সোমবার, ১ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

তুরস্ক কি উগ্রবাদী রাষ্ট্র হতে যাচ্ছে

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

তুরস্ক কি উগ্রবাদী রাষ্ট্র হতে যাচ্ছে

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এবং একেপি (জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি) দলের নেতা রিসেপ তায়েপ এরদোগান মুসলিম জগৎ তো বটেই, সারা বিশ্বের মধ্যে বর্তমান সময়ের সবচাইতে স্মার্ট রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। ২০০২ সাল থেকে তার দল ও তিনি গত ১৫ বছর একনাগাড়ে ক্ষমতায় রয়েছেন এবং সম্প্রতি সংবিধান সংশোধনীর এক গণভোটে জয়ী হয়ে ২০২৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার রাস্তা পাকাপোক্ত করেছেন। গত ১৬ এপ্রিল তুরস্কের গণভোটের মাধ্যমে সে দেশের সংবিধান যেভাবে সংশোধন হতে যাচ্ছে তাতে দেশের আইন সভা, বিচার ও নির্বাহী বিভাগের ওপর এককভাবে এরদোগানের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে এবং তিনি ২০২৯ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট থাকতে পারবেন। ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় আছেন এবং আরও ১৩ বছর নিশ্চিত, মোট ২৮ বছর তিনি ক্ষমতায় থাকবেন। এরদোগানের এহেন একনায়কতন্ত্রের দিকে ঊর্ধ্বারোহণ সম্পর্কে ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংকট্যাঙ্ক ‘দ্য মিডল ইস্ট’ ইনস্টিটিউটের তুরস্কবিষয়ক শাখার পরিচালক গোনুল টল মন্তব্য করেছেন, ‘বহু বছরের সাধনায় তায়েপ এরদোগান অবশেষে মনজিল মোকছেদে পৌঁছবার মহাসড়কে ওঠে গেলেন এবং সামনের লক্ষ্য পূরণে পাহাড়সম চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করার জন্যই তিনি নিজেকে বিশাল শক্তিশালী প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে নিলেন।’

গণভোটের দুই দিন আগে ১৪ এপ্রিল ওই একই থিংকট্যাঙ্কের আরেক পণ্ডিত রবার্ট পিয়ারসন একটা লম্বা প্রবন্ধ লিখেছেন। আগামীতে এরদোগান তুরস্ককে কোথায় নিতে চান সে সম্পর্কে পিয়ারসন বিস্তারিত বিশ্লেষণ করে কিছু গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। পিয়ারসনের মতো এরদোগান মনে করছেন পশ্চিমা গণতন্ত্রের তত্ত্ব অনুসারে রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে যেরকম বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয় তাতে একবিংশ শতাব্দীর জন্য প্রয়োজনীয় শক্তিশালী রাষ্ট্র তৈরি করা সম্ভব নয়। পিয়ারসন বলছেন, এতে স্পষ্ট হয় এরদোগান সব ক্ষমতা নিজে একহাতে কুক্ষিগত করবেন, যা মূলত মুসলিম ব্রাদারহুডের দর্শন এবং যে মত অনুসারে গণতন্ত্র ইসলামিক শাসন ব্যবস্থার পরিপন্থী। পিয়ারসনের শেষ মন্তব্য হচ্ছে, মিসরের ব্রাদারহুড নেতা মুহম্মদ মুরসির মতো তুরস্কের জন্য এরদোগান নতুন করে মুসলিম গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছেন।

লেখার এ পর্যায়ে প্রসঙ্গক্রমে মুসলিম ব্রাদারহুডের পরিচয়ের একটু সামান্য পুনরুল্লেখ প্রয়োজন। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে সৌদি আরব নিবাসী মাওলানা মুহম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব কট্টরপন্থি এক ইসলামিক মতাদর্শের প্রবর্তন করেন, যেটি  এখন ওয়াহাবিবাদ নামে পরিচিত। রাষ্ট্র পরিচালনায় এ কট্টরপন্থাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি ফতোয়া দিলেন রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য ধর্মকে ব্যবহার করা যাবে। এখান থেকে শুরু হয় রাজনৈতিক ইসলামের প্রবর্তন। ওয়াহাবিতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ১৯২৮ সালে হাসান বান্না নামের একজন ধর্মীয় পণ্ডিত মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুড প্রতিষ্ঠা করেন। ব্রাদারহুডের মূল পরিপত্রে বলা হয় এটা কোনো রাজনৈতিক দল নয়, এটা একটি প্যান ইসলামিক ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলন। তবে রাষ্ট্র পরিচালনায় এটির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের জন্য এ মতাদর্শে বিশ্বাসীরা পৃথিবীব্যাপী বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন নামে রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেছেন। যেমন মিসরের ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি, ইরাকে ইরাকি ইসলামিক পার্টি, জর্ডানে ইসলামিক অ্যাকশন পার্টি, বাহরাইনে আল মেন্বার ইসলামিক সোসাইটি, সুদানে ন্যাশনাল ইসলামিক ফ্রন্ট, ভারতীয় উপমহাদেশে জামায়াতে ইসলাম, ইন্দোনেশিয়ায় প্রোস্পারস জাস্টিস পার্টি (পিকেএস) ইত্যাদি।

১৯৯৯ সালে মুসলিম ব্রাদারহুড লন্ডনে আন্তর্জাতিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে। লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য তারা প্রকাশ্যে গণতন্ত্র এবং গোপনে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনীর দ্বারা নাশকতামূলক কার্যকলাপের কৌশল গ্রহণ করে। ২০১৩ সালে সর্বশেষ নিষিদ্ধ হওয়ার আগে ১৯৪৮, ১৯৫৪, ১৯৬৫ এবং ১৯৮১ সালে ব্রাদারহুড মিসরে নিষিদ্ধ হয়। জামাল আবদেল নাসের জীবিত থাকতে তারা মিসরে মাথা গোঁজার সুযোগ পায়নি। কিন্তু ১৯৭০ সালে নাসেরের মৃত্যুর পর আনোয়ার সাদাত রাজনৈতিক ব্লান্ডার করে বসেন। নাসেরের নীতি থেকে সরে আসেন এবং রাজনৈতিক ফ্রন্টে প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করার জন্য ভারসাম্য সৃষ্টির কৌশলে আনোয়ার সাদাত ব্রাদারহুডকে রাজনীতি করার অনুমতি দেন। তাদের কয়েক হাজার মিলিট্যান্ট বন্দীকে মুক্ত করে দেন। কিন্তু ভাগ্যের কী পরিহাস, ইসরায়েলের সঙ্গে ১৯৭৯ সালে ক্যাম্প ডেভিড শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর ব্রাদারহুডের ষড়যন্ত্র ও তাদের এক ছদ্মবেশী সদস্যের গুলিতে ১৯৮১ সালের ৬ অক্টোবর সাদাত নিহত হন। তারপর আবার নিষিদ্ধ হয় ব্রাদারহুড। কিন্তু সুকৌশলে ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় দেশের সর্বত্র তৃণমূল পর্যন্ত ধর্মীয় এবং সামাজিক সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করে। তার ফলে ২০১১ সালে আরব বসন্তের সুযোগে তারা নির্বাচনের মাধ্যমে ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির ব্যানারে মিসরের রাষ্ট্রক্ষমতায় চলে আসে। ব্রাদারহুডের শীর্ষ নেতা মুহম্মদ মুরসি মিসরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। কিন্তু সব কিছুতে তাড়াহুড়া করতে গিয়ে এবারও তাদের কপালে বিপর্যয় নেমে আসে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজের হাতে রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পদক্ষেপ নিতে গেলে মিসরের সেনাবাহিনী মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে। মুরসিসহ ব্রাদারহুডের কয়েক হাজার নেতা-কর্মী এখন কারাগারে। ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি নিষিদ্ধ। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আল আরাবীয়া ইনস্টিটিউট ফর স্টাডিস নামের থিংকট্যাঙ্কের গবেষক মুহম্মদ আবদুল কাদের ২০১৩ সালের ১৪ অক্টোবর একটি নিবন্ধ লিখেন। তাতে তিনি উল্লেখ করেন মিসরের মুরসি সরকারের পতনে অশ্রু ঝরেছে এরদোগানের এবং তিনি মিসরের ব্রাদারহুডের জন্য সম্ভাব্য সবকিছুই করেছেন।

মিসরের কয়েক হাজার ব্রাদারহুড নেতা-কর্মী তুরস্কে এসে আশ্রয় নেয় এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে। তাছাড়া এরদোগান নিজেও এক সময়ে তুরস্কের অন্যতম নেতা নেসমিটিন এরবাকনের (Necmittin Erbakan) অনুসারী ছিলেন, যিনি ১৯৬৯ সালে তুরস্কে মুসলিম ব্রাদারহুড প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু তখনো কামাল আতাতুর্কের আদর্শবাদীরা প্রবলভাবে শক্তিশালী থাকায় এরবাকন সুবিধা করতে পারেননি। ২০০২ সালে জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর এরদোগানেরই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তিনি হতে পারলেন না। কারণ, তুরস্কের আদালত তাকে এই মর্মে অযোগ্য ঘোষণা করেন যে, তিনি ১৯৯৪ সালে একবার স্বরচিত কট্টর উগ্র ধর্মবাদী কবিতা পাঠের মাধ্যমে ধর্মীয় উত্তেজনা ছড়িয়ে দেন। তাই সেবার প্রধানমন্ত্রী হন একই দলের আবদুল্লাহ গুল। ২০০৭ সালের ১৪ এপ্রিল আংকারায় প্রায় তিন লাখ জনতা সমবেত হয়ে এরদোগানের প্রেসিডেন্ট হওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। তাদের অভিযোগ ছিল, এরদোগান সুযোগ পেলে তুরস্কের সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাতিল করে দেবেন। একই বছর ২৯ এপ্রিল ইস্তাম্বুলে এবং ১৩ মে ইজমির শহরে লাখো জনতা সমবেত হয়ে একই অভিযোগ তোলেন এবং স্লোগান দেন এরদোগানের গোপন এজেন্ডায় রয়েছে ব্রাদারহুডের নীতি-আদর্শ তুরস্কে প্রতিষ্ঠিত করা।

ধর্ম ও রাজনীতিকে মিশিয়ে ফেলার অভিযোগে জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টিকে নিষিদ্ধের জন্য ২০০৮ সালে তুরস্কের সুপ্রিম কোর্টে মামলা হয়। কিন্তু অল্পের জন্য সেবার তারা বেঁচে যায়। আদালতের ফুল বেঞ্চের ১১ জন বিচারকের মধ্যে ৬ জন নিষিদ্ধের বিপক্ষে মত দেন।

তবে এবারের যাত্রায় এরদোগান চারদিকের আটঘাট বেঁধেই নেমেছেন বলে মনে হয়। দীর্ঘ ১৫ বছর একনাগাড়ে ক্ষমতায় থেকে নিজ দলের ক্ষমতার বিস্তৃতি তিনি কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত শক্তিশালী করেছেন। আইন সভার ৫৫০ সদস্যের মধ্যে তার দলের আছে ৩১৭ জন। ৩০টি মেট্রোপলিটান সিটির মধ্যে ১৮টি, ১৩৫১টি জেলা পর্যায়ের নগর সরকারের মধ্যে ৮০০টি, ১২৫১ জন প্রাদেশিক কাউন্সিলরের মধ্যে ৭৭০ জন বা পদ জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির দখলে আছে। দেশব্যাপী প্রায় ৯৩ লাখ হার্ডকোর সদস্য রয়েছে দলে, যারা রেজিমেন্টেড পদ্ধতিতে ক্যাডার হিসেবে দলের জন্য নিবেদিত। ধারণা করা হয় ২০১৬ সালের জুলাই মাসের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান ছিল এরদোগানের সাজানো নাটক এবং পরিকল্পিত ফাঁদ। যার মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনীসহ রাষ্ট্রের সব সেক্টরের প্রশাসন থেকে উদারপন্থি হিসেবে পরিচিত প্রায় দেড় লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করেন। দেশের মধ্য থেকে ৪৫ হাজার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে জেলে পুরেছেন। এ কথাও ঠিক, কট্টর ইসলামিক নীতি বাস্তবায়নের পথে এরদোগানের সামনে চ্যালেঞ্জও কম নয়। ১৬ এপ্রিল গণভোটে এরদোগানের সংবিধান সংশোধনীর পক্ষে ভোট পড়েছে শতকরা ৫১.৩ ভাগ আর বিপক্ষে পড়েছে ৪৮.৭ ভাগ। তবে দেশের ভিতর থেকে এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকগণ হ্যাঁ ভোটের পক্ষে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ তুলেছেন। অভিযোগকারীদের ধারণা জরুরি অবস্থা বহাল ও বিরোধীপক্ষের নেতা-কর্মীদের বিশাল অংশ জেলে না থাকলে হ্যাঁ পক্ষের জয়লাভ সম্ভব হতো না। তাতে বোঝা যায় দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অন্তত অর্ধেক এরদোগানের সংশোধনীর পক্ষে নেই। তাছাড়া গণভোটের পরেও ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানে থেকে যাবে। সেটি পরিবর্তন করা অত্যন্ত কঠিন কাজ হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে প্রবল বাধা আসবে। ১৬ এপ্রিলের গণভোটের ফল দেখে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রভাবশালী সদস্য জার্মানিসহ আরও কযেকটি দেশ ইতিমধ্যেই বলে দিয়েছে এর মধ্য দিয়ে তুরস্কের জন্য ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গেল। ভৌগোলিক অবস্থান, বিশাল আয়তন, ঐতিহাসিক লেগেসি এবং সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যার শতকরা ৯৮ ভাগ মুসলমান হওয়ায় বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে তুরস্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দেশ। তাই এরদোগানের ব্রাদারহুড কানেকশন এবং নিজ হাতে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করার কারণে উদারবাদী বুদ্ধিজীবী মহল ও থিংকট্যাঙ্ক থেকে শঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। ১৯২৩ সালে থেকে কামাল আতাতুর্কের পথ ধরেই তুরস্ক আধুনিক শিল্পোন্নত ও সমৃদ্ধিশালী দেশ হয়েছে। সে পথ ছেড়ে মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধতার পথে গেলে সেটা শুধু তুরস্ক নয়, ইউরোপসহ মুসলমানপ্রধান দেশগুলোর জন্যও সেটা হবে প্রচণ্ড অশুভ বার্তা।

লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

[email protected]

নিউ অরলিনস, ইউএসএ।

সর্বশেষ খবর