শিরোনাম
শুক্রবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

জ্ঞান অর্জনে মূল্যবোধ তৈরি হয়

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

জ্ঞান অর্জনে মূল্যবোধ তৈরি হয়

সুন্দর জীবন প্রতিটি মানুষের চাওয়া। যেসব ব্যবহার, আচরণ, গুণ মানুষের জীবনকে সুন্দর ও শান্তিময় করে তোলে মানুষের কাছে তার মূল্য অনেক। এসব মূল্যবান গুণকে দর্শনের পরিভাষায় বলে মূল্যবোধ।  অর্থাৎ মূল্যবান জিনিসকে মূল্যবান মনে করা এবং তা অর্জনের চেষ্টা করার আরেক নাম মূল্যবোধ। মূল্যবোধের সংজ্ঞায় দার্শনিক বোনেথ নিউবেক বলেন, ‘মূল্যবোধ হলো সেসব ধারণা ও বিশ্বাস, যা সৎ-চরিত্রবান ব্যক্তির জীবনযাপন নীতি সম্পর্কে পোষণ করা হয়। আর এসব বিশ্বাস ও ধারণা গুরুত্ব ও কঠোর উদ্যমের সঙ্গে রক্ষা করার চেষ্টা করা হয়।’ মানব সমাজে যখন মূল্যবোধের অবক্ষয় শুরু হয় তখনই অশান্তি-অরাজকতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। মূল্যবোধের অবক্ষয় মানে হলো, ভালো ও প্রশংসিত গুণ, উন্নত জীবনাদর্শ মানুষের কাছে মূল্যহীন হয়ে পড়া। বিপরীতে খারাপ অভ্যাস, আচার-ব্যবহার, নিকৃষ্ট ও ধর্মহীন জীবন মানুষের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠা। মানুষের সমাজে যখন এ অবস্থা বিরাজ করে তখন শান্তি তো দূরের কথা জীবনই বিপন্ন হয়ে পড়ে। স্বাভাবিক মৃত্যু মানুষের কাম্য বস্তুতে রূপ নেয় তখন। কারণ, মানুষ তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতর ঘটনাকে কেন্দ্র করে হত্যা-নৈরাজ্য-হানাহানির মতো ঘটনা ঘটায়। তাই মূল্যবোধের অবক্ষয় স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে কঠিনভাবে ব্যাহত করে। মানুষের চরম চাওয়া শান্তিকে পরম পাওয়ায় রূপান্তর করতে হলে সর্বত্র মূল্যবোধ বজায় রাখতে হবে। ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সর্বত্র কোথাও যেন মূল্যবোধের অবক্ষয় না ঘটে সে ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে সবাইকে। এখন প্রশ্ন হলো, কী উপায়ে মূল্যবোধ বজায় থাকবে বা যে সমাজে মূল্যবোধ নেই সেখানে কীভাবে মূল্যবোধ তৈরি করা যাবে? প্রথম কথা হলো, যে সমাজে মূল্যবোধ পুরোপুরি ভেঙে পড়েনি সে সমাজে মূল্যবোধ প্রশংসিত হয় সর্বত্র। যেমন আমাদের বর্তমান সময়। আর যে সমাজে মূল্যবোধ ছিলই না, সেসব সমাজে নতুন করে মূল্যবোধ তৈরির সংগ্রাম যেন সাগরের ঢেউয়ের বিপরীত চলা। যেমন জাহেলি সমাজের কথা বলতে পারি। এ সমাজের মানুষের মাঝে মূল্যবোধের বালাই ছিল না। ইসলাম এসে এসব মানুষকে সভ্যভব্য করেছে। তাই কোনো সমাজে মূল্যবোধ তৈরির শ্রেষ্ঠ পথ হলো ইসলামের বাতলে দেওয়া পথ ও মতে সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা।

মানুষের মাঝে মূল্যবোধ সৃষ্টি ও বজায় রাখার জন্য সর্বপ্রথম তাদের মনে ইমানী চেতনা জাগ্রত করতে হবে। অন্যভাবে বলা যায়, মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধে ইমানের বিকল্প নেই। ইমানের মাধ্যমে একজন মানুষ ইসলামে প্রবেশ করে এবং ইসলাম তার মাঝে মূল্যবোধ তৈরি করে দেয়। মূল্যবোধ তৈরিতে ইমানের ভূমিকা সর্বপ্রথম। মানুষ যখন তাওহিদের দিশা পেয়ে যায় তখন ভিতর-বাহির বদলে যায়। এই বদলে যাওয়ারই আরেক নাম মূল্যবোধ তৈরি হওয়া। যা আমরা দেখেছি সাহাবিদের থেকে শুরু করে যুগে যুগে মুসলিমদের জীবনে। ইমানের পর ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকে গুরুত্ব দিতে হবে। মানুষের মাঝে যখন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হবে তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সাম্য-শান্তি-সম্প্রীতি সমাজে ছড়িয়ে পড়বে। তাই তো কোরআন ন্যায়বিচারের নির্দেশ দিয়ে বলেছে, ‘তোমরা যখন মানুষের মাঝে ফায়সালা করবে, তখন ন্যায়ভাবে করবে।’ (নিসা : ৫৮)। কারণ, ন্যায়বিচার নিশ্চিত না হলে সমাজে হানাহানি বেড়ে যাবে। শুরু হবে মূল্যবোধের অবক্ষয়। জেগে উঠবে অসৎ প্রবৃত্তি। তাই মূল্যবোধ বজায় রাখতে হলে সমাজের সর্বত্র ন্যায়-ইনসাফ কায়েম করতে হবে।  মানুষের মাঝে ইমানী চেতনা জাগানো ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার মতোই গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি বিষয় হলো শিক্ষা ও জ্ঞানার্জনের ব্যবস্থা করা। জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব নতুন করে বলার কিছু নেই। আল্লাহ বলেন, ‘নবী হে আপনি বলুন! যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান হতে পারে?’ (সূরা জুমার : ৯)। অবশ্যই সমান না। কারণ, ‘নিশ্চয় আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে জ্ঞানীরাই আল্লাহকে বেশি ভয় করে।’ (সূরা আল ফাতির : ২৮)। মানুষ যখন জ্ঞান সাধনায় নিজেকে মগ্ন করবে তখন তার মাঝে সৎ গুণগুলো মূল্যবান মনে হবে। আবার অসৎ গুণগুলোর ভয়াবহতাও সে বুঝতে পারবে। সুতরাং জ্ঞানার্জনের মাধ্যমেই সম্ভব মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ করা। আর এ জ্ঞানার্জনকে ইসলামে ফরজ করা হয়েছে। আমাদের নবী (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক মুসলমানের জন্য জ্ঞান অর্জন করা ফরজ।’ (তিরমিজি)। এ ছাড়াও আনুষঙ্গিক আরও কিছু বিষয় আছে যেগুলো মূল্যবোধ্যের অবক্ষয় রোধে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে থাকে। যেমন সেলাকের শাসন, আইনশৃঙ্খলার স্বাভাবিক অবস্থা। দরিদ্রতা কারও দূর করা। মৌলিক চাহিদা পূরণ করা। জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা।

সর্বোপরি সংস্কৃতির নৈরাজ্য রোধ করা। সমাজে সৎ লোকের সংখ্যা বেশি হলে এবং দরিদ্রতা ও বেকারত্ব দূর হলে মানুষের মাঝে আত্মসম্মানবোধ কাজ করবে। আর এ বোধই তাকে মূল্যবোধের গুরুত্ব জানিয়ে দেবে। আবার জাতীয় ঐক্য না থাকলে অপরাধীরা সুযোগ পেয়ে যাবে। ফলে মূল্যবোধের অবক্ষয় চরমে পৌঁছে যাবে। তেমনিভাবে সাংস্কৃতিক নৈরাজ্য রোধ করা না গেলে মূল্যবোধের অবক্ষয় জোয়ারের মতো বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে যা আর রোধ করা যায় না, তাই সমাজে মূল্যবোধ বজায় রাখা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধে ইসলামের বিধান বাস্তবায়ন করা একান্ত প্রয়োজন।  এ দাবিকে উপেক্ষা করে সুখী-সমৃদ্ধ দেশ ও শান্তিময় জীবন কল্পনা করা যায় না।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসিসরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর