদীর বুকে ধু-ধু বালুচর দেখাচ্ছে মরুভূমির প্রতিচ্ছবির দন্ত-নখর; যা দেখে পানিশূন্য নদীর মতোই মানুষের রুহুর পানিও শুকিয়ে যাচ্ছে। এর পরও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত মনোভাব প্রদর্শন ও মিথ্যাচার হতাশার বোঝার ওপর শাকের আঁটি চাপিয়েছে। দুই দেশের গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যুর মধ্যে তিনি ঢুকে পড়লেন কাবাবকা হাড্ডির মতো। বিষয়টি একটি বড় প্রশ্নবোধক হয়েই থাকল। বাংলাদেশের পানি প্রশ্নে মমতার দৃষ্টিকটু প্রাধান্য পাওয়ার বিষয়টি পাতানো খেলার মতো কিনা তা অবশ্য বলা কঠিন। তবে অনেকে এ রকমই সন্দেহ করছেন। দুই রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রাধান্য বিস্তারই কেবল নয়, তিস্তার পানির বদলে তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিকল্প যে প্রস্তাব দিয়েছেন তা আরও উদ্বেগজনক। নাকের বদলে নোলকের মতো!

সব মিলিয়ে প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবার ভারত সফরে তিস্তার পানিবণ্টনে একটি সুরাহা হবে। ভারত সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার লেখায় যথার্থই বলেছেন, দুই দেশের সম্পর্ক বহতা নদীর মতো। কিন্তু সম্পর্কে নদীর প্রবাহ বিরাজ করলেও বাস্তবে অনেক নদী হারিয়ে ফেলেছে প্রবাহ। আর অভিন্ন ৫৪ নদীর মধ্যে এক তিস্তা নিয়ে যে পরিমাণ গলদঘর্ম হতে হচ্ছে বাংলাদেশকে, তাতে বাকি নদীর পানি নিয়ে কী হবে কে জানে! এর পরও আমরা ভারতের ওপর আস্থা রাখতে চাই; বিশেষ করে তিস্তার পানি নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আশ্বাসের ওপর। যিনি বলেছেন, শেখ হাসিনা ও তার সরকারের আমলেই তিস্তা চুক্তি হবে। এদিকে তিস্তা নদীর পানি নিয়ে জনপ্রত্যাশা সমুদ্রের বিশালত্বকেও ছাড়িয়ে গেছে। ভারত সফর শেষে দেশে ফেরার পর ১১ এপ্রিল গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘তিস্তায় পানি আসবেই, পানি কেউ আটকে রাখতে পারবে না।’ প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, ‘ভৌগোলিক সীমারেখা বা জনসংখ্যার দিক দিয়ে বাংলাদেশ কম হতে পারে। কিন্তু সার্বভৌমত্বের দিক দিয়ে সমান-সমান; এ সম্মানটা বাংলাদেশের। এখানে হতাশার কিছু নেই।’

প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর সফল হওয়া নিয়ে কারও দ্বিমত থাকার কোনো কারণ নেই। শুধু তাই নয়, প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশকে কোন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তাও মূর্তমান হয়েছে এবার তার ভারত সফরে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যে আন্তরিকতায় আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানিয়েছেন এবং সফরকালে তিনি যে সম্মান ও মনোযোগ পেয়েছেন তা এককথায় গর্ব করার মতো।

এর পরও পানি নিয়ে আমরা সবার আশ্বাসে পূর্ণ আস্থা রাখতে চাই, নিরুপায় হয়েই। কিন্তু সবকিছুর মতো আস্থারও তো একটি সময়সীমা থাকে। চাইলেই অনন্তকাল আস্থা ধরে রাখা যায় না। তবে বিষয়টি ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কৌতুক নকশার মতো হলে ভিন্ন কথা। বাংলাদেশের বিক্রমপুরের কৃতীসন্তান শক্তিমান এই অভিনেতার একটি কৌতুক নকশা আছে। যেখানে হাই কোর্টে ফাঁসির আদেশ হওয়ার পরও বলা হচ্ছে, ‘খোকনরে ঝুইলা পড়তে ক। আমি আছি তো, আমার উপর ভরসা রাখ!’

এ কথা বলা মনে হয় খুব বেশি বলা হবে না— পানি ছাড়া আর কোনো কিছুতেই বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্ব প্রশ্নাতীত হবে না। একই সঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে, বঙ্গবন্ধু সরকার ও পরে হাসিনা সরকার আমলে ভারতের কাছে বন্ধুত্বের অনেক বড় বড় মাইলফলক স্থাপন করা হয়েছে বাংলাদেশের তরফ থেকে। আর বাংলাদেশের কোনো কোনো সরকারের আমলে কিন্তু প্রত্যাশার বাইরে ঘটনার অভিজ্ঞতা আছে ভারতের। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদদ দেওয়ার যে বিষবৃক্ষ সামরিক সরকারগুলোর হাঁটুর বুদ্ধিতে সৃষ্টি হয়েছিল তার ভিত কিন্তু শেখ হাসিনা অনেকটাই নড়বড় করে দিয়েছেন ঝুঁকি নিয়েই। তবে এ ক্ষেত্রে এখনো অনেক কাজ বাকি আছে। এ অবস্থায় অনুকূল পরিবেশ পেলে আবার যে বিষবৃক্ষ জন্মাবে না, তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে! এটি মমতার মগজে না থাকলেও ভারতের নেতৃত্বের বিবেচনায় নিশ্চয়ই আছে।

আরও বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন, ২০১৮ সালের নির্বাচনে নিঃসন্দেহে বিএনপি অংশ নেবে। ক্ষমতা বলয়ের বাইরে থাকলেও এ দলটির সমর্থক কিন্তু আছে। আর সঙ্গে তো জামায়াতের সন্ত্রাসী বাহিনী ও অর্থ আছেই। এই বাস্তবতার সঙ্গে আগামী নির্বাচনে তিস্তার পানি না পাওয়ার বিষয়টি নির্বাচনী প্রচারণার ইস্যু হলে কিন্তু আওয়ামী লীগকে বড় ধরনের খেসারত দিতে হতে পারে। আর এ বিরূপ প্রভাব থেকে ভারত খুব একটা দূরে থাকতে পারবে, তা মনে করা সম্ভবত ঠিক হবে না।

পানি নিয়ে যারা ভাবেন তারাও জানেন, জঙ্গিবাদ দমনে হাসিনা সরকারের কোনো বিকল্প নেই। একাধিক ঘটনায় এটি প্রমাণিতও হয়েছে। কিন্তু কোনো কারণে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়লে খেসারত কেবল বাংলাদেশের মানুষ দেবে না; ভারতকেও খেসারত দিতে হতে পারে! তখন মমতার বাগাড়ম্বর কোনো কাজে আসবে না। অবশ্য মমতা কোন টিমের প্লেয়ার তা বলা কঠিন। আবার কেবল বাংলাদেশ ইস্যুতে নয়; আন্তদেশীয় নদীর পানি নিয়ে চীন যে পথে হাঁটতে শুরু করেছে তাতে নিজকে রক্ষা করার প্রয়োজনেও বাংলাদেশকে পাশে রাখা প্রয়োজন ভারতের।

     লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

সর্বশেষ খবর