বুধবার, ২৬ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

জঙ্গিবাদ যে কারণে এখন মতবাদ

মোশাররফ হোসেন মুসা

অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে বস্তু সতত পরিবর্তনশীল। সমাজ বস্তুর সামগ্রিক রূপ হওয়ায় সমাজও পরিবর্তনশীল। অর্থাৎ একটি সমাজবদ্ধ মানুষের ধ্যান-ধারণা, আচার-ব্যবহার, অভ্যাস-মূল্যবোধ, পরিবেশ-প্রতিবেশ ইত্যাদির সমষ্টি সংস্কৃতি হওয়ায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃতিরও পরিবর্তন ঘটে। ধর্ম একটি বিশ্বাসের বিষয় এবং এটি টিকে আছে কতকগুলো আচার-অনুষ্ঠানের ওপর ভিত্তি করে। সেজন্য ধর্মকে সংস্কৃতির অংশ বলা হয়। কিন্তু ধর্মান্ধরা এটি মানতে নারাজ। তাদের বক্তব্য— ধর্মের বাইরে অন্য কোনো সংস্কৃতি থাকতে পারে না। অন্যদিকে গণতন্ত্র ও প্রগতিবাদীরা রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে বিচ্ছিন্ন করে আধুনিক রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। আশা করা হয়েছিল, পৃথিবীতে ধর্মের চেয়েও উন্নত সংস্কৃতি প্রাতিষ্ঠানিকতা লাভ করবে (যদিও কয়েকটি দেশে সংস্কৃতি উন্নত মাত্রা লাভ করেছে)। কিন্তু অধিকাংশ দেশে শাসনগত ত্রুটির কারণে মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছে। ফলে ধর্মীয় সংস্কৃতিকে এখন উন্নত সংস্কৃতি মনে করা হচ্ছে। সেই সুযোগে কতিপয় সুযোগসন্ধানী এটিকে মতাদর্শ হিসেবে প্রচার করে জঙ্গিবাদের জন্ম দিচ্ছে। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, কোনো ধর্মই ভৌগোলিক পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। যেমন আর্যরা ছিল যাযাবর জাতি। পশুপালন ছিল তাদের একমাত্র জীবিকা। পশু চারণের জন্য দিগন্ত বিস্মৃত মাঠের প্রয়োজনীয়তা ছিল। তাদের কল্পনায় আকাশ দেবতা দিয়ায়ুস ছিল বড় দেবতা। বৃষ্টি দেবতা ইন্দ্র ছিল ছোট দেবতা। কিন্তু আর্যরা যখন ভারতে এসে কৃষি আবাদ শুরু করে তখন ইন্দ্রই বড় দেবতা হয়ে পড়ে। আবার সেমেটিক অঞ্চলে নিচে রয়েছে তপ্ত-বালি আর উপরে প্রচণ্ড তাপবাহী সূর্য। ফলে সেখানকার মানুষের কাছে সূর্য দেবতা ছিল বড় দেবতা। এশিয়ান ও বেবিলিয়ানদের অসুর ও মারডক দেবতা সূর্য দেবতারই বিভিন্ন রূপ। সূর্যপূজার হাত ধরেই সেখানে একেশ্বরবাদের ধারণা আসে প্রথম। স্বর্গ ও নরকের ধারণাতেও ভৌগোলিক পরিবেশের ছায়া দেখতে পাওয়া যায়। সেমেটিক অঞ্চলের ধর্মের স্বর্গে রয়েছে ফলমূল, ঠাণ্ডাজলের নদী ও ছায়া ঢাকা সুশীতল আবাসের বর্ণনা। কিন্তু বরফপ্রধান দেশের স্বর্গে এর বিপরীত চিত্র লক্ষ্য করা যায় (এ বিষয়ে সমাজবিজ্ঞানী একে নাজমুল করিমের ‘ভূগোল ও ভগবান’ শীর্ষক একটি চমৎকার প্রবন্ধ রয়েছে)। তবে খ্রিস্টধর্মের প্রচারকেরা বহু আগেই ভূগোলের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্কটা উপলব্ধি করতে পেরেছেন। এদেশে জনৈক যাজকের মুখে শোনা গেছে— ‘তোমরা আগে ভালো বাঙালি হও, তবেই ভালো খ্রিস্টান হতে পারবে’। সে জন্য সম্ভবত তারা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী লোকদের ধর্মান্তরিত করতে গিয়ে তাদের সংস্কৃতি পরিত্যাগ করতে উৎসাহ দেখান না। কিন্তু ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা (বিশেষ করে রাজনৈতিক ইসলামপন্থিরা) এ সত্যটি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হচ্ছেন বলে বিভিন্ন দেশের প্রচলিত সংস্কৃতির সঙ্গে তারা নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারছে না। ইংল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরুন তার আমলে রেলস্টেশন ও পাতাল ট্রেনে জঙ্গি হামলার পর এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন— ‘মুসলিমরা শত শত বছর যাবৎ ব্রিটেনে বসবাস করার পরেও কেন যে নিজেদের ব্রিটিশ ভাবতে পারছেন না তা বোধগম্য নয়’। অর্থাৎ ইসলামপন্থিরা ধর্মকে সংস্কৃতি না ভেবে মতাদর্শ ভাবতেই বেশি পছন্দ করেন। তারা স্বীকার করুক বা না করুক ধর্ম যে একটি সংস্কৃতি এবং এর আচার-অনুষ্ঠানও যে পরিবর্তনশীল তার পক্ষে বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। যেমন— মাইকে আজান দেওয়া ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে নামাজ আদায় করা উদাহরণ হতে পারে। তাছাড়া বিভিন্ন আকিদার বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের উদাহরণও রয়েছে। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীর বয়স ৫০০ কোটি বছর হলেও হোমোসেপিয়েন্স (মগজধারী) মানব প্রজাতির আবির্ভাব ঘটেছে মাত্র ৪০ হাজার বছর আগে। মানুষ কোনো ধর্ম নিয়ে জন্মগ্রহণ করেনি। প্রকৃতির রুদ্ররূপ দেখে মানুষ প্রথমে ভয় পেত এবং প্রশ্ন করত কেন এমন ঘটে। সেসময় অপেক্ষাকৃত বুদ্ধিমান ব্যক্তি তার মতো করে ব্যাখ্যা দিতেন (যাকে Feelings, Knowledge, Action এর সঙ্গে তুলনা করা যায়)। তখন থেকেই অলৌকিক শক্তির ওপর বিশ্বাস স্থাপন শুরু হয়। মানুষ অলৌকিক শক্তির ওপর বিশ্বাস রাখলেও কোনো আবিষ্কারই অলৌকিকভাবে ঘটেনি। প্রস্তুর যুগ, শিকার যুগ, কৃষি যুগ, শিল্প যুগের মানুষের নিত্যনতুন আবিষ্কার ও কর্মযজ্ঞের দিকে দৃষ্টি দিলে এর পক্ষে বহু প্রমাণ পাওয়া যাবে। এক্ষেত্রে মার্কসবাদীদের বক্তব্য— ‘মনুষ্য জীবনের ইতিহাস শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস’ (যদিও শ্রেণি সৃষ্টির পূর্বে এবং এর বাইরেও মানুষের ইতিহাস রয়েছে)। আর ধর্মবাদীদের বক্তব্য— ‘মনুষ্য জীবনের ইতিহাস সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্বের ইতিহাস’। সত্য সম্পর্কে বহু রকম সংজ্ঞা রয়েছে। মহাত্মা গান্ধী প্রথম জীবনে মনে করতেন ‘ঈশ্বরই সত্য’। পরবর্তী জীবনে মত পাল্টিয়ে বলেন— ‘সত্যই ঈশ্বর’। জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর যখন সাম্রাজ্যে রূপ নেয় তখন বহু ঈশ্বরের স্থলে একেশ্বরবাদের ধারণাই ফলদায়ক হয়ে পড়ে। বলা হতো, একজন ঈশ্বর যেমন মহাবিশ্বের অধিপতি, তেমনি একজন রাজা হবেন একটি দেশের সর্বেসর্বা। তবে সমাজে উৎপাদন শক্তির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃতিরও পরিবর্তন ঘটে। শিল্প যুগে মানুষের স্বাধীনতাকে স্বীকার করা হয়। অবসান ঘটে দাস যুগের। রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে বিচ্ছিন্ন করে আধুনিক রাষ্ট্রের জন্ম দেওয়া হয়। সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা ও মানবতাকে সামনে করে যাত্রা শুরু হয় আধুনিক গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের। কালক্রমে সমাজতন্ত্রীরা মানবতাবাদ ও শোষণহীন সমাজ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে হরণ করে এবং বাছাইকৃত ব্যক্তিদের শাসনের নামে জন্ম দেয় রেজিমেন্টেড আমলাতন্ত্রের। ফলে একসময় সমাজতন্ত্রের পতন ঘটে (এটাকে ঊনবিংশ শতাব্দীর সমাজতন্ত্র বলাই সঙ্গত হবে)। কেউ কেউ গণতন্ত্রের মডেল হিসেবে কয়েকটি কল্যাণকর রাষ্ট্রের উদাহরণ দেন (যা স্কেন্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে বিদ্যমান রয়েছে)। কিন্তু স্বল্প সম্পদ আর অধিক জনসংখ্যার দেশকে দ্রুত কল্যাণকর রাষ্ট্রে পরিণত করা সম্ভব নয়। সম্প্রতি ড. জাফর ইকবাল ‘অনলাইন জীবন’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে ফেসবুক ও ইন্টারনেটের কুফল সম্পর্কে বলতে গিয়ে এক জায়গায় বলেছেন, ‘আমরা আসলে একটা ক্রান্তিকালের মাঝে বাস করছি। পুরো পৃথিবীটা আসলে একটা খুব বড় ধরনের পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে, আমরা এখনো জানি না পরিবর্তনটা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে থামবে’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৪ মার্চ ’১৭)। কিন্তু পরিবর্তন কখনো থামে না। তবে বর্তমান অবস্থায় বলা যায়, জঙ্গিবাদের জন্য একমাত্র মুসলমান সমাজকে দায়ী করা ঠিক হবে না। ধর্ম ও জাত্যভিমান এখন প্রায় সব দেশের রাজনীতিতে অনুষঙ্গ হয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন সম্প্রতি বলেছেন, ‘সকলের মধ্যে এখন আত্মপরিচয়ের সংকট দেখা দিয়েছে’। সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, ২০২০ সালে পৃথিবীটা একটা ছোট্ট পরিবর্তনের দিকে টার্ন নেবে এবং ২০৫০ সালের দিকে সমগ্র পৃথিবীটা মহাপরিবর্তনের দিকে টার্ন নেবে। তখন হয়তো জাতিসংঘ হবে ‘বিশ্ব-সরকার’ আর বর্তমান দেশগুলো হবে স্থানীয় সরকারের মতো।  আশা করা যায়, সেসময় বর্তমানের মতো দলতন্ত্র, ব্যক্তিতন্ত্র, ধর্মীয় গোঁড়ামি, পুঁজিবাদের দাসত্ব, গণতন্ত্রের নামে পররাজ্য দখল, মারাত্মক আগ্নেয়াস্ত্রের প্রতিযোগিতা ইত্যাদি থাকবে না। সেজন্য প্রস্তুতিস্বরূপ এখন থেকেই সবাইকে উপযুক্ত শাসনের ডিজাইন নিয়ে আলোচনা শুরু করতে হবে।  মনে রাখা দরকার, মানুষ পৃথিবীতে অন্ধত্ববাদের কাছে পরাজিত হওয়ার জন্য আসেনি।

লেখক : গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক।

  মেইল : [email protected]  

সর্বশেষ খবর