মঙ্গলবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

একটি বিনীত প্রস্তাব

অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত

একটি বিনীত প্রস্তাব

আমি ১৯৮০ সালের ২১ জানুয়ারি নাক, কান, গলা রোগের ওপর এমএস ও পিএইচডি করার জন্য তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের ইউক্রেনের বন্দরনগরী অডেসায় যাই। সেখানে ২২ এপ্রিল মহামতি লেনিনের জন্মদিন পালনের অনুষ্ঠানটি আমার মনে এক অবিস্মরণীয় দাগ কাটে। লেনিন শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্মদাতা নন, তিনি মার্কস-অ্যাঙ্গেলসের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমাজতান্ত্রিক চেতনার এক মহান মূল্যবোধ নিয়ে ১৯১৭ সালে বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মহামতি লেনিনের জন্মদিনটি আমার সোভিয়েত ইউনিয়নের পদার্পণের তিন মাসের মাথায় পালিত হলো। আমি তখন রাশিয়ান ভাষা শিক্ষার পাশাপাশি নাক, কান, গলা বিভাগে কাজ করি। দিনটি কীভাবে পালন করা হবে সে ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা ছিল না। আমার গাইড প্রফেসর দ্রাগমেরেস্কি আমাকে বললেন, দাদুর জন্মদিন পালিত হবে, সুতরাং তুমি এখানে এসো। এখন যে মহান জন্মদিন পালনের জন্য আমাকে যেতে বললেন, ব্যাপারটা আমার কাছে কেমন জানি ধোঁয়াটে মনে হলো। যাই হোক, অতি উৎসাহভরে সেই হোস্টেল থেকে দুবার ট্রাম পরিবর্তন করে অডেসার রিজিওনাল হাসপাতালে আমার কর্মস্থলে আমি পৌঁছে যাই। ওখানে পৌঁছে দেখলাম সে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। পরিবেশরক্ষকরা রাস্তাঘাট, বাগান সব পরিষ্কার করছেন, ড্রেন পরিষ্কার করছেন এবং বড় বড় সার্জন সবাই নিজ নিজ ডিপার্টমেন্টে বসে রোগী দেখছেন। এবং সেই রোগী দেখার নিয়ম হলো অফিস টাইম সকাল ৮টায় শুরু হয়েছে। কিন্তু যতক্ষণ রোগী থাকে ততক্ষণ তারা রোগী দেখে যাবেন। টিকিট দেওয়া বন্ধ হবে না। এবং যে চারটা অপারেশন থিয়েটার ইএনটি ডিপার্টমেন্টে ছিল, অন্যান্য দিন দেখতাম যে, হয়তো দুটিতে অপারেশন হচ্ছে বাকি দুটি খালি আছে। সেদিন দেখলাম চারটিতেই অপারেশন হচ্ছে। এবং মজার ব্যাপার হলো, এই অপারেশনগুলো যে হচ্ছে, অন্যান্য দিন দৈনিক যে অপারেশন হতো সেদিন মনে হলো তার দুই বা তিন গুণ অপারেশন হয়েছে। আমি দেখে আমার প্রফেসরকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমরা আজকের ছুটির দিনে লেনিনের জন্মদিন ২২ এপ্রিল পালন করছ কেন। ২২ এপ্রিল তো চলে গেছে। কিন্তু তোমরা আজকে শনিবার দিন কেন এটা উদ্যাপন করছ? তিনি জবাব দিলেন এটা ‘লেনিনসকি সুবতনিক’ অর্থাৎ ছুটির দিনটা আমরা লেনিনের জন্মদিন উপলক্ষে কর্মের মাধ্যমে উৎসর্গ করি। অমনি সেটা আমার স্মৃতির মণিকোঠায় বিশাল স্থান দখল করে নিল। ১৯৮৩ সালে আমি দেশে ফিরে আসি। তার পর থেকে আমি এই চিন্তা-চেতনা নিয়ে কাজ করতে থাকি। আমার ধারণা ছিল যে, কোনো একদিন আমি যদি পারি তাহলে আমিও দিবসটিকে অর্থাৎ আমার জাতির জন্মদাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনটিকে ওই রকম একটা কর্মময় জন্মদিন হিসেবে পালন করব। অথবা জন্মদিনের পরের একটা শুক্রবার সবাই কর্মের মাধ্যমে উৎসর্গ করব। এবং এই কর্মময় দিনটিকে পালন করতে হলে আমার মতো মানুষের বুদ্ধি বা বিবেচনা যে কেউ নেবে না তাও আমি খুব ভালোভাবে জানি।

স্রষ্টা আমার প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল। আমার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য তিনি যেন গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী আমাকে যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন তখনই আমার মনে এই বাস্তবতার নিরিখে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে কিছু সেবা দেওয়া যায় কিনা জনগণকে, তা পালন করার জন্য সচেষ্ট হলাম। যেহেতু ২০০৯ সালের ২৫ মার্চ আমি দায়িত্ব নিয়েছি, আমার দুর্ভাগ্য ২০০৯ সালের ১৭ মার্চটা আমি পালন করার সুযোগ পাইনি আমার মনের মতো করে। হ্যাঁ, ২০০৯ সালের ১৭ মার্চ টুঙ্গিপাড়ায় জাতীয় শিশু-কিশোর দিবস এবং বঙ্গবন্ধুর চিরনিদ্রায় শায়িত সেই পুণ্যস্থানে যদিও উপস্থিত ছিলাম, প্র্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠান দেখেছিলাম। তার পরও যেন একটা অতৃপ্তি আমার প্রাণে বার বার বেজে উঠছিল। যাই হোক, সেখান থেকে আমি চিন্তা করতে লাগলাম ২০১০ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্রি চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা করব।

আমার শুভাকাঙ্ক্ষী, বঙ্গবন্ধুর প্রতি অগাধ শ্রদ্ধাশীল যেসব সহকর্মী ছিলেন তাদের মধ্যে এটা ভ্যান্টিলেইট করতে শুরু করলাম। ২০১০ সালের মার্চের শুরুতেই আমি তৃতীয়, চতুর্থ ও দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মচারীসহ আমার সহকর্মী ডাক্তার সবার মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান করে সিদ্ধান্ত নিই যে, ১৭ মার্চ আমি যে করেই হোক একটা ফ্রি হেলথ্ সার্ভিসের ব্যবস্থা করব। এবং সেই ফ্রি হেলথ্ সার্ভিসের ব্যবস্থা করার জন্য যা যা করা দরকার সব আনুষঙ্গিক ব্যাপার সঙ্গে নিয়ে এলাম। আমার প্রো-ভিসি অধ্যাপক শহীদুল্লাহকে দায়িত্ব দিলে তিনি হাসপাতাল পরিচালককে নিয়ে নেমে পড়েন।

হাসপাতালের পরিচালক ব্রি. জে. এম এ মজিদকে যখন আমি বললাম, এই কাজটা সুন্দরভাবে করে দিতে হবে, তখন তিনি সহাস্যে বললেন, স্যার! আমার ওপর আপনি দায়িত্ব দিয়ে দেন। প্রো-ভিসি শহীদুল্লাহ আমাকে ইতিমধ্যে বলেছেন, আমি সত্যিই তার প্রশংসা না করে পারছি না প্রচণ্ড পরিশ্রম করে, নির্ভুলভাবে কোনো রকমের ত্রুটি ছাড়া সেই দিনটি পালনের ব্যবস্থা তিনি করে দিয়েছিলেন।

তার আগে অবশ্যই আমি আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় চিকিৎসকদের বাংলাদেশে যারা স্বনামধন্য ছিলেন, তাদের অনেককেই নিমন্ত্রণ করলাম যেন তারা এসে আমার রোগী দেখার এই প্রক্রিয়ায় নিজেদের সম্পৃক্ত করেন। তাদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক রশিদই মাহবুব, অধ্যাপক মাহমুদ হাসান, অধ্যাপক শাহলা খাতুন, অধ্যাপক এম আর খান। সেদিন প্রত্যেকে এসেছিলেন। এবং সেদিন রোগী দেখার যে আনন্দ উৎসব হলো তা যেন পয়লা বৈশাখের মতো একটা প্রাণের মেলা হয়ে গিয়েছিল। রোগীদের উত্ফুল্লতা, তাদের সচেতনতা— এগুলো দেখে তাদের সহযোগিতা আমার মনে এক বিরাট সাহস ও বিশ্বাস জুগিয়েছিল আমার স্বপ্ন বাস্তবায়নের পক্ষে। যাই হোক, পরবর্তীতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম কয়েক বছর যাবৎ এই চিকিৎসাব্যবস্থা চালু করেছেন সরকারি হাসপাতালগুলোয়। এবারের জন্মদিনটা ছিল ১৭ মার্চ, শুক্রবার এবং ২০১৫ সালের পরের ২০১৬ সালের ১৭ মার্চ আমি রোগী দেখতে না পেরে অত্যন্ত মনঃক্ষুণ্ন অবস্থায় বাসায় ছিলাম। কেননা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে ডাকেনি। পরবর্তীতে ১৮ মার্চ আমার চেম্বারে যেসব রোগী এলো তাদের অনানুষ্ঠানিকভাবে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে ফি না নিয়ে দেখে দিলাম। আমি কাউকেই বলিনি যে, ১৭ মার্চ উপলক্ষে আমি আপনাদের ফ্রি দেখেছি। কিন্তু মনে মনে লালন করছিলাম কোথায় গিয়ে এই সেবাটা দেওয়া যায়।

সিদ্ধান্ত নিলাম ২০১৭ সালের ১৭ মার্চ আমি প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু ট্রাস্ট কর্তৃক পরিচালিত শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব মেমোরিয়াল কে পি জে হাসপাতালকে বেছে নিলাম। কারণ সেখানে আমি অনেক দিন ধরেই অর্থাৎ হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে প্রতি মঙ্গলবার রোগী দেখতে যাই। স্বল্প আয়ের লোকজন, খেটে খাওয়া শ্রমিক, কৃষক যাদের দেখে আমি খুব পরিতৃপ্তি পাচ্ছিলাম। তাই হাসপাতালের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার মালয়েশিয়ান ভদ্রমহিলা, যিনি একজন ক্যান্সার সার্ভাইবার এবং আমার প্রতি তার বেশ শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা, আমি তাকে বললাম যে, এবারের ১৭ মার্চ চল আমরা এই হাসপাতালে একটু সুন্দরভাবে পালন করি। সে আমাকে জিজ্ঞাসা করল, আপনার পরামর্শ কী, আমি তাকে বললাম দেখো এবার আমরা শুধু ফ্রি রোগী দেখব না, আমাদের প্রেসক্রিপশনের ওপর ভিত্তি করে যদি কেউ হাসপাতালের ডিসপেনসারি থেকে ওষুধ কিনে তাদের আমরা ৫% কনসেশন দেব। এবং যদি কেউ এই হাসপাতালে নির্দেশিত প্রেসক্রিপশনের ওপর লেখা কোনো ল্যাবরেটরির টেস্ট করতে চায় তাহলে তাদের ২০% কনসেশন দেওয়া হবে। এবং সকাল থেকেই হাসপাতালের কর্মীরা প্রতিটি শিশুকে একটি বেলুন দেবে, একটু খাদ্য দেবে বা পানীয় দেবে এবং হাসপাতালটা অত্যন্ত সুন্দরভাবে সাজিয়ে একটা উৎসবমুখর দিন হিসেবে রোগীদের সেবা দিতে চেষ্টা করব। আমি জানি না, সিইও কেন একবাক্যে আমার সব কথা গ্রহণ করলেন। তিনি মালয়েশিয়ায় তার প্রধানের সঙ্গে আলাপ করেছেন কিনা জানি না। আমি ১৭ মার্চ সকালবেলায় খুব ভোরে যখন সেখানে যাই গিয়ে দেখলাম আমি যা বলেছি তাই হচ্ছে। শেষাবধি আমি অত্যন্ত প্রশান্তির একটা মন নিয়ে আমার নাক, কান, গলা বিভাগের যেখানে রোগী দেখার কথা, সেখানে উঠে গেলাম। দেখলাম অসংখ্য রোগী অপেক্ষা করছেন। আমার সহকর্মী, আমার সঙ্গে যে গত ১০ বছর ধরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং আমার চেম্বারে কাজ করেছিলেন ডাক্তার জুয়েল ইতিমধ্যেই রোগী দেখা শুরু করে দিয়েছেন। তার পর দুজন মিলে আমরা ১১৯ জন রোগী দেখলাম। এবং সত্যিকার অর্থে ১১৯ জনের মধ্যে কেউ ফ্রি চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে বলেই যে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন সেখানে ফ্রি চিকিৎসা দেওয়া হবে বলে ভিতরে ঢুকে ডাক্তার দেখিয়ে যাননি। সবাই রোগী ছিলেন। এবং যাদের চিকিৎসা দরকার ছিল তারাই এসেছিলেন। এটা একটা ব্যতিক্রমী ঘটনা।

কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো আমারই এক সহকর্মী ১৭ তারিখ ভোরে আমি যখন তার দেখা পাই তখন সে বলল, স্যার আপনি যে পদ্ধতি চালু করেছেন সেটার জন্য ডাক্তারদের মধ্যে কেউ কেউ পছন্দ করেননি।

ডাক্তারদের একাংশের এই ক্ষোভটা হয়তো বা থাকত না। যদি ওই ১৭ মার্চ রোডস অ্যান্ড হাইওয়ের সব কর্মী রাস্তায় নেমে রাস্তাটা ঠিক করত। ওয়াসার কর্মীরা তার পানির লাইনগুলো ঠিক করত। পরিবেশ বা পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা ঢাকাকে পরিষ্কার রাখার জন্য উঠেপড়ে লাগত, তাহলে সবাই সানন্দে গ্রহণ করত। এবং আমি আশা করব ভবিষ্যতে সব ক্ষেত্রে সর্বজন যদি এই দিনটাকে উৎসবের মতো করে গ্রহণ করে নেন তাহলেই বোধহয় আমার চিন্তার সার্থকতা আসবে।

আমি তো মনে করি ২০১৮ সালে অথবা এ বছর থেকেই আমরা বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছার জন্মদিনটিও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা কেপিজে মেমোরিয়াল হাসপাতালে একইভাবে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের মতো উদ্যাপন করব এবং তাতে করে বছরে ন্যূনতম দুবার আমরা মানুষকে এই সেবাটা দিয়ে যেতে পারব।

লেখক : ভাইস চ্যান্সেলর (সাবেক), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর