বৃহস্পতিবার, ১১ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

মা মাটি মানুষ ও মানবতা

অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত

মা মাটি মানুষ ও মানবতা

বেশ অনেক দিন আগে একটি প্রবাদ শুনেছিলাম— ‘যদি তুমি শিশুকাল সুন্দরভাবে কাটাতে চাও, তাহলে সোভিয়েত ইউনিয়নে জন্ম নাও, যৌবন কাটাতে চাও, তবে ফ্রান্সে বেরিয়ে যাও, তোমার বার্ধক্য আনন্দময় করতে হলে ভারতবর্ষে থেকে যাও।’ এখন সেই সোভিয়েত নেই, ফরাসির কথা আমি বিস্তারিত বিশ্লেষণ করতে পারব না, সৌভাগ্য হয়নি সেখানে একদিনও থাকার। ভারতবর্ষ কি এখনো ওই সুবচন প্রবাদের মতো আছে? বিভিন্ন স্বতন্ত্র, লক্ষ, বহু বিশ্বাস, অসংখ্য রীতিনীতি নানা ভাষাভাষী, স্বাধীন এবং বহুবিধ কৃষ্টি ও দৃষ্টিভঙ্গির বহুত্বের সমন্বয়ে, ভারতবর্ষ একটি অত্যন্ত বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ। আর এ বিশাল ভারতবর্ষ, তার ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং রাজনীতির সবকিছুরই গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো বঙ্গ। এই বঙ্গের ব্যাপকতা ও বিস্তৃতি একেক শাসন আমলে একেক রকম ছিল। কখনো বিহার, উড়িষ্যা বাংলা নিয়ে। কখনো শুধু বঙ্গ নিয়ে। তবে প্রকৃত বঙ্গ কি শুধু বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গ? ভাষা, বচন, যুক্তি, তর্ক, উপস্থাপনা এসব নিয়ে কথা বলতে গেলে বাংলাদেশই প্রকৃত বঙ্গ। এই ভারত বর্ষই পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যেখানে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-খ্রিস্টান-জৈন-পার্সি-শিখসহ অন্যান্য ক্ষুদ্র ধর্ম বিশ্বাসী উপাসকের সমন্বয়ে গঠিত। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এত ধর্মের সংমিশ্রণ নেই। সুগভীর ধর্মীয় বিশ্বাস এবং গভীর শ্রদ্ধা ও ভক্তির সঙ্গে এই ধর্মগুলোর লালন-পালন পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে নেই। দুর্ভাগ্য হলো এই ধর্ম পালন করতে গিয়ে ধর্মকে নিজের, পরিবারের, গ্রাম্য সমাজের এমনকি দেশের ধর্মীয় রীতিনীতির মধ্যে না রেখে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়েছে, তাই ধর্মের মৌলিক কাঠামোতে পরিবর্তন এসে গেছে। বরং এখন আমরা ধর্মকে একটা ক্ষুদ্র খুপরিতে আটকিয়ে রাখতে গিয়ে তাকে সঠিক স্থানে জায়গা দিতে ব্যর্থ হয়েছি।

আমরা প্রাগ ঐতিহাসিক দিন থেকে মা, মানুষ ও মানবতাকে বিভিন্নভাবে ধ্বংস করেছি। পুরুষরা শাসনের নামে কত যে দুঃস্বপ্নের জন্ম দিয়েছি, কত সমাজ এবং সভ্যতাকে ধ্বংস করেছি— তা শুধু ইতিহাসবিদরাই জানেন। হিন্দুশাস্ত্রে শ্রী কৃষ্ণের উপদেশ, ধর্মযোদ্ধা অর্জুনের প্রতি, আদৌ ভেবো না কর্মফলের কথা, এগিয়ে যাও, এগিয়ে যাও। এলিয়ট ব্যাখ্যা করেন, ও বিদায়ের কল্যাণ বাণী নয়, হে যাত্রীদল, শুধু এগিয়ে যাওয়ারই পালা। মহাভারত কিন্তু যুক্তিসঙ্গতভাবে উপস্থিত দুটি পক্ষের বিতর্কে পরম্পরাক্রম দুটি বিরোধী মতকেই যথেষ্ট সহানুভূতি ও যত্নের সঙ্গে উপস্থাপিত করে। প্রকৃতপক্ষে, লড়াই ও বিরাট ধ্বংসলীলার পর যে ভয়াবহ জনশূন্যতা মহাভারতের শেষ দিকে, বিশেষত গঙ্গা উপত্যকা এলাকাটিকে গ্রাস করেছিল, তাকে তো যুদ্ধের প্রাক্কালে অর্জুনের সুগভীর দ্বিধার যথার্থতা হিসেবেও দেখা যেতে পারে। অর্জুন যে বিপরীত যুক্তিটি দিয়েছিলেন, সেটি বাস্তবিকই ক্ষতি হয়নি—তা ভগবদ্-গীতার ‘বার্তা’টির যে অর্থই করা হোক না কেন। শুধুই এগিয়ে যাওয়ার দিকে নয় কল্যাণের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পক্ষে একটি শক্তিশালী কারণ আছে। নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. অমর্ত্য সেনের ‘তর্কপ্রিয় ভারতীয়’ বই থেকে ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চরম ‘গণ-বিধ্বংসী অস্ত্র’ নির্মাণকারী আমেরিকান দলটির নেতা ছিলেন জে. রবার্ট ওপেনহাইমার। ১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই মানুষের তৈরি প্রথম নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণের অভিভূতকারী শক্তির প্রকাশ দেখতে দেখতে তিনি আবৃত্তি করে ওঠেন কৃষ্ণরই বলা কথাগুলো— ‘আমিই মৃত্যু হয়ে এসেছি; আমিই পৃথিবীর নাশকর্তা।’ একজন ক্ষত্রিয়ের কর্তব্য হিসেবে অর্জুন একটি ন্যায্য দাবির পক্ষে যুদ্ধ করার যে উপদেশ পেয়েছিলেন, পদার্থবিজ্ঞানী ওপেনহাইমারের পক্ষেও বোমা বানানোর সমর্থনে সেরকম একটি যুক্তি ছিল। যুদ্ধে যে পক্ষটি স্পষ্টতই ন্যায্যতার জন্য বোমা বানানোর প্রযুক্তিগত দায়বদ্ধতাই সেই যুক্তি। পরে তার নিজের কাজের পুনর্বিবেচনা এবং সমালোচনা করে ওপেনহাইমার বলেন, ‘যখন কোনো কিছুকে প্রযুক্তিগতভাবে সম্ভাবনাপূর্ণ বলে দেখা হয় তখন সেই কাজটিতে এগিয়ে যাওয়া হয় এবং প্রায়োগিক সাফল্য লাভ করার পরেই সেটিকে নিয়ে কী করা হবে সে সম্পর্কে যুক্তি দেওয়া হয়।’ এগিয়ে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও অর্জুনের দুশ্চিন্তাটিকে নিয়ে ভাবার কারণ ছিল— ‘বিপুলসংখ্যক মানুষকে হত্যা করে কীভাবে শুভ আসতে পারে? এবং অমি আমার নিজের পক্ষের জন্য জয়, রাজত্ব ও সুখ কেন কামনা করব?’ সাম্প্রতিক পৃথিবীতেও এ যুক্তিগুলো পুরোপুরি প্রাসঙ্গিক। কারও চোখে যখন কোনো কিছু কর্তব্য হিসেবে বিবেচিত হয়, তখন সেই কাজটি করার পক্ষে যুক্তিটিও নিশ্চয়ই খুবই জোরালো হবে। কিন্তু আমরা যাকে কর্তব্য বলে মনে করছি সেটি করার ফলে যে পরিণামের জন্ম হয় তার প্রতি আমরা কীভাবে উদাসীন থাকতে পারি? সন্ত্রাস, যুদ্ধ ও হিংসা থেকে শুরু করে মহামারী পর্যন্ত নানা মূর্ত সমস্যায় পরিপূর্ণ আমাদের পৃথিবী।

ভারতের বিশেষ সমস্যা হিসেবে আছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, পারমাণবিক সংঘাত বা আঞ্চলিক শান্তির মতো বিষয়। এরকম ক্ষেত্রে কৃষ্ণের কর্তব্য সম্পাদনের যুক্তির সঙ্গে সঙ্গে অর্জুনের পরিণামবিষয়ক বিশ্লেষণটিকেও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। গীতা মহাভারতের এক ক্ষুদ্র অংশ মাত্র; মহাভারতের সেই সুপ্রশস্ত তার্কিক প্রজ্ঞার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে ত্রিমাত্রিক ‘গীতার বার্তা’টিকে। এ উপমহাদেশে বিতর্ক ও বিরোধিতা করার ঐতিহ্যটি কি ভারতীয় জনসমষ্টির একটা বিশেষ অংশের মধ্যেই, অর্থাৎ সমাজের ‘এলিট’ অংশের পুরুষদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল? যদিও মা তথা নারীদের তর্ক-বিতর্কে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হতো না, তবুও পুরুষ জমিদার, রাজা ও শাসকদের তারা বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করতেন। কোনো সন্দেহ নেই যে, ভারতে যুুক্তি-তার্কিক ক্ষেত্রটিতে মোটামুটিভাবে পুরুষরাই মধ্যমণি হিসেবে থেকেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও মননচর্চা উভয় ক্ষেত্রেই নারীদের অংশগ্রহণ মোটেই নগণ্য ছিল না।

আজকের দিনে, বিশেষ করে রাজনীতির ক্ষেত্রে এটা খুবই স্পষ্টভাবে দেখা যায়। বস্তুত বর্তমানে অনেক জাতীয় ও আঞ্চলিক দলেরই নেতৃত্বে আছেন মহিলারা। অতীতেও তারা নেতৃত্ব দিয়েছেন। এমনকি কংগ্রেস দলের নেতৃত্বে ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ পদে যত মহিলা ছিলেন, তাদের সংখ্যা রাশিয়া ও চীনের বিপ্লবী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী মহিলাদের যোগফলের চেয়ে বেশি। এটাও বোধ হয় লক্ষণীয় যে, সরোজিনী নাইডু ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম নির্বাচিত মহিলা সভানেত্রী হন, ১৯২৫ সালে। ব্রিটেনের কোনো প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বারা একজন মহিলা সভানেত্রী হওয়ার (১৯৭৫ সালে মার্গারেট থ্যাচার) ৫০ বছর আগে। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের দ্বিতীয় মহিলা প্রধান নির্বাচিত হন নেলী সেনগুপ্ত ১৯৩৩ সালে। তাও ব্রিটিশ মহিলাদের ৩৪ বছর আগে। এবার আসি বাংলাদেশের কথায়। যে দেশটি শুধু পুরুষরা সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন বললে ভুল হবে। পুরুষদের তুলনায় মেয়েদের ভূমিকা কম ছিল না। জাতির জনকের তুলনায়, বঙ্গমাতার ভূমিকাকে কিছুতেই খাটো করে দেখা যায় না। তিনি ছিলেন সব কিছুতেই একটা প্রেরণা, একটি ধৈর্য ও এক মহাশক্তি। ১৯৭৫ এর পরে স্বৈরশাসনের শাসনগুলোতে, ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য স্বৈরশাসকগণ তাদের নৈতিকতা বিবর্জিত আচার-আচরণ, কালাকানুন করতেই শুধু দ্বিধাবোধ করেননি, বরং পৃথিবীতে আসা সর্বশেষ ধর্ম ইসলামকে, যেখানে নারীর মর্যাদা ছিল অত্যন্ত সম্মানজনক, সেটাও ধূলিসাৎ করা হয়েছে। এমনকি দেশের প্রধানমন্ত্রী কোনো নারী হতে পারেন না এমন অনেক ফতোয়াও তারা দিয়েছিলেন, তাদের গুরুরা তারপর নতজানু হয়ে নারী নেত্রীর পদপানে অবস্থান নিয়েছিলেন।

আজকের বাংলাদেশ পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় নারীর ভূমিকায় অগ্রগণ্য। তার পেছনের কারণ কী? অর্থাৎ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হৃদয় দিয়ে যা উপলব্ধি করেন, সেটা হলো— অর্থ সব অনর্থের মূল। যার জন্য ধানমন্ডির এই ঐতিহাসিক বাড়ি তিনি ইতিহাসকে ধরে রাখার জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছেন। ধনের মোহ নয়, কর্ম এবং সেবার মোহই এখন তার কাছে মহান ব্রত হিসেবে কাজ করছে। ‘যে ধন আমাকে অমরত্ব দিতে পারে না, তা দিয়ে আমি কী করব?’ ধন নয়, কর্মই যে কোনো মানুষের অমরত্ব দিতে পারে।  কর্মের মাধ্যমেই সম্ভব সৃষ্টিশীল কিছু করার, যা বেঁচে থাকবে এবং বাঁচিয়ে রাখবে। আর সব কর্মের প্রেরণাই মা, মাটি, মানুষ এবং মানবতা। আমরা যাকে মূল্যবান মনে করে অর্জন করতে চাই তার সঙ্গে প্রাচুর্যের একটা যোগসূত্র আছে ঠিকই, কিন্তু এ যোগাযোগটি খুব ঘনিষ্ঠ হতেও পারে, নাও হতে পারে।  আমরা যদি দীর্ঘায়ু হওয়ার ও ভালোভাবে বাঁচার স্বাধীনতা নিয়ে ভাবী তাহলে আমাদের দৃষ্টিকে সরাসরি জীবন ও মৃত্যুর ওপর কেন্দ্রীভূত করতে হবে;  শুধু ধনসম্পদ ও আর্থিক প্রাচুর্যের ওপর নয়।

লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব

মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর