রবিবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

বিএনপিতে নমিনেশন বেপারিরা গোঁফে তেল দিচ্ছে

কাজী সিরাজ

বিএনপিতে নমিনেশন বেপারিরা গোঁফে তেল দিচ্ছে

জনগণের মধ্যে ভোটের উত্তাপ তেমন একটা ছড়িয়ে না পড়লেও আমাদের জাতীয় রাজনীতির প্রধান দুই ‘তরফ’ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যে ‘ইলেকশন ফিভারে’ ‘আক্রান্ত’ তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সরকারের মেয়াদ পূর্তির প্রায় পৌনে দুই বছর আগে থেকেই নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে দিয়েছেন। সভা-সমাবেশে তিনি ভোট চাওয়া শুরু করেছেন জনগণের কাছে।  তিনি জেলা সফরে যাচ্ছেন এবং সরকারি কর্মসূচির পাশাপাশি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে ‘নৌকার’ পক্ষে প্রচার চালাচ্ছেন। সর্বশেষ তিনি সমাবেশ করেছেন ফরিদপুরে। দলের সাধারণ সম্পাদক ওয়াবদুল কাদেরসহ অন্য কেন্দ্রীয় নেতারাও জেলায় জেলায় কর্মিসভা, প্রতিনিধি সভা, বর্ধিত সভায় হাজির হচ্ছেন। সর্বশেষ চট্টগ্রাম ও সিলেটে এমন সভা হয়েছে। আবারও বিজয়ী হয়ে সরকার গঠনের লক্ষ্যে ক্ষমতাসীন দলকে বেশ মরিয়া বলেই মনে হচ্ছে। ইতিমধ্যে আগামী সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে চলতি এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী কার্যালয় খোলা হয়েছে। অর্থাৎ দলগতভাবে আওয়ামী লীগ পরবর্তী নির্বাচনের কাজ শুরু করে দিয়েছে। শাসক লীগের আগাম তত্পরতা থেকে নির্বাচনের সময়-কাল নিয়েও আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেক পর্যবেক্ষক বলছেন, লীগ নেতাদের কেউ কেউ নির্ধারিত সময়েই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বললেও প্রধানমন্ত্রীর তত্পরতায় মনে হয় নির্বাচনটা আগেও হয়ে যেতে পারে। দলের প্রার্থী যাচাই-বাছাইয়ের কাজ শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীদের ব্যাপারে ‘সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন’ (সিআরআই) নামক একটি প্রতিষ্ঠান একাধিক জরিপ চালিয়েছে বলে জানা গেছে। এর বাইরে সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাও প্রধানমন্ত্রীকে তথ্য দিচ্ছেন। সব রাজনৈতিক দলের সরকারেরই নির্বাচনকালে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগিতা গ্রহণের বিষয়টি কারও অজানা কিছু নয়। সাংগঠনিক প্রস্তুতির সঙ্গে সঙ্গে ভোটের রাজনীতিতে বাড়তি সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যেও বেপরোয়া মনে হচ্ছে শাসক দলকে। আওয়ামী লীগ ঐতিহ্যগতভাবে একটি অসাম্প্রদায়িক সংগঠন। সাম্প্রদায়িকতা মৌলবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে দলটি বিভিন্ন সময়ে উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছে। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা ভাসানী সভাপতি থাকাকালেই ‘আওয়ামী মুসলিম লীগের’ মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে দলটিকে অসাম্প্রদায়িক চরিত্র দেওয়া হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দলটি এ ব্যাপারে আরও স্বচ্ছতা অর্জন করে। এর মধ্যে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল বা রাজনীতিতে ধর্মের যথেচ্ছ ব্যবহারকারীদের সঙ্গে রাজনৈতিক লাভালাভের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ যে সম্পর্ক স্থাপন করেনি তা নয়, তবে দলের রাজনৈতিক স্বকীয়তা বিসর্জন দিয়ে কখনো তা করেনি। যা করেছে সাংগঠনিক দূরত্ব বজায় রেখে করেছে, প্রকাশ্য ‘মাখামাখি’ করেনি। ১৯৮৬ সালে এরশাদের পাতানো নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীও অংশ নিয়েছিল। এ ব্যাপারে এরশাদের জাতীয় পার্টি, আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের মধ্যে একটা বোঝাপড়া যে হয়েছিল মানুষ তা বুঝেছে। তবে প্রকাশ্যে কোনো চুক্তি, সমঝোতা হয়নি। বেগম জিয়ার প্রথম সরকারের আমলে ঐক্যবদ্ধ কোনো প্লাটফর্ম গড়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন না করলেও জামায়াত যুগপৎ কর্মসূচি দিয়ে আন্দোলনে ছিল। সম্পর্কে একটা দূরত্ব বজায় রেখেছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু ভোটের রাজনীতিতে ‘ধর্মের কার্ড’ যখন থেকে মূল্যবান হতে থাকে, আওয়ামী লীগের মধ্যেও পরিবর্তন আসতে শুরু করে। বিএনপি ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী দল বলে প্রকাশ্যেই দাবি করে এবং বলতে দ্বিধা নেই যে, মানুষ তা বিশ্বাসও করে। সেই সুবিধা ভোটের রাজনীতিতে তারা ভোগও করে। আবার ইসলামপন্থি দলসমূহের সঙ্গে বিএনপির ‘ঐক্যে-সখ্যে’ মানুষ বিস্মিত হয় না। তবে নীতি-আদর্শ, শহীদ জিয়াউর রহমানের অনুসৃত রাজনীতির ধারা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা— ইত্যাদি প্রশ্নে ইসলামভিত্তিক রাজনৈতিক দলসমূহ, বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে প্রায় ২০ বছরের দৃঢ় বন্ধন নিয়ে বিএনপির কঠোর সমালোচনাও আছে। বিএনপির এই অবস্থান দেশে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তির ভিত মজবুতকরণে অনেক সহায়ক হয়েছে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। এতে দেশের রাজনীতি যেমন ‘কর্দমাক্ত’ হয়েছে, তার চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিএনপি। ইসলামপন্থিদের ভোট বা সমর্থন আদায়ের জন্য বিএনপির কাগজপত্রে ‘ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী’ শব্দত্রয়ের সংযোজনই যথেষ্ট, জামায়াতের সঙ্গে সখ্যের প্রয়োজন ছিল না। বাংলাদেশের ইসলামপ্রিয় মুসলমানদের অধিকাংশই জামায়াতে ইসলামীকে পছন্দ করে না। যদি তাই হতো আওয়ামী লীগ, বিএনপি দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের ভোট ও সমর্থন পেত না। দুই দল মিলে প্রদত্ত ভোটের ৭০%-৭৫% পায়। এর মধ্যে অমুসলিম ভোট কত? বরং বিএনপি জামায়াতকে বুকে টেনে নিয়ে বুক থেকে হারিয়েছে অনেক মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অনুসারী, প্রগতিশীল ও গণতন্ত্রীর সমর্থন। তাছাড়া জামায়াত বিএনপিকে যা দিয়েছে, নিয়েছে তার চেয়ে বেশি— বিশ্লেষকদের ধারণা এমনই। সাম্প্রতিক কিছু বাস্তব ঘটনা এবং দলীয় আইনজীবী নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে পার্টি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে প্রদত্ত বক্তব্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে বিএনপি নতুন করে ভাবছে। বেগম জিয়ার বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়েছে যে, জামায়াত কখনো বিএনপির সঙ্গে মৈত্রী রক্ষায় বিশ্বস্ত ছিল না। বর্তমান ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে তারা সম্পর্ক গড়েছে, এখনো সম্পর্ক আছে। অর্থাৎ জামায়াত তার প্রয়োজনে ‘মিত্র’ পরিবর্তন করতে পারে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, জামায়াত সম্পর্কে বেগম খালেদা জিয়ার মূল্যায়ন যথার্থ। উপজেলা নির্বাচন, পৌরসভা নির্বাচন, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন এবং অতি সাম্প্রতিক কুমিল্লা সিটি নির্বাচনের খবরাখবর যারা রেখেছেন তারা জানেন, জামায়াত ২০ দলীয় জোটের সিদ্ধান্ত ভঙ্গ করেছে বহু জায়গায়। তাদের কারণে বিএনপির প্রার্থী হেরেছে বহু এলাকায়। তলে তলে আঁতাত করে সরকারি দলের চেয়ারম্যান প্রার্থীকে জিতিয়ে দিয়ে নিজেরা ভাইস চেয়ারম্যান পদ বাগিয়েছে বহু উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদে। কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে সমন্বয় কমিটির সভায় উপস্থিত হওয়ার অনুরোধ উপেক্ষা করেছে জামায়াত। সিটি নির্বাচনে ২০ দলীয় জোটের সমন্বয়ক সাবেক প্রতিমন্ত্রী রেদোয়ান আহমদ স্বয়ং এ অভিযোগ করেছেন। জামায়াত তো এমনই করবে। বিএনপি এখন ক্ষমতাহীন, শক্তিহীন। আত্মরক্ষায় তারা হিমশিম খাচ্ছে। জামায়াতকে সাহায্য করতে এখন তারা অক্ষম। এখন তাদের চাহিদাও ‘কঠিন’। মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম মন্থর করে দেওয়া, দলের কারারুদ্ধ নেতাদের রক্ষা করা ও মুক্ত করা, দলের আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ রক্ষা করা, সর্বোপরি দলকে রক্ষা করা। এসব কাজে বিএনপি এখন তাদের কাছে অপাঙেক্তয়। তাদের দরকার ক্ষমতাবান, শক্তিশালী মিত্র। বিএনপি নিষ্ঠুর এ বাস্তবতা উপলব্ধি করছে বলেই মনে হয়। তা না হলে বেগম জিয়া নিজের মুখে জামায়াত সম্পর্কে সমালোচনামুখর হতেন না। সামনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এটা জেনেও জামায়াত সম্পর্কে নেতিবাচক কথাগুলো বলেছেন তিনি। অর্থাৎ জামায়াত-বিযুক্তির ইঙ্গিতই দিলেন তিনি। ব্যাখ্যাটা এমন হতেই পারে যে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের দল-নিরপেক্ষ মুসলিম ভোটারদের (এই ভোটাররাই একজন প্রার্থী, একটি দলকে জিতিয়ে দিতে পারে) সমর্থন লাভের জন্য জামায়াত বা ইসলামপন্থি বা ইসলাম নিয়ে রাজনীতি করা দলগুলো এখন আর প্রাসঙ্গিক নয়। বিএনপির ইসলামমুখী ইমেজই এর জন্য যথেষ্ট। তাছাড়া আমাদের দেশের সব মুসলমানই ধর্মপ্রাণ, ধর্মানুরাগী কিন্তু ধর্মান্ধ ও উগ্র-ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক নয়।

বিএনপির মূল্যায়ন যখন এমন, তখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নিচ্ছে ‘ইউটার্ন’। তারা ইতিমধ্যে স্পষ্ট করে ফেলেছে যে, এতদিন দেশের বাম-প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তির যে অভিভাবকত্ব তারা করেছে, তা এখন ছেড়ে দিতে চাইছে অর্থাৎ এর আর কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই তাদের কাছে। ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনের আগে তারা একবার ‘খেলাফত মজলিশ’-এর সঙ্গে ৫ দফা চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিল ভোটের আশায়। পরে নানামুখী চাপে অবশ্য সে চুক্তি বাতিল করা হয়েছিল। অতিসম্প্রতি হেজাফতে ইসলামের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার পর ১৪ দলীয় ক্ষমতাসীন জোটে চঞ্চলতা লক্ষ করা যাচ্ছে। মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এ ব্যাপারে বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী এবং তার দলের নীতিনির্ধারকরা নিশ্চয়ই বোঝেন যে, স্পর্শকাতর এ ইস্যুতে জোটে ও জোট সরকারে সংকট দেখা দিতে পারে। তার মানে কি এই নয় যে, আগামী নির্বাচনে জেতার জন্য বাম-প্রগতিশীল গণতন্ত্রীদের চেয়ে তাদের কাছে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক সংগঠনের গুরুত্ব বেশি। আরও একটি বার্তাও এতে আছে যে, দেশের জনগণের ওপর ধর্মভিত্তিক বা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা সংগঠন ও শক্তিসমূহের প্রভাব বেড়েছে এবং ওইসব ভোটারের সমর্থন পাওয়ার জন্য হেফাজতে ইসলাম কেন, আরও কারও সঙ্গেও তাদের সম্পর্ক হতে পারে। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, এ ক্ষেত্রে সরকারের এমন একটা উদ্দেশ্য থাকতে পারে যে, শেষ পর্যন্ত জামায়াত যদি কোনো না কোনো ফর্মে বিএনপির সঙ্গে থেকে যায়, তাহলে হেফাজতকে দিয়ে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করিয়ে জামায়াতের পাল্টা আরেকটা বড় ইসলামভিত্তিক দল গড়া এবং সরকারের সঙ্গে রাখা। সত্য যে, আমাদের দেশে জামায়াতে ইসলামীই সর্ববৃহৎ ধর্মভিত্তিক দল। কওমি মাদ্রাসাকে ভিত্তি করে হেফাজত রাজনৈতিক দলে রূপান্তরিত হলে এটি হবে দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ ইসলামভিত্তিক দল। এটাও সত্য যে, তারা ভাবছে, হেফাজত এখনো সংগঠন হিসেবে তত বড় না হলেও তাদের দেশব্যাপী ‘ইমেজ’ জামায়াতের চেয়ে কম নয়, বলা চলে সমান্তরাল। নানা চাপ ও কৌশলে জামায়াতকেও যদি পক্ষে আনা যায়, নিদেনপক্ষে বিএনপি থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায়, তাহলে আগামী নির্বাচনে সরকারি দল বেশ সুবিধা পাবে বলে হয়তো ভাবা হচ্ছে। সরকারি দলের নীতিনির্ধারকরা এটা কি ভাবছেন যে, এটা যদি তাদের ভোট রাজনীতির নতুন রসায়ন হয়, তাহলে জনগণ কি ভাবতে পারে না, সরকার তার অতীত জনপ্রিয়তা হারিয়েছে, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে জনগণ থেকে।

১১ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে আমির মাওলানা শাহ আহমেদ শফির নেতৃত্বে হেফাজতে ইসলামের প্রতিনিধিদলের বঙ্গভবনে আতিথ্য গ্রহণ এবং তাদের কয়েকটি দাবির প্রতি প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি প্রদানের নানা মুখরোচক ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করছেন মন্ত্রী-মিনিস্টার এবং শাসক দলের নেতারা। সারা দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষামানের অধঃপতনের মুখে হঠাৎ তারা কওমি শিক্ষাব্যবস্থা এবং সেই মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতির ব্যাপারে যেন অস্থির হয়ে পড়েছেন? কওমি শিক্ষাব্যবস্থাকে কার্যকর, কর্মোপযোগী ও কালোপযোগী করার চেষ্টায় কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু মূল ধারার শিক্ষাব্যবস্থার যথাযথ উন্নয়নে উদ্যোগী না হয়ে শুধু কওমি শিক্ষার মান ও সনদ স্বীকৃতির ব্যাপারে গত ১৭-১৮ দিন ধরে মন্ত্রী-নেতাদের দিবানিশি পেরেশানির ‘শানে-নজুল’ মানুষ বোধহয় বুঝছে। সরকারি লোকজন যত বেশি এর পক্ষে বলবেন ততই তারা পয়েন্ট হারাবেন বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। যে বিপদের কথা সর্বত্র আলোচনা হচ্ছে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকার ও সরকারে দলের এই হেফাজতমুখিতা ও অতি কওমি শিক্ষাপ্রীতি দেশে সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী রাজনীতিকে উসকে দিতে পারে, যা বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উৎকর্ষতার এই কালে দেশের গণতন্ত্র, আইনের শাসন এবং রাষ্ট্র ও জনগণের অগ্রগতিতে বাধাগ্রস্ত করবে, পশ্চাত্মুখী করবে দেশকে।

আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে নির্বাচনী তত্পরতা শুরু করলেও মাঠে-ময়দানে নির্বাচনী উত্তাপ তেমন নেই। বিএনপিই তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। তারা সরবে আওয়ামী লীগের মতো নির্বাচন নিয়ে মাতামাতি না করলেও একেবারে বসে নেই। আওয়ামী লীগ যেভাবে সভা-সমাবেশ করতে পারছে, প্রধানমন্ত্রী এবং অন্য মন্ত্রীরা যেভাবে সরকারি-সুবিধা কাজে লাগাতে পারছেন, বিএনপি সেসব সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে না। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। মে দিবসের সমাবেশের অনুমতিও তাদের দেয়নি কর্তৃপক্ষ। উভয়পক্ষ সভা-সমাবেশ-মিছিল ইত্যাদি কর্মসূচি সমানতালে শুরু করলেই জমে উঠবে ভোটযুদ্ধ। এ জন্য ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিত করা জরুরি। একটি ইনক্লুসিভ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা সরকারপ্রধান বলছেন। মন্ত্রী, নেতারাও বলছেন বিএনপি নির্বাচনে আসবে। নির্বাচনমুখী দল বিএনপির নির্বাচনে অংশ নেওয়াই স্বাভাবিক। আশা করা যায় বিএনপি নির্বাচনে আসবে। তারা নির্বাচনকালীন ‘সহায়ক সরকারের’ যে দাবি করছে সে দাবি কোনো কঠিন দাবি নয়। এমন একটি পরিস্থিতিতে দশম সংসদ নির্বাচনের সময় প্রধানমন্ত্রী ‘সর্বদলীয় সরকারের’ অধীনে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য বিএনপির প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। সাড়া না দিয়ে বিএনপি ভুল করেছিল। বিরোধী দলে থাকলেও এমন বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ত না দলটি। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, যেহেতু প্রধানমন্ত্রী আগামী নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হোক চান না, তাই সর্বদলীয় না হলেও নির্বাচনকালীন একটি গ্রহণযোগ্য সরকারব্যবস্থার প্রস্তাব দেবেন যাতে বিএনপিও থাকতে পারে। তেমন অবস্থায় শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী রেখেই নির্বাচনে যেতে বিএনপি আপত্তি না-ও করতে পারে। সে রকম একটি ইঙ্গিত কিন্তু বিএনপি থেকে একবার দেওয়াও হয়েছিল।

বিএনপির সামনে এখন ৩০০ আসনে যোগ্য প্রার্থী ঠিক করাটা বড় কাজ। দলের স্থায়ী কমিটি থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে দলে অনেক অসন্তোষ তুষের আগুনের মতো জ্বলছে, নেতৃত্ব ও কমিটি বেচাকেনার পাইকাররা অনেক সমস্যা তৈরি করে রেখেছে, যোগ্য অনেকে যোগ্য স্থানে নেই, নমিনেশন বিক্রির মহাজনরাও ‘গোঁফে তেল’ দিচ্ছেন। সঠিকভাবে হ্যান্ডলিং করা না গেলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ও সহায়ক সরকার প্রশ্নে একটা রফা হয়ে গেলেও লক্ষ্য অর্জন করা বিএনপির জন্য কঠিন হবে। একটা শুভ লক্ষণ দেখা যাচ্ছে যে, বেগম খালেদা জিয়া দলকে পুনরেকত্রীকরণের একটা উদ্যোগ নিয়েছেন। দলের সংস্কারপন্থি তিনজনকে এলাকায় গিয়ে কাজ করতে বলা হয়েছে। সংস্কারপন্থিদের মধ্যে এবং দলের সঙ্গে এখন নেই তেমন ৬০-৭০ জন নেতা এখনো আছেন যারা বিএনপি থেকে নির্বাচন করলে আওয়ামী লীগ নেতাদের ঘুম হারাম হয়ে যাবে। কিন্তু প্রক্রিয়াটি এত ধীরগতিতে চলছে, মনে হয় দলের কোনো কুচক্রী মহল উদ্যোগটি নষ্ট করে দিয়ে সরকারকে সার্ভ করার চেষ্টা করছে। এমন যদি হয়, ইনক্লুসিভ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলেও বিএনপি গোলায় ফসল তুলতে পারবে না। নির্বাচনী প্রস্তুতির প্রাথমিক কাজ হিসেবে যে ৫১টি সাংগঠনিক কমিটি করা হয়েছে তারা দায়িত্ব পালন করছে কিনা, যার যার নির্ধারিত জেলায় যাচ্ছেন কিনা নাকি ঢাকায় বসে কাজ সারছেন তা দেখা এবং গিয়ে থাকলে বিদ্যমান সংকটের সমাধান না করে সংকট আরও বাড়িয়ে দিচ্ছেন কিনা তা দেখা দরকার।  আশা করা যায়, বিএনপি এবার আর ভুল করবে না; তারা নির্বাচনে যাবে।  একই সঙ্গে সরকারও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মতো ভুল করবে না; সমঝোতার মাধ্যমে বিএনপিকে নির্বাচনে রাখার শোভন পথ তারা উন্মুক্ত রাখবে।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর