সোমবার, ৮ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

একেশ্বরবাদী রবীন্দ্রনাথ

সুমন পালিত

একেশ্বরবাদী রবীন্দ্রনাথ

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ। বাঙালির অহংকার হিসেবে ভাবা হয় এ কবিকে। কবিগুরুর ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। সংগীতজ্ঞদের মতে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের সুর মূর্ছনা দুনিয়ার যে কোনো দেশের জাতীয় সংগীতের চেয়ে হৃদয়স্পর্শী। রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত একমাত্র কবি, যার লেখা গান বাংলাদেশ ও ভারত দুটি দেশের জাতীয় সংগীতের মর্যাদা পেয়েছে। বাংলা ভাষার মর্যাদার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পর্ক অবিভাজ্য। তিনি আমাদের সাহিত্যের প্রথম কবি বা সাহিত্যিক যিনি বাংলা ভাষার মর্যাদাকে গৌরবের উচ্চশিখরে নিয়ে যেতে সক্ষম হন। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভের ঘটনা কবি হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে শুধু বিশ্ববরেণ্যদের দলেই নিয়ে যায়নি, বাংলা ভাষাকে দিয়েছে অনন্য মর্যাদা। ঔপনিবেশিক যুগে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির ঘটনা বিশ্ব সমাজকে জানিয়ে দেয় বাংলা ভাষার উৎকর্ষতার কথা।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম কলকাতার সুবিখ্যাত ঠাকুর পরিবারে। ওই সময় ঠাকুর পরিবার ছিল আভিজাত্যের দিক থেকে আকাশছোঁয়া মর্যাদার অধিকারী। কলকাতা, অবিভক্ত বাংলা তো বটেই অবিভক্ত ভারতের অন্যতম অভিজাত হিসেবে বিবেচিত হতো ঠাকুর পরিবার। এ পরিবারের সঙ্গে কলকাতার সম্পর্ক অবিভাজ্য হলেও ঠাকুরদের শেকড় ছিল আজকের বাংলাদেশে।

কয়েক পুরুষ ধরে কলকাতাবাসী হওয়ার পরও জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের সদস্যরা শেকড়ের টানে তাদের আদি নিবাস খুলনার ফুলতলার দক্ষিণডিহিতে এসেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তার বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর বিয়ে করেছেন দক্ষিণডিহিতে। সে অর্থে খুলনার ফুলতলার দক্ষিণডিহি যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্ব পুরুষদের নিবাস, তেমনি তার মাতুলালয় এবং শ্বশুরবাড়ি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্ব পুরুষদের বাসস্থান ছিল খুলনার রূপসা উপজেলার পিঠাভোগ গ্রামে। কবিগুরুর পূর্ব পুরুষ জগন্নাথ কুশারী ছিলেন এ গ্রামের অধিবাসী। তিনি বিয়ে করেন খুলনার ফুলতলা উপজেলার দক্ষিণডিহির শুকদেব রায় চৌধুরীর মেয়েকে। এ বিয়ে জগন্নাথ কুশারীকে সমাজচ্যুত করে। কারণ দক্ষিণডিহির ভূস্বামী শুকদেব রায় চৌধুরী ছিলেন পিরালী ব্রাহ্মণ। দক্ষিণ বাংলার হিন্দুদের মধ্যে এক সময় পিরালী সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব ছিল। পিরালীরা পূজা অর্চনা করলেও তারা ছিল পীর খানজাহান আলীর ভক্ত। যে কারণে সনাতন ধর্মের অনুসারীরা তাদের বাঁকা চোখে দেখত।

জগন্নাথ কুশারী পিরালী ব্রাহ্মণ শুকদেব রায় চৌধুরীর মেয়েকে বিয়ে করে বিপাকে পড়েন। পিঠাভোগে সমাজচ্যুত হয়ে বসবাস করা তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। সমাজচ্যুত হওয়ায় আত্মীয়স্বজনও তার সংস্পর্শ ত্যাগ করে। প্রতিনিয়তই তাদের বিরূপ আচরণের সম্মুখীন হতেন তিনি। প্রতিকূল অবস্থায় পড়ে তিনি পৈতৃক নিবাস ছেড়ে দক্ষিণডিহির শ্বশুরালয়ে আশ্রয় নেন। শ্বশুর শুকদেব রায় চৌধুরী মেয়ে ও জামাইকে দক্ষিণডিহির উত্তরপাড়া গ্রামটি উপহার দেন। সেখানেই বসত গাড়েন জগন্নাথ কুশারী। শুরু হয় পিরালী ব্রাহ্মণ হিসেবে তার নতুন জীবন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আদিপুরুষ জগন্নাথ কুশারী আমৃত্যু দক্ষিণডিহিতে বসবাস করেন। তার অধস্তন পঞ্চম পুরুষ পঞ্চানন কুশারী জ্ঞাতি কলহের শিকার হয়ে ভাগ্যান্বষণে কলকাতায় চলে যান। কলকাতার গোবিন্দপুরের আদি গঙ্গার পাড়ে এক জেলেপল্লীতে বসতি গাড়েন তিনি। ব্রাহ্মণ হওয়ায় পঞ্চানন কুশারী জেলেদের কাছে ছিলেন নমস্য ব্যক্তি। তারা তাকে শ্রদ্ধাভরে ঠাকুর মশাই ডাকত। এভাবেই হারিয়ে যায় তার কুশারী পদবি। কালক্রমে তিনি ঠাকুর নামেই পরিচিত হয়ে ওঠেন।

ব্যবসা সূত্রে পঞ্চানন কুশারী ও তার সন্তানরা সমৃদ্ধির মুখ দেখেন। তার পৌত্র নীলমনি ঠাকুর জোড়াসাঁকোতে ঠাকুরবাড়ির ভিত গাড়েন। যিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের পিতামহ। দ্বারকানাথ ঠাকুর ব্যবসাসূত্রে কলকাতার শীর্ষস্থানীয় ধনাঢ্য ব্যক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ইংরেজদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে আকাশছোঁয়া প্রভাব প্রতিপত্তিরও অধিকারী হন তিনি। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর বিয়ে করেন দক্ষিণডিহির পিরালী ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে দ্বিগম্বরী দেবীকে। তার পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও বিয়ে করেন একই গ্রামের মেয়ে সারদা দেবীকে। দেবেন্দ্রনাথ ও সারদা দেবীর পুত্র হলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ঠাকুর পরিবারের আরও অনেক সদস্য বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছেন দক্ষিণডিহির সঙ্গে। কবিগুরুর ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্বশুরবাড়িও দক্ষিণডিহি। তার স্ত্রী জ্ঞানদাননন্দিনী দক্ষিণডিহির সন্নিকটের নরেন্দ্রপুরের মেয়ে। তারও জন্ম পিরালী পরিবারে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিয়ে হয় দক্ষিণডিহির বেনীমাধব রায় চৌধুরীর মেয়ে ভবতারিণী দেবীর সঙ্গে। ঠাকুর পরিবারের ঐতিহ্য অনুসারে বিয়ের পর নববধূর নতুন নাম রাখা হয় মৃণালিনী দেবী।

রবীন্দ্রনাথের পূর্ব পুরুষদের নিবাস যেহেতু খুলনার ফুলতলার দক্ষিণডিহি কিংবা রূপসার পিঠাভোগ, সেহেতু তার সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের আত্মার সম্পর্ক স্পষ্ট। কবিগুরুর মাতুলালয় ও শ্বশুরবাড়ি সূত্রেও এ দেশের মাটি ও মানুষের সঙ্গে তার নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তার পুত্রদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন জমিদারি দেখার জন্য। শিলাইদহ, পতিসর, শাহজাদপুরের জমিদারি দেখতে রবীন্দ্রনাথ প্রায়ই আসতেন কলকাতা থেকে তৎকালীন পূর্ববঙ্গে— অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশে। বজরায় চড়ে পদ্মা নদীতে দিনের পর দিন ভ্রমণ করেছেন কবি। তার অনেক সুবিখ্যাত কবিতা রচিত হয়েছে শিলাইদহ, পতিসর, শাহজাদপুরের কুঠিবাড়িতে। বজরায় বসে লেখা কবিতার সংখ্যাও কম নয়।

আগেই বলেছি বাঙালির অহংকার বলে ভাবা হয় কবিগুরুকে। তবে রবীন্দ্রনাথ বাঙালিত্বের চেয়ে মনুষ্যসত্তাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তার কবিতায়ও তা স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে। কবিগুরু লিখেছেন— ‘সাড়ে সাত কোটি বাঙালির হে মুগ্ধ জননী/রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ধার্মিক ছিলেন। ছিলেন ঈশ্বরপ্রেমী। তার অসংখ্য কবিতা ও সংগীতে ঈশ্বরপ্রেমের ছবি পরস্ফুিটিত। তবে এ ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে। তার মানবিকসত্তা কখনো ধার্মিকসত্তার কাছে জিম্মি হয়নি। রবীন্দ্রনাথের ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে লিখতে গিয়ে মনে পড়ছে লালন সাঁইয়ের সেই বাউল গানটির কথা। মানব ধর্মের প্রতি গভীর আস্থাশীল লালন সাঁই নিজের জাতপাত সম্পর্কে লোকজনের জিজ্ঞাসার জবাব দিয়েছেন গানের মাধ্যমে। গানটি হলো— ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে/সুন্নত দিলে হয় মুসলমান/নারী জাতির কি হয় বিধান/ আবার বামন যিনি পৈতায় প্রমাণ/ বামনী চিনি কি ধরে?’

লালন জাতপাতে বিশ্বাসী ছিলেন না। এমনকি তার ধর্ম বিশ্বাসও সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ ছিল না। নিজের জাতপাত সম্পর্কে লালন ভক্তদের হেঁয়ালীর মধ্যে রাখতে চেয়েছেন। তিনি সবাইকে যে সত্যের দিকে দিকনির্দেশ করেছেন, তা হলো— মানুষের প্রধান পরিচয় সে একই আদমের সন্তান। সে পরিচয়ের কাছে জাতপাত বা ধর্মীয় পরিচয় নিতান্তই গৌণ।

রবীন্দ্রনাথের পূর্ব পুরুষরা ছিলেন পিরালী ব্রাহ্মণ। এ কারণে তাদের রক্ষণশীল ব্রাহ্মণদের নিগৃহের শিকার হতে হয়েছে। সমাজচ্যুৎ হতে হয়েছে। এ ক্ষোভই ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় ঠাকুর পরিবার। রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখের নেতৃত্বে একেশ্বরবাদী ব্রাহ্মধর্মের প্রতিষ্ঠায় ঠাকুর পরিবারের মহর্ষি দেবেন্দ্র নাথ ঠাকুরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। রবীন্দ্রনাথ নিজেও ছিলেন এই একেশ্বরবাদী ধর্মের অনুসারী। তবে ধর্মীয় পরিচয়ের চেয়ে তিনি মানবিক সত্তাকে সব সময় অগ্রাধিকার দিয়েছেন। বাঙালিকে মানুষ হয়ে ওঠার জন্য তিনি যে তাগিদ দিয়েছেন তা প্রাতঃস্মরণীয়।

লেখক : সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর