বৃহস্পতিবার, ১১ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

পানির হিস্যা নিয়ে মিস ব্যানার্জির নিষ্ঠুর তামাশা

তুষার কণা খোন্দকার

পানির হিস্যা নিয়ে মিস ব্যানার্জির নিষ্ঠুর তামাশা

লোকমুখে চালু প্রবাদ প্রবচনে আমি এতকাল খুব বিশ্বাস করতাম। জানতাম, হাজার বছর ধরে মানুষের জীবনের অভিজ্ঞতা লোকমুখে প্রবাদ প্রবচনে রূপ নিয়েছে। প্রবাদ প্রবচনের শিকড় মানুষের অভিজ্ঞতার গভীরে বলে ওগুলোকে আমি বিনা প্রশ্নে মেনে চলেছি, কখনো হেলা করার দুঃসাহস দেখাইনি। কিন্তু ইদানীং প্রবাদ প্রবচনের সত্যতা নিয়ে আমার মনে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। একটা প্রচলিত প্রবচনের অসারতা থেকে আমার মনে সন্দেহের জন্ম। এতকাল শুনে আসছি, ‘মুখুটি কুটিল বড় - বন্দ্যোঘটি সাদা, তার মাঝে বসে আছে চট্ট...’ শেষের শব্দটি লিখলাম না। চট্টোপাধ্যায়রা ওটি শুনলে আহত হতে পারেন। চট্ট প্রসঙ্গ উহ্য রেখে প্রবাদটার মানে ভেঙে বললে সবাই কথাগুলো সহজে বুঝতে পারবেন। মুখুটি মানে মুখোপাধ্যায় যার আধুনিক সংস্করণ মুখার্জি। প্রবাদে উনাদের কুটিল ঘরানার মানুষ বলা হয়েছে। বন্দ্যোঘটি মানে বন্দ্যোপাধ্যায় যারা ব্রাহ্মণের আরেক শাখা। বন্দ্যোপাধ্যায়রা আজকের দিনে ব্যানার্জি। যেমন বাংলাদেশের নিকট প্রতিবেশী ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মিস মমতা ব্যানার্জি। প্রবাদের কথা সত্য বলে মানলে বাঁড়ুজ্জেদের মেয়ে মিস মমতাকে সাদা মনের মানুষ বলে মানতে হবে। কারণ তেনারা বন্দ্যোঘটি। কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি, বাংলাদেশের মানুষ মিস মমতা ব্যানার্জিকে কোনোক্রমেই সাদা মনের মানুষ বলে মানতে রাজি হবে না। কারণ পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যসভায় মমতা ব্যানার্জি গদিনসীন হওয়ার পরে আমাদের পানির কষ্ট বড্ড বেড়ে গেছে। সিপিআইএম যখন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য শাসনের দায়িত্বে ছিল তখন তারা শুকনা মৌসুমে আমাদের অভিন্ন নদীর পানির ন্যায়সঙ্গত হিস্যা দিয়েছে সেটা বলা যাবে না। তবে বাংলাদেশকে পানির ন্যায্য ভাগ দেওয়া না দেওয়া নিয়ে তারা এত নিষ্ঠুর বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ করেনি। মিস ব্যানার্জি প্রকাশ্যে জানিয়ে দিয়েছেন তিনি আমাদের একফোঁটা পানি দেবেন না। এ পর্যন্ত বলে মিস ব্যানার্জি থেমে থাকেননি। আমাদের পানি না দেওয়ার পক্ষে যুক্তি সাজানোর মতলবে তিনি পশ্চিম দিনাজপুর ভ্রমণ করতে এসে বললেন, আমরা নাকি আত্রাই নদীতে বাঁধ দিয়ে সব পানি ছেঁকে নিচ্ছি। কাজেই তিনি বাংলাদেশের কাছে পানির ন্যায্য হিসসা দাবি করলেন। পশ্চিম দিনাজপুরের জনসভার মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভারতকে পানি না দেওয়ার ব্যাপারে মিস ব্যানার্জি বাংলাদেশকে যে ভাষায় আক্রমণ করলেন সেটা শুনলে যে কেউ ভাববে বাংলাদেশ বুঝি উজানের দেশ। ভারতের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীগুলোর ওপর বাংলাদেশের পুরো নিয়ন্ত্রণ। আসল সত্য সবাই জানে। সাগরঘেঁষা নিচু জমিনের বাংলাদেশে নদী আসে সাগরের সঙ্গে মেশার জন্য। নদীগুলোর উৎস ভারতের কোন কন্দরে সেটাও আমরা সঠিক বলতে পারব না। তবুও পশ্চিমবঙ্গের মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী মিস মমতা ব্যানার্জির অভিযোগ শুনে ঈশপের গল্প মনে পড়ল। গল্পটা আমরা সবাই জানি, তবুও আরেকবার বলছি কারণ তিস্তা নদীর পানি বণ্টন প্রশ্নে বাংলাদেশের সঙ্গে মিস ব্যানার্জির সাম্প্রতিক আচরণ আমাদের হতাশায় ফেলে দিয়েছে। এমন হতাশার মধ্যে শুনছি বাংলাদেশ আত্রাই নদীর পানি আটকে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গকে শুকিয়ে মারছে। মিস ব্যানার্জির ভয়ঙ্কর অভিযোগের সঙ্গে ঈশপের গল্পের দারুণ মিল দেখে ওটি আরেকবার বলার লোভ সামলাতে পারছি না। এক প্রবল পরাক্রমশালী জাঁদরেল বাঘ পাহাড় থেকে পায়ে পায়ে নেমে এসে ঝরনার কিনারে দাঁড়িয়ে দেখে কচি নধর এক মেষ শাবক ঝরনার ভাটিতে পানি খাচ্ছে। নধর মেষ শাবককে দেখে ওটি চিবিয়ে খাওয়ার লোভে বাঘের জিহ্বা লকলকিয়ে উঠল। মনের কথা মনে চেপে বাঘ হুঙ্কার ছেড়ে বলল, তুই আমার পানি ঘোলা করছিস কেন? জবাবে মেষ শাবক বলল, আমি দাঁড়িয়ে আছি ভাটিতে। আপনি শার্দুল মহাশয় অনেকখানি উজানে দাঁড়িয়ে আছেন। অত উজানের পানি আমি ঘোলা করব কীভাবে? মেষ শাবকের সোজা সাপটা জবাবে বাঘের ক্ষুধা মিটল না বরং মেষ শাবককে খাওয়ার জন্য সে আরও অনেকগুলো অজুহাত খুঁজে বের করেছিল যার সবগুলো আপনারা জানেন। সেই সঙ্গে মেষ শাবকের পরিণামও আমরা সবাই জানি। মমতা ব্যানার্জি ভালো করে জানেন তিনি অভিন্ন নদীর পানি নিষ্ঠুরভাবে একা গিলে ফেলছেন। তার নিষ্ঠুরতার কারণে বাংলাদেশের অনেক এলাকা শ্মশান হতে বসেছে। কিন্তু বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে বয়ে চলা অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্সা পাওয়ার অধিকার বাংলাদেশের মানুষের আছে এ কথা মমতা ব্যানার্জি কানে তুলতেও নারাজ। মিস ব্যানার্জি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অনুরোধও তুড়ি মেরে হেলায় উড়িয়ে দিয়েছেন। উজানের দেশ ভারত অভিন্ন নদীর পানি বাঁধ দিয়ে আটকে রেখে একা ভোগ করবে আর আমরা ভাটিতে বাস করি বলে যুগের পর যুগ পানি বিনে শুকিয়ে মরব এটা হতে পারে না। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ পানি নিয়ে ভারতের নিষ্ঠুর আচরণ থেকে নিস্তার চায়।

তিস্তা নদীর উজানে গজালডোবায় বাঁধ দিয়ে ভারত তিস্তার সব পানি একা গিলে ফেলছে। হাজার হাজার বছর ধরে নদীর পানি উজান থেকে গড়িয়ে ভাটির দেশের শেষ সীমায় সাগরে গিয়ে মেশে এটা আমরা সাদা চোখে দেখে আসছি। নদীর উৎস থেকে পানি গড়িয়ে উজান ভাটির দুই জনপদকে ভিজিয়ে দিয়ে নদী সাগরে যাবে এটাই নদীর ধর্ম। নদীর গতিবিধি রাজনৈতিক সীমারেখার মুখাপেক্ষী নয়। হাজার বছর ধরে নদীগুলো উজান ভাটি দুই জনপদের মানুষের প্রয়োজন মিটিয়ে গিয়ে সাগরে পড়ছে। হঠাৎ করে উজানের জনপদের মানুষের পানির প্রয়োজন এমন কি বেড়ে গেল যার জন্য তারা আস্ত নদীটাকে আটকে দিয়ে ভাটির জনপদকে শ্মশান বানানোর মিশনে নেমে পড়ল? গজালডোবায় বাঁধ দিয়ে পানি আটকে দেওয়ার আগে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ কি পানি বিনে শুকিয়ে মরছিল? আসলে নদীর উজানে বাঁধ বানানোর মূলে মানুষের বেঁচে থাকার প্রয়োজন কতখানি আর কতখানি কুটিল রাজনীতি সেটি নিয়ে আমার মনে সব সময়ই সন্দেহ কাজ করে। নদী বিষয়ে যাদের জ্ঞান আছে তারা সত্য বলতে পারবেন কিন্তু আমার মতো সাধারণ মানুষ প্রকৃতির পাঠকেই সত্য বলে জানে। আমি অন্তর থেকে বিশ্বাস করি, দুর্বৃত্ত মানুষের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য প্রকৃতি নদীর জন্ম দেয়নি। উজান ভাটির বাছাবাছি না রেখে নদী তার দুই পাড়ের জীব এবং জড়ের অস্তিত্বের প্রয়োজন মেটাবে এটাই কি স্বাভাবিক নয়? কিন্তু মুশকিল হয়েছে উজানের দেশ ভারত নদীর ধর্ম উল্টে দিয়ে তাদের নিজেদের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ পুরো করতে ব্যস্ত। মমতা ব্যানার্জি বাংলাদেশকে পানি না দিয়ে শুকিয়ে মারবেন এ ধনুর্ভাঙা পন থেকে তার দেশের কেন্দ্রীয় সরকারও তাকে টলাতে পারছে না। আমরা বাংলাদেশের ভুক্তভোগীরা তার কাছে আর কি আশা করব। ভারতের হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপিকে আমি নীতিগত কারণে ভয়ানক অপছন্দ করি। কিন্তু মরুভূমিতে পথ হারানো মানুষ মরীচিকাকে সত্য ভাবে। বাংলাদেশকে পানির কষ্টে ভুগতে দেখে আমিও চোখে মরীচিকা দেখছি। ভাবছি, আহারে আগামী নির্বাচনে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এলে মোদি নিশ্চয়ই আমাদের নদীগুলোতে দুই চার কিউসেক পানি দেবে!       

বাংলাদেশের পানি না পাওয়ার দুঃখ নিয়ে মিস ব্যানার্জির দিনাজপুর ড্রামা আমাকে ভাবনায় ফেলে দিয়েছে। মে মাসের শুরুতে পশ্চিম দিনাজপুরে জনসভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে বাংলাদেশকে তিনি যেভাবে দোষারোপ করলেন সেটি সত্যি দুঃখজনক। সেদিনের জনসভায় তিনি বললেন, বাংলাদেশ আত্রাই নদীতে বাঁধ দিয়ে সব পানি আটকে দিয়েছে। আত্রাই নদীর ওপরে বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশ পশ্চিমবঙ্গের মানুষের জীবনে দুঃখ ডেকে এনেছে। আমি নিজে এ তথ্য শুনে সত্যি ভিরমি খেয়েছি। আমার শৈশবে দেখেছি পাবনায় একটা ছোট নদী আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যেত। ওটি আত্রাই নদীর এক অংশ বলে আমরা জানতাম। ছোট্ট নদীটাতে বর্ষায় পানি আসত আবার আশ্বিন আসার আগেই হয়ে যেত শুকনা খটখটে। আমরা শুনতাম, অনেক বছর আগে হঠাৎ করে আত্রাই নদী তার স্বাভাবিক গতি হারিয়ে ছত্রখান হয়ে তিন ঠিকানায় কোনোমতে টিকে আছে। আত্রাই নদীর তথ্য তালাশ করে দেখলাম ১৭৮৭ সালে নদীটি অমন ছত্রখান হয়ে বুড়িয়ে গেছে। আত্রাই নদীর খানিক আছে রাজশাহীতে। নদীর আরেক অংশ দিনাজপুরে। দিনাজপুরের আধমরা আত্রাই থেকে বাংলাদেশ নাকি পানি ছেঁকে তুলে নিয়ে মিস ব্যানার্জির দুঃখের কারণ ঘটিয়েছে। আমি আমার সরকারকে বলব বিষয়টি অবিলম্বে পরীক্ষা করে সত্যাসত্য নির্ণয় করুন। বাংলাদেশের কোনো বাঁধের কারণে ভারতের একজন মানুষও যদি কষ্ট পেয়ে থাকে তাহলে অবিলম্বে ঘটনার প্রতিকার করুন। কনফুসিয়াস বলেছেন, তুমি এমন কাজ কখনো কর না যেমন কাজ তোমার সঙ্গে অন্যে করলে তুমি তাতে দুঃখ পাও। ভারত গঙ্গার ওপরে ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে আমাদের পদ্মাকে শুকিয়ে মেরেছে। তিস্তার ওপরে গজালডোবা বাঁধ আমাদের চোখের পানির কারণ। এ দুটি বাঁধ বড় বলে আলোচনায় আসছে। ভারত ছোট বড় আরও অসংখ্য নদীর উজানে বাঁধ দিয়ে অনেক বছর ধরে আমাদের শুকিয়ে মারছে। কাজেই ভারত বাংলাদেশের মাঝখানে বয়ে যাওয়া অভিন্ন কোনো নদীর ছিটেফোঁটার উজান যদি বাংলাদেশের ভাগে পড়ে থাকে সেখানে অবশ্যই আমরা অন্যায় কিছু করব না। কারণ আমরা জানি পানি না পাওয়ার কষ্ট কি নিদারুণ। ভারত নদীর উজানে বাঁধ দিয়ে যে কষ্ট আমাদের দিচ্ছে আমরা সৎ মানুষ হিসেবে কখনো সেই কষ্ট ভারতকে দিতে পারি না। আমি আশা করি আত্রাই নদীর বাঁধ বিষয়ে বাংলাদেশ অবিলম্বে ভারতের সঙ্গে আলোচনা করবে এবং সমস্যার ন্যায়সঙ্গত সমাধান নিশ্চিত করবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলাদেশ ভারতকে আত্রাই নদীর পানির ন্যায্য হিসসা বুঝিয়ে দেওয়া মাত্র ভারত গঙ্গা এবং তিস্তাসহ সব নদীর পানির ন্যায্য হিসসা বাংলাদেশকে বুঝিয়ে দিতে আর কোনো অজুহাত খুঁজবে না।

লেখক : কথাসাহিত্যিক।

সর্বশেষ খবর