বুধবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

ধর্ম গণতন্ত্র সমাজতন্ত্রের নামে উগ্রতার জায়গা নেই

পীর হাবিবুর রহমান

ধর্ম গণতন্ত্র সমাজতন্ত্রের নামে উগ্রতার জায়গা নেই

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলেম-ওলামাদের এক বৈঠকে কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিসকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রির সমমান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণার পর এক নতুন বিতর্কের সূচনা হয়েছে। গণমাধ্যম থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সর্বত্র পক্ষে-বিপক্ষে কথা উঠছে। কেউবা নিশ্চুপ রয়েছেন। সেই বৈঠকে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির আল্লামা  শাহ আহমদ শফী, ইকরা বাংলাদেশের পরিচালক মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ, কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান মাওলানা আশ্রাফ আলীসহ অনেকেই বক্তব্য রেখেছেন। প্রধানমন্ত্রীর স্বীকৃতির ফলে ইসলামিক স্টাডিজে এবং আরবি বিষয়ে এমএ ডিগ্রি পাবেন কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা।  গণমাধ্যমের খবরে আরও বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের সামনে স্থাপিত গ্রিক থেমেসিসের মূর্তি সরানোর ব্যাপারেও আশ্বাস দিয়েছেন। গেল বছর বাংলা নববর্ষের কর্মসূচি সূর্যাস্তের আগেই সম্পন্ন করার যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, এবারও সেটি বহাল ছিল। বাঙালির প্রাণের বর্ষবরণ উৎসবের আগে গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলেম-ওলামাদের বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্ত এবং আলোচনার বিষয় নিয়ে বিতর্কের ঢেউ উঠেছে। এ বিতর্কের জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, হেফাজতের সঙ্গে সরকারের কোনো চুক্তি হয়নি। যদ্দুর খবর নিয়ে জেনেছি, কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ স্তরকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রির সমমান দেওয়ার ঘোষণার নেপথ্যে প্রধানমন্ত্রীর যে উদ্দেশ্য রয়েছে তিনি চান, আধুনিক, বিজ্ঞানমনস্ক সিলেবাস ও কারিকুলাম প্রণয়ন। অর্থাৎ কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থাকেও আলিয়া মাদ্রাসার মতোই উন্নতকরণ। সবার স্মরণ রাখা উচিত যে, দেশে কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা কম নয়। দেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থী কওমি মাদ্রাসায় পড়ালেখা করছে। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম এই মুসলমান দেশে মাদ্রাসা শিক্ষার প্রসার একদিনে ঘটেনি। ব্রিটিশ থেকে পাকিস্তান আমল হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের ৪৬ বছরে এর বিকাশ ঘটেছে। কেবল আলেম-ওলামাদের হাত ধরেই এর ব্যাপ্তি ঘটেনি। রাষ্ট্রের আর্থিক দুর্বলতা, ভঙ্গুর রাজনৈতিক ব্যবস্থার বাস্তবতায় সব শাসকের হাত ধরেই তার ব্যাপ্তি ঘটেছে। রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিধিগণ মাদ্রাসার চিন্তা-চেতনার সঙ্গে সম্পৃক্ততা না রাখলেও কেবল ভোটের হিসাব-নিকাশ থেকেই বিচ্ছিন্নভাবে নিজেদের মতো করে প্রতিযোগিতামূলক সহযোগিতা করে গেছেন। আলেম-ওলামা ও মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা লোকজনও দেশের নাগরিক এবং তাদের নিজস্ব ধ্যান-ধারণা ও চিন্তাভাবনা রয়েছে। তাদের আস্থার মধ্যে রাখতে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমস্যা সমাধানের যে উদ্যোগ নিয়েছেন তার যৌক্তিকতা রয়েছে। রাষ্ট্রের প্রতিটি ধর্ম-বর্ণ-জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব ধ্যান-ধারণা ও সংস্কৃতি রয়েছে। তাদের নিজস্ব কিছু বক্তব্য রয়েছে। সরকার প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী তাদের বক্তব্য শুনবেন এবং সমস্যা সমাধানের পথ বের করে দেবেন তা সময়েরই দাবি।

প্রধানমন্ত্রী আলেম-ওলামাদের ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা তুলে ধরার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে তার জিরো টলারেন্সের কথা। পরদিন সরকারের বেসামরিক বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনা প্রবাহ এবং হেফাজতের সঙ্গে আপস অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চেতনাবোধ ক্ষতিগ্রস্ত করবে। অসাম্প্রদায়িক শক্তির হাত সঙ্কুচিত করবে। পয়লা বৈশাখ নিয়ে যা কিছু হচ্ছে তা অশনি সংকেত। এটা সর্বজনীন ও অসাম্প্রদায়িক উৎসব। যারা এর বিরুদ্ধে কথা বলছে, তারা জাতির শত্রু। তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ছাড়া আর কোনো পথ নেই। সরকারের তথ্যমন্ত্রী ও জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেছেন, একটি মহল বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ভাষার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তারা ইসলামের অপব্যাখ্যা করছে। প্রকৃতপক্ষে তারা নারীবিদ্বেষী ও গণতন্ত্রবিরোধী অপশক্তি। এরা একদিকে ইসলামের অপব্যাখ্যা দেয়, অন্যদিকে পাকিস্তানের দালালি করে। এরা আবার যুদ্ধাপরাধীদের ঘনিষ্ঠ মিত্র। প্রকৃতপক্ষে দেশের লোকঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে ধর্মের বিরোধ নেই। এগুলো পালন করলে কারও মুসলমানিত্ব যায় না। যারা এসব আচার-অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে এবং ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে তারা প্রতিক্রিয়াশীল। তিনি বলেন, রাজাকার জামায়াত ও তেঁতুল হুজুর গোষ্ঠী এদেশের আলেম-ওলামাদের প্রতিনিধিত্ব করে না, যেমনটি জঙ্গিরা প্রতিনিধিত্ব করে না ইসলামের। একই দিন সংস্কৃতিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা আসাদুজ্জামান নূর বলেছেন, নিরাপত্তার নামে নববর্ষের অনুষ্ঠান কাটছাঁট করা হলো কেন, সেটা আমার বোধগম্য নয়। বইমেলা সাড়ে ৮টা পর্যন্ত খোলা ছিল, বাণিজ্য মেলা রাত ১০টা পর্যন্ত। নাটক হচ্ছে, সিনেমা চলছে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে তাহলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান কেন ৫টার মধ্যে শেষ করতে হবে? এটা তো একটা লড়াই। অন্ধকারের বিরুদ্ধে, অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই। যারা যুক্তি ও ধর্ম কোনোটাই বোঝে না তাদের বিরুদ্ধে লড়াই।

একই দিন বাংলার নববর্ষ পয়লা বৈশাখ উদযাপন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বিভ্রান্তি ছড়ানোর ব্যাপারে সজাগ থাকতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। নববর্ষ উৎসবকে দেশের ঐতিহ্য হিসেবে অভিহিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বাংলার নববর্ষ পালন ও ধর্মের মধ্যে কোনো যোগসূত্র নেই। এ উৎসব হচ্ছে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। প্রধানমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন। সব ধর্মের মানুষই বর্ষবরণ উৎসবে যোগ দেয়। এর সঙ্গে ধর্মের কোনো বিরোধ নেই। তিন মন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্যেও যুক্তি রয়েছে। হেফাজত নেতাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক ও আলাপ-আলোচনা, এমনকি বর্ষবরণ উৎসব বিকাল ৫টার মধ্যে সম্পন্ন করা নিয়ে খোদ সংস্কৃতিমন্ত্রীর অসন্তোষ প্রমাণ করে সরকারের অভ্যন্তরেও মতবিরোধ রয়েছে। জনগণ যেখানে মন্ত্রীদের কাছে প্রশ্ন রাখবে সেখানে মন্ত্রীরাই প্রশ্ন করছেন! তারা মন্ত্রিসভার আনুষ্ঠানিক বৈঠকে কিংবা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতে নিজেদের মতামত ও ভিন্নমত উপস্থাপন করতে পারতেন। দেশের সর্ববৃহৎ সাংস্কৃতিক উৎসব বাংলা নববর্ষ উদযাপন। সেই উৎসব বিকাল ৫টার মধ্যে শেষ করার সিদ্ধান্ত কি সংস্কৃতিমন্ত্রী জানতেন না? যাক, কথা বললেই বাড়ে কথা। আমরা সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করি মন্ত্রীরা যা জানেন আমরা তা জানি না। প্রধানমন্ত্রী যা জানেন মন্ত্রীরা তার বিন্দু পরিমাণ জানেন না। নববর্ষের উৎসব কেন বিকাল ৫টার মধ্যে সম্পন্ন হয় সেই প্রশ্ন যখন সংস্কৃতিমন্ত্রী করেন তখন আমাদের বোবা হয়ে বিস্ময়ভরা চোখে তাকাতে হয়। কেন নববর্ষের কর্মসূচি বিকাল ৫টার মধ্যে সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে তার জবাব সাধারণ মানুষকে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরেরই দেওয়ার কথা। মানুষের নিরাপত্তার জন্য দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে নাকি অন্য কোনো কারণে সেটি তিনিই বলবেন। তবে প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের সিদ্ধান্তের সঙ্গে মন্ত্রীদের দ্বিমত রয়েছে কিনা এবং তা থাকলে সেটি সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই খোলাসা হওয়া উচিত। সরকারের বা প্রধানমন্ত্রীর যে কোনো ইচ্ছা, উদ্যোগ বা সিদ্ধান্তের সঙ্গে কোনো মন্ত্রী একমত হতে না পারলে পদত্যাগ করে চলে যেতে পারেন। না হয় সরকারের যে কোনো সিদ্ধান্তের দায়দায়িত্ব তাদেরও সমানভাবে বহন করতে হবে।

আমাদের মনে রাখতে হবে ধর্মের নামে, গণতন্ত্রের নামে, সমাজতন্ত্রের নামে, শ্রেণি সংগ্রামের নামে, প্রগতির নামে উগ্রতা, হঠকারিতা, সহিংসতা কোনো দেশেই কল্যাণ বয়ে আনে না। প্রতিটি রাষ্ট্রই তার জন্মের চেতনাগত ভিত্তির ওপর সংবিধান আইন ও বিধিবিধান বলে পরিচালিত হয়ে থাকে। রক্তক্ষয়ী সুমহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সঙ্গে তাদের দোসর সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তির করুণ পরাজয় ঘটিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে। সুমহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ৩০ লাখ শহীদের রক্ত ও আড়াই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম হারানো আর্তনাদে ভারি বাতাস বুকে নিয়ে যে বাংলাদেশের জন্ম তার স্বপ্ন ছিল— একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বৈষম্যহীন শোষণমুক্ত সমাজ। স্বাধীন বাংলাদেশে রক্তে লেখা সংবিধানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের চার মূলনীতি ধারণ করেছিলেন। সেটি হচ্ছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্ম নিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ যেখানে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়েছিল, যেখানে খাবার ছিল না, রাস্তাঘাট ছিল না। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হিংস্র আক্রমণ চালিয়ে বাংলাদেশকে প্রতিহিংসার ছোবলে ক্ষতবিক্ষত করেছিল। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে শ্রেণি সংগ্রামের নামে পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বে শ্রেণি শত্রু খতমের নামে শুরু করেছিল জনপ্রতিনিধি ও মানুষ হত্যার বর্বরতা। রাষ্ট্রীয় কলকারখানায় অগ্নিসংযোগ, পুলিশ ফাঁড়ি লুটের মতো দস্যুতা, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী তারুণ্যের শক্তিকে পুঁজি করে আবির্ভাব ঘটেছিল বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে উগ্রপন্থি জাসদের রোমান্টিক হঠকারী রাজনীতি ও সশস্ত্র গণবাহিনীর ত্রাসের রাজত্ব। অতিবিপ্লবী চীনাপন্থিদের কর্মকাণ্ডও চলছিল সমানতালে। তাদের পতাকাতলে আশ্রয় নিয়েছিল আল বদরসহ নিষিদ্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তির তারুণ্য। সরকারি দল আওয়ামী লীগের একাংশের উন্নাসিক দাম্ভিক আচরণ সীমা লঙ্ঘন করেছিল। একাত্তরের পরাজিত বিশ্ব মোড়লদের নীলনকশা রচিত হয়েছিল। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবার-পরিজনসহ নৃশংসভাবে হত্যা করে বাংলাদেশকে সেনাশাসক কবলিত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত নিষিদ্ধ সাম্প্রদায়িক দক্ষিণপন্থি রাজনৈতিক শক্তিকে অতিবিপ্লবী চীনাপন্থিদের সঙ্গে ক্ষমতার অংশীদারিত্ব দান ও পুনর্বাসিত করা হয়। দেশের সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করে ধর্মীয় রাজনীতিকে পুনর্বাসন করা হয়েছিল। দীর্ঘ সংগ্রাম শেষে ৯১ সালে জাতীয় নির্বাচনে নিশ্চিত বিজয়ের মুখে ঘটে যাওয়া পরাজয় মেনে নিয়ে আওয়ামী লীগ নামের ঐতিহ্যবাহী দলটি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশকে সংসদীয় রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তনই করায়নি, বিরোধী দলের রাজনীতিতে গিয়ে ক্ষমতাচ্যুত জাতীয় পার্টি ও একাত্তরের গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতকে নিয়ে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে যুগপৎ আন্দোলন করেছিল। আওয়ামী ঘরানার বুদ্ধিজীবীরা জামায়াতের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের জন্য বিক্ষুব্ধ হৃদয়ে প্রশ্ন তুললে বলা হয়েছিল, আপনারা তো ভোটকেন্দ্রেই যান না। সেই আন্দোলনে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিজয় অর্জন হয়েছিল। ভোটের ময়দানে এরশাদের জাতীয় পার্টি ও আ স ম আবদুর রবের জাসদ ক্ষমতার অংশীদারিত্ব পেয়েছিল। দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির সেই সুবর্ণ সময়ে বিএনপির সঙ্গে ঐক্য করতে গিয়ে এরশাদের জাতীয় পার্টি ভাঙনের মুখেই পড়েনি, মুক্ত এরশাদ জেলে থেকে পাঁচটি আসনে দু-দুবার বিজয়ী হয়েও ২০০১ সালের নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি। কারাদণ্ড ভোগ করে অর্থদণ্ড দিয়ে জেল থেকে বেরোলেও জাতীয় পার্টিকে এককভাবে নির্বাচন করতে হয়েছিল। শেখ হাসিনার সেই শাসনামলের শেষে এ দেশের এক বামপন্থি পবিত্র পুরুষ পীর হবিবুর রহমানের সিলেটের দক্ষিণ সুরমার বাঘেরখোলা গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম। সিলেটে তখন শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে হল ও ভবনের নামকরণের বিরুদ্ধে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট আলেম-ওলামাদের নিয়ে আন্দোলনের পথে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। পীর হবিবুর রহমান বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীকে তিনি মরহুম ড. ফসিহউদ্দিন মাহতাবসহ ২০ জন নাগরিকের একটি তালিকা দিয়ে বলেছিলেন এদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে চা-চক্রে পরামর্শ নিতে। সেই তালিকায় ইসলামী ঐক্যজোটের তৎকালীন চেয়ারম্যান শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হকের নামও ছিল। সেই ইসলামী ঐক্যজোট সেবার বিএনপির সঙ্গেই যুক্ত হয়েছিল। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার ভিসি ছিলেন মরহুম অধ্যাপক হাবিবুর রহমান। পীর হবিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘ভিসি আমার নাতিন জামাই। ড. জাফর ইকবাল আমেরিকা থেকে আসা একজন উচ্চশিক্ষিত হলেও তোমাকে শেষ করে দিবে।’ শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় এরশাদের কাছ থেকে আদায় করেছিলেন। তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী দক্ষিণ এশিয়া কাঁপানো কূটনীতিক হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী। তিনি তখন শেখ হাসিনার শাসনামলে জাতীয় সংসদের স্পিকার। সিলেটের কৃতী সন্তান মরহুম আবদুস সামাদ আজাদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী; বিএনপি জামানায় বোমা হামলায় নিহত শাহ এম এস কিবরিয়া, অর্থমন্ত্রী; প্রয়াত পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত; প্রধানমন্ত্রীর সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা, মরহুম দেওয়ান ফরিদ গাজী ও সাবেক ডাকসু ভিপি সুলতান মনসুর আহমেদ সংসদ সদস্যই নয়, আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের কারও সঙ্গেই আলোচনা না করে নামকরণ করায় আওয়ামী লীগ ছিল নীরব। অন্যদিকে আন্দোলনকারীদের মঞ্চে আবির্ভূত হয়েছিলেন জনপ্রিয় অর্থমন্ত্রী মরহুম সাইফুর রহমান। আন্দোলনকারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রগতিশীল শিক্ষকদের বাসভবনে বোমা হামলাও চালিয়েছিল। ২০০০ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে অনশন কর্মসূচির ডাক দিয়েছিলেন। তার সঙ্গে সংহতি জানাতে সিলেটে ৫০১ সদস্যের কমিটিও হয়েছিল। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ যখন সিলেটে নামলেন তখন হাতেগোনা কয়েকজন তাকে রেলস্টেশনে অভ্যর্থনা জানালেন। অনশনে যোগদানের পাল্লা ভারী করেছিলেন তার প্রথম স্ত্রী গুলতেকিন আহমেদ, সন্তানরা, মা ভাইদের পরিবার, লেখক প্রকাশক ও সফরসঙ্গী সাংবাদিকরা। সেই কর্মসূচি নির্বিঘ্নে করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ ‘আমি চাই হুমায়ূন আহমেদ যেভাবে যাবেন সেভাবেই ফিরবেন।’ সেই সময়ে ইসলামী ঐক্যজোট ও আলেম-ওলামারা বিএনপির সঙ্গেই যোগ দিয়েছিল। উত্তম শাসন দেওয়ার পরও শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ ২০০১ সালের নির্বাচনে করুণ পরাজয় দেখেছিল। এককালের কমিউনিস্ট ও শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ স্কুলের পাঠ্যবইয়ে বিতর্কিত যে সংশোধন এনেছিলেন অনেকে বলছেন তা হেফাজতে ইসলামের দাবি ও চাপের মুখে ঘটেছে। সুপ্রিম কোর্টের সামনে স্থাপিত ভাস্কর্য অপসারণের দাবি, পয়লা বৈশাখ উদযাপন ও মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি, চট্টগ্রামের দেওয়ালে শোভিত আলপনা পোড়া মবিল দিয়ে ঢেকে দেওয়া এবং হেফাজতে ইসলামের নেতাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠককে অনেকে অশনি সংকেত বলছেন।

উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলাম ঢাকা ঘেরাও কর্মসূচি দিয়ে মতিঝিলে অবস্থান নিয়ে চরম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল এবং তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া ঢাকাবাসীকে তাদের সঙ্গে নেমে আসার ডাক দিয়েছিলেন। তখন অনেক মন্ত্রী, রাজনীতিবিদ, প্রগতিশীল নাগরিক দিশাহারা হয়ে পড়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শীর্ষ সব গোয়েন্দা প্রধান ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের নিয়ে হেফাজতের তাণ্ডব থেকে ঢাকাবাসীকেই নয়, দেশবাসীকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হলেও কার্যকর বিরোধী দলের অংশগ্রহণ না ঘটলেও সেই সময়ের বিএনপি-জামায়াতের সহিংস প্রতিরোধ কর্মসূচির মুখে নিজের ক্যারিশমায় শেখ হাসিনা দল ও জোটকে ক্ষমতায় এনেছিলেন। শেখ হাসিনা সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করায় আজকে অনেকে ক্ষমতাসীন। সেই হেফাজতকে হঠকারী উগ্র পথ থেকে সরিয়ে আনার কৃতিত্ব তার। যেমন করে তিনি প্রতিপক্ষ শিবিরে বিভক্তি এনে গণরায়ে ক্ষমতায় আসা এবং ওয়ান ইলেভেন চ্যালেঞ্জে জয়ী হওয়ায় ৭১ এবং ৭৫-এর ঘাতকদের ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন। কিন্তু সংবিধান সংশোধন হলেও ধর্মনিরপেক্ষতা ফেরেনি। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রয়েছে। এটাই বাস্তবতা। রাজনীতিতে জনগণকে নিয়েই পথ হাঁটতে হয়। জনগণের আবেগ অনুভূতির বিরুদ্ধে গেলেই সেটি হয় ভ্রান্ত পথ। হঠকারী পথ। তাই বলে সুমহান মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বাংলাদেশের ইতিহাসের পরতে পরতে যে বীরত্বে গৌরব রয়েছে, যে রক্তাক্ত চেতনা রয়েছে সেখানে ধর্মান্ধতা নয়, সব ধর্মের স্বাধীনতাই বড়। সেখানে ভাস্কর্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এবং ঐতিহ্য আলেম-ওলামাদেরও ইতিবাচকভাবে নিতে হবে। মালয়েশিয়াসহ অনেক মুসলিম দেশে রাস্তায় মদ বিক্রি হয়, ভাস্কর্য শোভা পায়, সেখানে বাংলাদেশে বিদেশি পর্যটকদের টানতে ও বিনিয়োগে আগ্রহী করে দেশকে অর্থনৈতিক অগ্রগতির লক্ষ্য অর্জনের মধ্য দিয়ে দরিদ্রতা হটাতে, ইয়াবার মতো সর্বনাশা ড্রাগ হটাতে কী করতে হবে তা বিবেচনায় আনতে হবে।

এবারের নববর্ষ ছিল শুক্রবার। গোটা দেশ প্রাণের উৎসবে মিলিত হয়েছে। রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণের অনুষ্ঠান, চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রায় লাখো মানুষের ঢেউ নেমেছে। সারা দেশের কোটি মানুষ প্রাণের উৎসবে একাত্ম হয়েছে। তেমনি জুমার নামাজে মুসল্লিদের ঢল নেমেছে। বাংলা বর্ষবরণ জাতির ঐক্যের মিলিত মোহনা। পবিত্র ঈদুল আজহা মুসলমানদের বৃহত্তর ধর্মীয় উৎসব। শারদীয় দুর্গাপূজা হিন্দু সম্প্রদায়ের বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব। বড়দিন খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় আনন্দ উৎসবের দিন। এসব মিলেই বাংলাদেশ। বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের রক্ত জড়িয়ে আছে। এই দেশ সবার। আলেম-ওলামা, মুসল্লিদের যেমন বাঁকা চোখে দেখা যাবে না। তেমনি ধর্মীয় উগ্রতা এবং জঙ্গিবাদ বরদাস্ত করা যাবে না।

জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে গোটা জাতির সংগ্রাম চলছে। অন্ধকার অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে আলোকিত সভ্যতার লড়াই চিরন্তন। এই লড়াইয়ে শুভ কল্যাণ ও সত্যের জয় অনিবার্য। সুমহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি উদার, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক বৈষম্যহীন সমাজ সবার কাম্য। কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত যেমন গ্রহণযোগ্য নয়, তেমনি ধর্মের নামে উগ্র হঠকারী পথ গ্রহণও কাম্য নয়। একটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষাব্যবস্থা গণমুখী আদর্শিক সৎ রাজনীতি এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি মানুষের প্রত্যাশা। মনে রাখতে হবে- ব্যালট বিপ্লবে কখনই সাম্প্রদায়িক শক্তির অভিষেক ঘটেনি। পরাজয় ঘটেছে। তেমনি উগ্র হঠকারী পথ মানুষের হৃদয় স্পর্শ করতে পারেনি।  হেফাজত থেকে আলেম-ওলামা, রাজনীতিবিদ, প্রগতিশীল নাগরিক সমাজ কারোর সীমা লঙ্ঘনের সুযোগ নেই। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন উত্তরাধিকারিত্ব বহনকারী নদীর মতোই বহমান দেশ বাংলাদেশ।

একটা সময় ছিল, এত টুপি এত হিজাব, এত এত হজ ছিল না। এখন হিজাব বেড়েছে, টুপি বেড়েছে, কমরেড কমিউনিস্টরাও হজে যাচ্ছেন, কিন্তু ধর্মের নামে মানুষ হত্যা, ব্যভিচার, ঘুষ, দুর্নীতি, মধ্যস্বত্বভোগী দালাল, নষ্ট মানুষের প্রভাব বেড়েছে!  ধর্মের মর্মবাণী-সত্য বল, সৎ পথে চল, ন্যায়পরায়ণ হও, অসৎ পথ পরিহার কর-উপেক্ষিত হচ্ছে, অথচ ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, ধর্মের নামে জঙ্গিবাদের উন্নাসিকতা চলছে!

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাংবাদিক।

[email protected]

সর্বশেষ খবর