বুধবার, ২৬ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

চিকিৎসাসেবা নিয়ে কিছু কথা

স্বপন দাশগুপ্ত

চিকিৎসাসেবা নিয়ে কিছু কথা

আমাদের দেশে চিকিৎসার জন্য সরকার যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করেছে।  সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসার মানও বেড়েছে। কিন্তু দেশের অনেক রোগী পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত কিংবা সিঙ্গাপুরসহ বিদেশের হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। চিকিৎসার জন্য কেন বিদেশে যাচ্ছেন? এটাই মূল বিবেচ্য বিষয়। চিকিৎসার মান বৃদ্ধি পেলেও চিকিৎসক এবং বেসরকারি হাসপাতালের মালিকদের মানসিকতার কারণে এসব রোগীর অধিকাংশই বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। ভারতের ব্যাঙ্গালুরুর ডাক্তার দেবী প্রসাদ শেঠীর প্রতিষ্ঠিত নারায়ণ হৃদয়ালয়ে (ইনস্টিটিউট অব কার্ডিয়াক সায়েন্স) চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলাম। ওখানে গিয়ে দেখি ওই হাসপাতালের শতকরা ৭০ ভাগ রোগী বাংলাদেশের। বিশেষ করে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও সিলেটের বাসিন্দা। তাদের অনেকের সঙ্গে আলাপ করেছি। তারা বাংলাদেশের চিকিৎসার ক্ষেত্রে উন্নতির কথা স্বীকার করলেও ডাক্তারের প্রতি আস্থা রাখতে না পেরেই ভারতে চিকিৎসার জন্য গিয়েছেন। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী সেলিম সাহেব (পুরো নাম উল্লেখ করা হয়নি) ঢাকায় চিকিৎসার জন্য এসেছিলেন। রাজধানীর একটি বিখ্যাত হাসপাতালের ডাক্তার দেখানোর পর তাকে হার্টের বাইপাস করতে বলা হয়। কিন্তু এখানে (বাংলাদেশে) অপারেশন না করে ভারতের ব্যাঙ্গালুরুতে তিনি চলে যান। ডা. দেবী শেঠীকে দেখান। ডা. দেবী শেঠী তাকে অপারেশন না করে দুই বছরের জন্য ওষুধ দিয়ে দেন। ডা. তাকে বলেন, ‘অপারেশন করতে হবে না। ওষুধ দিলাম,  দুই বছর পর আসবেন’। প্রায় একই কথা বললেন সিলেটের ব্যবসায়ী আজিজুর রহমান ও টাঙ্গাইলের আবু তাহের। এই দুজনকে বাংলাদেশে হার্টের অপারেশন করার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। ঢাকার নামকরা হাসপাতাল থেকে এই পরামর্শ পেয়ে তারা অপারেশন না করে দেবী শেঠীর কাছে চলে যান। ডা. দেবী শেঠী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলেছেন, ‘হার্টের যে অবস্থা তাতে অপারেশনের কোনো দরকার নেই। রীতিমতো ওষুধ খাবেন, ব্যায়াম করবেন, তাহলেই সুস্থ থাকবেন’।

আমাদের দেশে চিকিৎসার ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হচ্ছে, ডাক্তাররা যে কোনো রোগীকে অপারেশন করতে বলেন। কিন্তু ডা. দেবী শেঠী অপারেশন না করে ভিন্ন চিকিৎসা দেন। এ কারণেই এই দেশের রোগীরা চিকিৎসার জন্য ভারতে যান। বাংলাদেশের স্বনামধন্য চিকিৎসকরা কেন রোগীকে অযথা অপারেশন করার ঝুঁকি নেন এটা বোধগম্য নয়। যদিও চিকিৎসাশাস্ত্রে আমার জ্ঞান খুবই কম। তারপরও দুই দেশের দুই ডাক্তারের দুই মত এটা কীভাবে সম্ভব? এ কারণেই চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও সিলেটের রোগীরা যাদের সামর্থ্য আছে তারা ভারতে ডা. দেবী শেঠীর কাছে চলে যান। ডা. দেবী শেঠী খুব প্রয়োজন ছাড়া কাউকে অপারেশন করতে চান না। তার যুক্তি, অপারেশন করলে নতুন কোনো কমপ্লিকেশনের সৃষ্টি হয়। রোগীকে এ অসুবিধা থেকে রক্ষা করার জন্যই অপারেশন না করে ওষুধ দিচ্ছেন। শুধু হার্টের চিকিৎসা নয়, বিভিন্ন দুরারোগ্য রোগের চিকিৎসা করা হয় ওই হাসপাতালে। এক মাসের শিশু থেকে পাঁচ বছরের শিশু পর্যন্ত সবাই হার্টের চিকিৎসার জন্য ডা. দেবী শেঠীর কাছে যান। শিশুদের অপারেশন করিয়ে সুস্থ অবস্থায় দেশে তারা ফিরে আসেন। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী সাহাবুদ্দিন আহম্মেদের শিশু মেয়ে-ডেলিভারির সময় ডান হাত ছোট হয়ে গিয়েছিল। এই হাত ঠিক করার জন্য ঢাকার সরকারি হাসপাতালসহ অন্য দুটি হাসপাতাল এবং চট্টগ্রামের একটি ক্লিনিকে চিকিৎসা করিয়েছেন। আরোগ্য না হওয়ায় তিনি বাধ্য হয়ে ডা. দেবী শেঠীর শরণাপন্ন হয়েছেন। ডা. দেবী শেঠী বলেছেন, হাতের অপারেশন করতে হবে। তিনি অপারেশন করিয়েই চট্টগ্রাম ফিরে আসবেন।

ভারতের একটি প্রদেশ কর্নাটক। এই কর্নাটকে একটি জেলায় ডা. দেবী শেঠীর জন্ম। ভারত থেকে ডা. দেবী শেঠী উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার জন্য বিদেশে যান। সেখানে পড়াশোনা শেষ করে কিছু দিন সেখানকার হাসপাতালে ডাক্তার হিসেবে যোগ দেন। কয়েক বছর পর তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন এবং কলকাতায় একটি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা শুরু করেন। এরপর তিনি কলকাতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু একটি শিশু রোগীকে চিকিৎসা করা নিয়ে হাসপাতালের অন্যদের সঙ্গে তার বিরোধ বাধে। এই বিরোধের কারণেই তিনি কর্নাটকের রাজধানী ব্যাঙ্গালুরুতে চলে যান। ব্যাঙ্গালুরুর বুমাসান্দ্রায় একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। তার শ্বশুর ব্যবসায়ী নারায়ণ শেঠী (শঙ্কর নারায়ণ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা) হাসপাতালের জন্য জায়গা ও অর্থ প্রদান করেন। ওই অর্থেই  পরবর্তীতে ডা. দেবী শেঠী নারায়ণ হেলথ সিটি নামের একটি কমপ্লেক্স তৈরি করেন। ওই কমপ্লেক্সের মধ্যে নারায়ণ হৃদয়ালয় (কার্ডিয়াক হাসপাতাল), মজুমদারস মেডিকেল সেন্টার, স্পর্শ, ইনস্টিটিউট অব ভাসকুলার সায়েন্স, নারায়ণ নেত্রালয়, থম্বোসিস রিচার্স সেন্টার, ব্ল্যাড ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। ডা. দেবী শেঠীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী এগিয়ে এসেছেন এই কমপ্লেক্স নির্মাণের জন্য। এই হেলথ সিটির একজন অংশীদার হলেন মজুমদার গ্রুপের অন্যতম কর্ণধার কিরণ মজুমদার। এই হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য প্রত্যেক রোগীকেই রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। কর্নাটকের বাইরের রোগীকে পাঁচশত টাকা, আর কর্নাটকের রোগীকে মাত্র ১০ টাকা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। এই রেজিস্ট্রেশনের টাকার মধ্যে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ফিও ধরা আছে। শুধু (টেস্ট) পরীক্ষার টাকা আলাদা দিতে হয়। কর্নাটকের রোগীরা ডা. দেবী শেঠীকে ঈশ্বর বলে মনে করেন। বাংলাদেশের অনেক রোগীকে আমি দেখেছি ডা. দেবী শেঠীর পা ধরে সালাম করতে। এই ডা. দেবী শেঠীর চিকিৎসা নিয়ে অনেকেই সুস্থ আছেন। তাই তো ডা. দেবী শেঠীকে দেখানোর জন্য ভিড় পড়ে যায়। বিদেশি রোগীর ক্ষেত্রে সাত দিনের আগে তার সিরিয়াল পাওয়া যায় না। কিন্তু কর্নাটকের রোগীদের জন্য কোনো সিরিয়ালের দরকার হয় না। জরুরি ভিত্তিতে তাদের চিকিৎসা করা হয়। সকাল থেকে রেজিস্ট্রেশনের জন্য লাইন ধরতে হয়। এত কষ্ট করেও বাংলাদেশের রোগীরা ডা. দেবী শেঠীকে দেখানোর জন্য ভারতের ব্যাঙ্গালুরুতে যান। এভাবেই ডা. দেবী শেঠী জনগণকে চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকেন। আমাদের দেশের ডাক্তাররা যদি জনসেবাকে মুখ্য মনে করেন, তাহলে তারাও ডা. দেবী শেঠীর মতো চিকিৎসা দিতে পারেন।  কিন্তু তা না করে অধিকাংশ চিকিৎসকই সেবাকে প্রাধান্য না দিয়ে অর্থ উপার্জনকে প্রধান মনে করেন।  এটাই হচ্ছে ডা. দেবী শেঠীর সঙ্গে অন্য চিকিৎসকদের পার্থক্য।

     লেখক : সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর