বৃহস্পতিবার, ২০ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

পাকিস্তান সামরিক আদালতের নির্দেশ

তোফায়েল আহমেদ

পাকিস্তান সামরিক আদালতের নির্দেশ

১৯৭১-এর ২০ এপ্রিল আমার জীবনের এক বিশেষ দিন। এদিনে পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক সরকার সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে স্বাধীন বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, বেতার উপদেষ্টা আবদুল মান্নান, দি পিপল পত্রিকার সম্পাদক আবিদুর রহমান এবং আমাকে ২৬ এপ্রিল সকাল ৮টায় সামরিক আদালতে সশরীরে হাজির হওয়ার জন্য নির্দেশ প্রদান করে। ’৭১-এর এদিনে প্রকাশিত সব পত্রিকায় আমাদের পাঁচজনকে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশটি সিঙ্গেল কলামে ছাপা হয়েছিল। শিরোনাম ছিল— ‘৫ ব্যক্তির প্রতি সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ সকাশে হাজির হওয়ার নির্দেশ।’ আমাদের সবার বিরুদ্ধে পাকিস্তান পেনাল কোডের ১২১, ১২৩ক, ১৩১ ও ১৩২; এবং সামরিক বিধি ৬, ১৪, ১৭ ও ২০ এবং ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক নির্দেশ ১২৪ ও ১২৯ আইনের আওতায় অভিযোগ আনা হয়। এই নির্দেশে একমাত্র আবিদুর রহমান ছাড়া অন্য কারও কোনো পেশাগত পরিচয় উল্লেখ করা হয়নি। এটা ছিল পাকিস্তান সামরিক সরকারের একটি হাস্যকর অপপ্রয়াস। কারণ, যাদের আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, তারা বাংলার মানুষের কাছে সুপরিচিত রাজনীতিক এবং জনপ্রতিনিধি। বলা বাহুল্য, সেদিন আমরা কেউই বেলুচিস্তানের কসাই খ্যাত জেনারেল টিক্কা খানের আদালতে হাজির হইনি। ফলে ৮ জুন সামরিক আদালত আমাদের অনুপস্থিতিতে প্রত্যেককে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং সম্পত্তির ৫০ শতাংশ বাজেয়াপ্ত করে।

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর থেকে পাকিস্তানিরা বহির্বিশ্বের কাছে প্রমাণ করতে চেয়েছিল পুরো এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ‘দুষ্কৃতকারী’ ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে অভিহিত করে প্রচার করত ‘তাদের নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে’। ’৭১-এর ১০ এপ্রিল ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ অনুসারে ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের মুক্তাঞ্চল বৈদ্যনাথতলাকে ‘মুজিবনগর’ নামকরণ করে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঘোষণা করা হয় এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ গ্রহণ করে। প্রকৃতপক্ষে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার ফলে পাকিস্তানের কফিনে যে শেষ পেরেকটি ঠোকা হয়েছিল, ১৭ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে সেই কফিনটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে সমাধিস্থ করা হয়। সেদিনের সেই ঐতিহাসিক ঘটনাটি ছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নিয়মতান্ত্রিক অভ্যুদয়। দেশের অভ্যন্তরে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানটি ছিল নিষ্ঠুর গণহত্যার খলনায়ক জেনারেল টিক্কা খান ও সামরিক শাসকদের জন্য চরম আঘাত। এরকম আঘাতের পর জেনারেল টিক্কা খান আরও হিংস্র হয়ে ওঠে এবং আমাদের বিরুদ্ধে সামরিক নির্দেশ জারি করে।

২০ এপ্রিল আমাদের বিরুদ্ধে সামরিক ট্রাইব্যুনালের রায় ভারতের মাটিতে বসে শুনলাম এবং হাসলাম। কারণ, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ তখন এগিয়ে চলেছে। মুজিব বাহিনীর অন্যতম প্রধান হিসেবে ৭টি জেলার দায়িত্বে ছিলাম আমি। পাবনা, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, ফরিদপুর, বরিশাল ও পটুয়াখালী। এই অঞ্চলের মুজিব বাহিনীর সদস্যদের দেরাদুনে প্রশিক্ষণের পর বিমানে দমদম বিমানবন্দর,-এরপর ব্যারাকপুরে আমার যে ক্যাম্প ছিল সেখানে তারা অবস্থান করত। সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে তাদের আমরা বাংলাদেশে প্রবেশ করাতাম। কতজনের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছি, তাদের অনেকের সঙ্গে পরবর্তী জীবনে আর কোনো দিন দেখা হয়নি। ব্যারাকপুরে আমার ক্যাম্পেই মুজিব বাহিনীর জন্য ভারতীয় সাহায্য আসত। এই সাহায্য আমি মণি ভাই, সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাইয়ের কাছে পৌঁছাতাম। ভারত সরকারের পক্ষে আমাদের দায়িত্বে ছিলেন মিস্টার ব্যানার্জি। যার ছদ্মনাম ছিল মিস্টার নাথ। তিনি আমাদের সর্বাত্মক সাহায্য করেছেন। ’৬৯-এর অক্টোবরে লন্ডনে বঙ্গবন্ধু এই মিস্টার নাথের সঙ্গে মিটিং করেছিলেন। মিস্টার নাথ মুক্তিযুদ্ধে অক্লান্ত পরিশ্রম ও আমাদের অপরিসীম সাহায্য করেছেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে এসে তৎকালীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবস্থানকালে তিনি আকস্মিক মৃত্যুবরণ করেন। কৃতজ্ঞচিত্তে তার অবদানকে স্মরণ করছি।

পাকিস্তান সামরিক শাসকগোষ্ঠী আমাদের প্রতি যে কী নিষ্ঠুর ছিল তা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ এবং এই মামলার রায় থেকে উপলব্ধি করা যায়। আজ দেশ স্বাধীন হয়েছে। ভাবতে কত ভালো লাগে জাতির জনকের নির্দেশিত পথেই আমরা প্রিয় মাতৃভূমিকে স্বাধীন করেছি। বঙ্গবন্ধু সেদিন বলেছিলেন, ‘তোমাদের জন্য আমি সব রেখে গেছি। যে নির্দেশ আমি দিয়েছি। সেই নির্দেশিত পথে তোমরা পরিচালিত হও। বন্ধু রাষ্ট্র ভারতে গেলে তোমরা সর্বাত্মক সাহায্য পাবে।’ ভারতে গিয়ে চিত্তরঞ্জন সুতার যে বাড়িতে অবস্থান করতেন অর্থাৎ ‘সানি ভিলা, ২১ নম্বর রাজেন্দ্র রোড, নর্দার্ন পার্ক, ভবানীপুর, কলকাতা’- সেই বাড়িতেই আমরা অবস্থান করেছি। সেখান থেকেই মুজিব বাহিনীর পশ্চিমাঞ্চলের যুদ্ধ পরিচালনা করেছি। চিত্তরঞ্জন সুতার (সূত্রধর) ছিলেন বামপন্থি নেতা। তিনি জীবনে বহুবার কারা নির্যাতন ভোগ করেছেন। ’৭০-এর নির্বাচনের আগে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। আওয়ামী লীগে যোগদান করে স্বরূপকাঠি থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিক ছিলেন এবং আমাদের সর্বাত্মক সাহায্য করেছেন। তার অমর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।

’৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার খরচ হিসেবে বঙ্গবন্ধু আমাকে ২৫ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। নির্বাচনে খরচ হয়েছিল ২১ হাজার টাকা। বাকি ৪ হাজার টাকা ইউনাইটেড ব্যাংকের ভোলা শাখায় জমা ছিল। পাকিস্তান সরকার তা বাজেয়াপ্ত করে। দেশ স্বাধীনের পর ফেরত পেয়েছিলাম। সেদিন অভিযুক্তদের মধ্যে চার ব্যক্তিত্বই আজ প্রয়াত। প্রজাতন্ত্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ উভয়েই ’৭৫-এর ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সশস্ত্র বাহিনীর কতিপয় বিপথগামী সদস্যের গুলিতে শহীদ হন। মুজিবনগর সরকারের তথ্য ও বেতার উপদেষ্টা আবদুল মান্নান স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর সরকারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। কয়েক বছর আগে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। কবি-সাংবাদিক-শিল্পপতি হিসেবে সুপরিচিত ‘দি পিপল’ পত্রিকার সম্পাদক নিভৃতচারী সজ্জন মানুষ আবিদুর রহমান ইতিমধ্যে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন। এখন বেঁচে আছি কেবল আমি। যে প্রশ্নটি আমায় নিয়তই তাড়া করে, সেদিন কেন আমাদের সঙ্গে আবিদুর রহমানকেও পাকিস্তান সামরিক সরকার জড়িত করেছিল? আসলে সামরিক সরকার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে চেয়েছিল। কারণ আবিদুর রহমান সম্পাদিত ইংরেজি পত্রিকা ‘দি পিপল’ ছিল জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের নির্ভীক কণ্ঠস্বর। বর্তমানে হোটেল রূপসী বাংলার বিপরীতে অবস্থিত ‘দি পিপল’ পত্রিকার দফতরটি ’৭১-এর ২৫ মার্চ কালরাতে গ্রেনেড ও ট্যাংক হামলা চালিয়ে গুঁড়িয়ে দেয় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পর অফিসটির ধ্বংসস্তূপ থেকে পত্রিকাটির দুজন কর্মীর পোড়া কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। কত ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে আমরা প্রিয় মাতৃভূমিকে স্বাধীন করেছি। বিভীষিকাময় ২৫ মার্চ কালরাতে গ্রিন রোডে অবস্থিত ‘চন্দ্রশিলা’ নামক যে বাসায় আমি এবং প্রয়াত শ্রদ্ধাভাজন নেতা আবদুর রাজ্জাক থাকতাম, পাকবাহিনী তা ধ্বংস করে দেয়। সেখানে সংরক্ষিত ’৬৯-এর গণআন্দোলনের দুর্লভ ছবি, দেশি-বিদেশি খবরের কাগজ ও দলিলপত্রাদি ভস্মীভূত হয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম বাস্তবায়নের জন্য বঙ্গবন্ধুর সব কিছুই ছিল পূর্বপরিকল্পিত। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার যে বীজ তিনি রোপণ করেছিলেন, তা বাস্তবায়নে ধাপে ধাপে অনেকগুলো পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ’৬৬-এর ৬ দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং ’৭০-এর নির্বাচন। ’৭০-এর নির্বাচনের পরপরই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন সামরিক শাসকগোষ্ঠী বিজয়ী আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। তখন থেকেই তিনি স্থির করেন যে, ঘটনাধারাকে এমনভাবে নিয়ে যাবেন যে, ওরা হবে আক্রমণকারী আর আক্রান্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। শ্রী চিত্তরঞ্জন সুতারকে বঙ্গবন্ধু ভারতে পাঠিয়েছিলেন। চিত্তরঞ্জন সুতার বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ভারতে গিয়ে আমাদের জন্য সব ব্যবস্থা করেছিলেন। এখানেই বঙ্গবন্ধু ক্ষান্ত হননি। সিরাজগঞ্জ থেকে প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত সদস্য আমার প্রিয় বন্ধু ডা. আবু হেনাকে অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যে ভারতে পাঠিয়েছিলেন। আবু হেনা যে পথে গিয়েছিলেন ও যে পথে ফিরে এসেছিলেন, ঠিক সেই পথেই ২৯ মার্চ কেরানীগঞ্জ থেকে দোহার-নবাবগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, সারিয়াকান্দি-বগুড়া হয়ে ৪ এপ্রিল আমরা ভারতে পৌঁছি। সঙ্গে ছিলেন জাতীয় নেতা ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী সাহেব, জাতীয় নেতা এ এইচ এম কামারুজ্জামান সাহেব, শেখ ফজলুল হক মণি- শ্রদ্ধেয় মণি ভাই- এবং ডা. আবু হেনা ছিলেন আমাদের পথপ্রদর্শক। মুক্তিযুদ্ধের ৯টি মাস আবু হেনা আমাদের সঙ্গে থেকে নিরলসভাবে কাজ করেছেন।

মনে পড়ে, ১৭ এপ্রিল প্রথম বাংলাদেশ সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে বজ্র কণ্ঠে স্লোগান তুলেছিলাম— ‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো’; ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’; ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’; ‘আমার দেশ তোমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’; ‘আমার নেতা তোমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব’; ‘জয় বাংলা’। শত-সহস্র মুক্তিযোদ্ধা কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে সমবেতভাবে স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত করেছে মুজিবনগরের আম্রকানন। সেদিন আমার পরিবার-পরিজন জানত না আমি কোথায় আছি, কীভাবে আছি বা আদৌ বেঁচে আছি কিনা। সেসব দিনের কথা ভাবলে গর্বে যেমন বুক ভরে ওঠে। আবার দুঃখও লাগে এই ভেবে যে, ১৭ এপ্রিল ‘মুজিবনগর দিবস’ মহান মুক্তিযুদ্ধের সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক বৈধতা। আজ স্বাধীন বাংলাদেশে যেসব দল রাজনীতি করছে,-বারবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে,-তারা মহান মুক্তিযুদ্ধের ঊষালগ্নের ঐতিহাসিক এই দিবসটি পালন করে না। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক তাদের জন্য এটি বেদনাদায়ক যে, একমাত্র আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো রাজনৈতিক দল ‘মুজিবনগর দিবস’ উদযাপন করে না। অথচ মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৭ এপ্রিল আমাদের প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার গৌরবমণ্ডিত দিন।

লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য, বাণিজ্যমন্ত্রী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।

[email protected]

সর্বশেষ খবর