শনিবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

হাওরের জন্য আছে কি বিকল্প ধানের জাত?

শাইখ সিরাজ

হাওরের জন্য আছে কি বিকল্প ধানের জাত?

ছয় ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। পৃৃথিবীতে বোধ করি আর কোনো দেশ নেই যেখানে ছয় ঋতু বলে কিছু আছে। জন্মের পর থেকে বছর দশ-পনেরো আগ পর্যন্ত প্রতিটি ঋতুর প্রভাব আমরা অনুভব করতাম। এখন কেমন যেন ঋতুগুলোকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হারিয়ে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে আমার মনেই পড়ে না কবে শেষ দেখেছি হেমন্তকে। এখনকার মানুষ যারা, তারা তো এসব ঋতু সম্পর্কে কিছু বলতেই পারবে না। দোষটা তাদের নয়, দোষটা আসলে কার সে নিয়েই এ লেখার সূচনা। সেই আশির দশকের শুরু থেকেই মাঠপর্যায়ে কাজ করে চলেছি। এই দীর্ঘদিন কাজ করার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি—প্রকৃতি, পরিবেশ সব পাল্টেছে, আরও পাল্টাবে ভবিষ্যতে। আর এই যে বিশাল পরিবর্তনটি আমাদের সবার সামনে ঘটছে, এটি হচ্ছে শুধু পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আতঙ্ক, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে। খেয়াল করে দেখুন গেলবার শীত পেয়েছিলেন? ১৫২ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছে শুধু মার্চেই, যা আগে কখনো হয়নি। বেড়েছে শিলাবৃষ্টি। লবণাক্ততা এমন বেড়েছে যে তা ধীরে ধীরে ধেয়ে আসছে দেশের মধ্যাঞ্চলের দিকে।

বহু বছর আগে একটি চলচ্চিত্র দেখেছিলাম, দ্য ম্যান হু স টুমরো। এরপর দেখেছি ডে আফটার টুমরো এবং এরপর দেখেছি ২০১২ ছবিটি। এসব কাল্পনিক ছবি জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক প্রভাবের দৃশ্যপট তুলে ধরেছে কিন্তু বার বারই আমার মনে হয়েছে, না, এগুলো একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। আর এসব কাল্পনিক গল্পই তো এখন ধীরে ধীরে বাস্তবতায় রূপ নিচ্ছে। মনে করিয়ে দিচ্ছে ফরাসি নৃতাত্ত্বিক সমাজবিদ ক্লদ লেভি স্ট্রসের সেই মন্তব্য— ‘মনুষ্য প্রজাতি ছাড়াই বিশ্বজগৎ তার যাত্রা করেছিল এবং নিশ্চিতভাবেই তার সমাপ্তি ঘটবে মনুষ্য প্রজাতি ছাড়াই।’ এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, আমেরিকা— পৃথিবীজুড়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি জলবায়ু কত দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। কিছু দিন আগেই পত্রিকায় দেখলাম কানাডার ছোট শহর নিউফাউন্ডল্যান্ডে বরফের বড় চাঁই এসেছে। বহু পর্যটক আসছে দেখতে। কিন্তু ভয়ের কথা হলো, সুদূর আটলান্টিক থেকে জনপদের দিকে ধেয়ে আসছে আইসবার্গ। এ বিষয়গুলো খুব বেশি ভাবিয়ে তুলছে আমাদের।

সত্যি, আজ আর সেই পৃথিবী নেই। অনুকূল আকাশ, বিশুদ্ধ বাতাস, উর্বর মাটি, জীবনের হিসাবের সঙ্গে মেলানো জলবায়ু কিছুই নেই। সবই পাল্টে গেছে। কেউ কোনো দিন ভালো করে বুঝেও উঠিনি পৃথিবীর এই করুণ দশার পেছনে সব দায় আমাদেরই। এ যেন এক ধরনের ইচ্ছামৃত্যু। অথচ আমরাই মুখে বলি এই ধরিত্রী বেঁচে থাক। বেঁচে থাক জীববৈচিত্র্যের স্বাভাবিক শৃঙ্খলাগুলো। কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিশ্চিত এক আবাসভূমি কি রেখে যেতে পারছি আমরা?

‘প্রযুক্তির প্রতিযোগিতার যুগে প্রকৃতিকে জয় করে এগিয়ে যেতে চাইছে প্রযুক্তি আর এসব উদ্ভট কারণেই নানান সমস্যায় পড়তে হচ্ছে আমাদের’, এমনটাই বলেছিলেন ডেভিড সুজুকি, এক বিখ্যাত পরিবেশবিদ। আর বায়োমিমিক্রি গ্রন্থের লেখক জেনিন বেনিউস বলেছিলেন, যদি জানুয়ারি বছরের প্রথম মাস হয়, আর ডিসেম্বর হয় শেষ তাহলে এখন পৃথিবীর ডিসেম্বর মাস চলছে। আমাদের পৃথিবী কি সত্যিই ডিসেম্বর মাসে দাঁড়িয়ে আছে, মানে একদম শেষ প্রান্তে?

প্রিয় পাঠক! আসুন বাংলাদেশের হাওরাঞ্চলের দিকে তাকাই। কী ভীষণ মানবিক আর প্রাকৃতিক বিপর্যয় চলছে সেখানে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বাংলাদেশে আগাম বন্যা যেভাবে ধান, জলজ প্রাণী, হাঁস আর গবাদিপশু, সর্বোপরি জীববৈচিত্র্যের ওপর হামলে পড়েছে তাতে আর বুঝতে বাকি নেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কী। এ কথা সত্য যে, জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে আমাদের সীমিত জ্ঞানও বেশ প্রকট এবং দগদগে হয়ে উঠেছে। আমরা কতটা বুঝতে পারছি হাওরে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের প্রকোপ বা এ রকম ঘটতে পারে বাংলাদেশের যে কোনো দুর্যোগপ্রবণ এলাকায়। ছয়টি জেলা নিয়ে হাওরাঞ্চল। হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ ও মৌলভীবাজার। এর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত সুনামগঞ্জ। লাখ লাখ হেক্টর জমিতে কৃষক তার স্বপ্নের ধান বুনেছিল। সেই স্বপ্ন ভেসে গেছে উজানের ঢলে। সুনামগঞ্জে ২ লাখ ২৩ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে কৃষক বোরো ধান করেছিল। এরই মধ্যে সরকারি হিসাব বলছে ৮২ শতাংশ ধান শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু স্থানীয় কৃষক বলছে ৯০ শতাংশই শেষ। যে শনির হাওরকে ধানের খনি বলা হতো, তাও শেষ হয়ে গেছে ২২ হাজার একর জমির ধান নিয়ে। নেত্রকোনার ৮ উপজেলায় ১ লাখ ৮৪ হাজার ৩২০ হেক্টর ধানের জমির ভিতর ৪৮ হাজার ৬৭০ হেক্টর জমির ধান ডুবে গেছে আগাম বন্যার পানিতে, জানিয়েছেন জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক বিলাস চন্দ্র পাল।

পাঠক! আরও কিছু তথ্য দিতে চাই। কৃষক এবারে সাড়ে ৪ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করেছিল হাওরে, যার ১.৪১ লাখ হেক্টরই এখন পানির নিচে। এ তথ্য জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের। ১৪২টি হাওরই এখন পানির নিচে। তবে জেলা কৃষি অফিস বলছে আড়াই লাখ হেক্টরের মতো ধানিজমি এখন নিমজ্জিত। ৮৭টির মতো বাঁধ ভেঙে গেছে। আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৪ হাজার কোটি টাকার ওপর। হাওর অ্যাডভোকেসি প্লাটফরম বলছে, ১০ লাখ টন ধান, ২ হাজার মেট্রিক টন মাছ এবং ১১ হাজার ৩০৫ টন গবাদিপশুর খাদ্য নষ্ট হয়ে ক্ষতির এই পরিমাণ দাঁড়িয়েছে। তবে  ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। হাওর একটি প্রাকৃতিক জলাশয়। বৃহত্তর সিলেটের একদিকে পাহাড় আর একদিকে হাওর। বর্ষায় পাহাড়ি ঢল ওপর থেকে নেমে নিম্নাঞ্চলের দিকে আসবে, সে পানি হাওরকে বছরের নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত জলমগ্ন রাখবে, আবার চলে যাবে— এটিই প্রকৃতির স্বাভাবিক আচরণ। ভাবুন তো, বিগত সময় ধরে আমরা এই স্বাভাবিক গতি-প্রকৃতিকে কীভাবে বিনষ্ট করেছি! অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ, ব্যক্তিপর্যায়ে মাছ চাষের জন্য পুকুর খনন, ফল-ফসল আবাদের জন্য ছোট-বড় বাঁধ নির্মাণ— এই বিষয়গুলো পাঁচ দশক ধরে হাওরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে বিপর্যস্ত করেছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এক কথায় যাকে আমরা বলতে পারি মানবসৃষ্ট বিপর্যয়। কৃষিকে এ রকম দুর্যোগ থেকে বাঁচাতে আমাদের রয়েছে লবণ, খরা, বন্যাসহিষ্ণু ধানের জাত। তবে সময় এসেছে এই জাতগুলোর সহনশীল ক্ষমতা আবার পরীক্ষা করার। প্রয়োজনে নতুন জাত উদ্ভাবন করতে হবে। আমাদের বিজ্ঞানী এবং নীতিনির্ধারকদের সময় জয় করে চলতে হবে। যে কোনো বিপদের আগাম দিকটাও মাথায় রেখে এসব প্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ে যেতে হবে। যেমন কার্তিকে যে মঙ্গা হতো দেশের উত্তরাঞ্চলে, সেই মঙ্গাকে প্রতিহত করা গেছে একাধিক স্বল্পমেয়াদি (Short Duration Variety) ধানের জাত দিয়ে। ব্রি ধান ৩৩, ৩৯ এবং বিনা ধান ৭, এগুলো আগাম জাতের স্বল্পমেয়াদি ধান; যা কার্তিক আসার আগেই কৃষক ঘরে তুলতে পারে। নতুন জাতের এই ধানটি দিয়ে মঙ্গাকে জয় করেছে স্থানীয় কৃষক। এ সফলতা দেখিয়েছেন আমাদের ধানবিজ্ঞানীরা।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে হাওরাঞ্চলের জন্য স্বল্পমেয়াদি বোরো ধানের কোনো জাত আছে কিনা? আমার জানামতে নেই। ৬০-৭০-৮০-এর দশকে কৃষক আইআর-৮ জাতের ধান চাষ করত হাওরাঞ্চলে; যার মেয়াদকাল লাগানোর পর থেকে কাটা পর্যন্ত ১৭০ দিন। পরে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত বিআর ২৮ ও ২৯ জাত বোরো মৌসুমের জন্য উফশী জাত হিসেবে চাষ করল কৃষক। বিআর ২৮ লাগানোর পর থেকে ১৪০ দিন এবং বিআর ২৯— ১৬০ দিনে ফসল কাটা যায়। সাধারণত হাওরের কৃষক বিআর ২৮-এর সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে পড়ল বেশি। কারণ আগাম বন্যার পানি আসার আগেই তারা ফসল তুলতে পারে। চলতি বছরের বিপর্যয়ের আগে বিগত বছরগুলোয় অন্যান্য যে ফসল বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছিল, সেগুলো প্রধানত বাঁধ ভেঙে গিয়ে ফসল তলিয়ে যাওয়া এবং কখনো কখনো অতি-আগাম বন্যা। পাঠক! আমি কোনো কৃষিবিদ কিংবা ধানবিজ্ঞানী নই। কাজ করতে গিয়ে যতটুকু দেখেছি সেই আলোকে কিছু কথা বলতে চাই। জানামতে হাওরাঞ্চলের জন্য বোরো মৌসুমে এখন পর্যন্ত কোনো স্বল্পমেয়াদি ধানের জাত উদ্ভাবন হয়নি। সেদিক থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করলে আপাতত হাওরাঞ্চলে অতি-আগাম বন্যা হলে ফসল বাঁচানোর কোনো রাস্তা নেই। আমন ও আউশের জন্য ১০০/১১০ দিনে ফসল কাটা যায়, এমন স্বল্পমেয়াদি জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। বোরো মৌসুম যখন শুরু হয়, তখন এ দেশে শীতের শেষ ভাগ। বোরো ধান লাগানোর সময় নিম্ন তাপমাত্রা থাকে। অন্যদিকে, বীজতলায় ২০/২৫ দিন বয়সী চারাগুলো শীতের কারণে কখনো কখনো কোল্ড ইনজুরিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়; যার ফলে পরবর্তীতে ধান হলেও তা চিটা হয়ে যায়। এ রকম অনেক কারণেই এ সমস্যার থেকে পরিত্রাণ সত্যি সত্যি দুরূহ। পরামর্শ দেওয়া উচিত হবে কিনা জানি না, আমার জানামতে হাওরে স্থানীয় যেসব জাত আছে, যেমন জলি আমন— এগুলোকে সংকরায়িত করে নতুন কোনো জাতের উদ্ভাবন করা যায় কিনা বিজ্ঞ বিজ্ঞানীরা নিশ্চয়ই ভাবছেন। অন্যদিকে এ কথাও ঠিক, নতুন একটি জাত উদ্ভাবন করতে সময় লেগে যায় ১০ থেকে ১৫ বছর। সেদিক থেকে যে গতিতে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে সে গতিতে পরিবর্তিত এ জলবায়ুকে জয় করার জন্য প্রয়োজনীয় যে সময় লাগছে, গবেষণা সেই গতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না।

প্রিয় পাঠক! যখন এই লেখা প্রকাশিত হবে, তখন ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হয়তো আরও বাড়বে। আমাদের বুঝতে হবে জলবায়ু পরিবর্তন মানে শুধু আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে কয়েকটি টাকা নিয়ে সেমিনার বা ওয়ার্কশপ করা নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবগুলো সম্পর্কে আমাদের যথেষ্ট জ্ঞান রাখতে হবে এবং সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে। এ বিষয়ে আমি কোনো বিশেষজ্ঞ নই, আমি মাঠকর্মী মাত্র। যা দেখি সে সম্পর্কে মানুষকে জানানো আমার কাজ। আর আমাদের আরও যা বুঝতে হবে, তা হলো হাওরের ভাগ্যে যা ঘটল তা শুধু হাওর এলাকায় সীমাবদ্ধ কোনো ঘটনা নয়। বাংলাদেশের অন্য সব দুর্যোগপ্রবণ এলাকা ঠিক হাওরের মতোই আক্রান্ত হতে পারে, যদি না আমরা এখনই সতর্ক ও সুদূরপ্রসারী হই।

আমরা সবাই জানি রূপকল্প ২০২১, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা— যা-ই বলি না কেন সবকিছুর ভিতরই আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা, টেকসই উন্নয়নের কথা বলা আছে। সে হিসেবে ভবিষ্যতে আমাদের খাদ্য উৎপাদনের রূপকল্পটিও আঁকা আছে। আমি মনে করি, পরিবর্তিত জলবায়ুর নিরিখে গবেষণায় বিনিয়োগ অনেক বাড়াতে হবে। মেধাবী তরুণ-তরুণীদের কৃষি শিক্ষায় সম্পৃক্ত হতে হবে। রাষ্ট্রের চিন্তা-চেতনার কেন্দ্রবিন্দুতে কৃষিকে আরও গুরুত্ব দিতে হবে— এগুলো এখন সবই সময়ের দাবি।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

     [email protected]

সর্বশেষ খবর