শুক্রবার, ১৯ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

বিনয়ী নামাজির নম্র জীবন

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

বিনয়ী নামাজির নম্র জীবন

‘কদ আফলাহাল মুমিনুন। আল্লাজিনাহুম ফি সালাতিহিম খাশিউন। অর্থ, জান্নাতি মুমিন তারা, যারা খুশুখুজুর সঙ্গে নামাজ আদায় করে।’ (সূরা মুমিনুন : ১-২)। একজন মুমিনের পয়লা কাজ হলো নামাজ। সে নামাজ ওঠাবসার নামাজ নয়, হতে হবে খুশুখুজুর নামাজ। খুশুখুজুর সহজ মানে হলো বিনয়-নম্রতা। ধীরস্থিরতা।  খুশুখুজুর আরেকটি অর্থ মুফাসিসররা বলেছেন, সুকুনস সালাত তথা প্রশান্তির নামাজ। যার নামাজে বিনয়-নম্রতা, ধীরস্থিরতা প্রকাশ পায় না, যে নামাজ মুসল্লির অন্তরে প্রশান্তির ঝর্ণাধারা প্রবাহিত করে না, আপনি বিশ্বাস করতে পারেন তার নামাজ তাকে জান্নাত পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবে না। আরেকটি কথা অনায়াসেই বলা যায়, সে নামাজ নিজেকে তো নয়ই, কোনো মানুষকেও প্রভাবিত করে না— তা কোরআনে বর্ণিত মুমিনের সালাত নয়। আরেকটু খুলে বলি। কখনো কখনো কারও নামাজের ধীরস্থিরতা দেখে আমাদের চোখ আটকে যায়। মন ভরে যায়। নিজের প্রতি ধিক্কার চলে আসে অজান্তেই। মন বলে এমন নামাজই তো পড়া দরকার। এই যে তার নামাজ আমাকে প্রভাবিত করল, ভাবিয়ে তুলল- এটাই খুশুখুজুর নামাজ। যদি না ওই নামাজির মনে লোক দেখানোর উদ্দেশ্য থাকে।

আমরা নামাজ পড়ি। সে নামাজে না আছে বিনয়, না আছে স্থিরতাধীরতা, আবার না অন্যকে প্রভাবিত করার মতো নূরানিয়াত। সে নামাজ পড়েই আমাদের মনে কত বাহাদুরি। আহারে! নবীজী বলেছেন, ‘নামাজ আমার ব্যথার মলম। শত কষ্ট-যন্ত্রণা ভুলে যাই আমি নামাজের জায়নামাজে দাঁড়ালে।’ শেরে খোদা হজরত আলীর পায়ে তীরবিদ্ধ হয়। তীর খোলার জন্য যখনই টান দেওয়া হয় যন্ত্রণায় ছটফট করে ওঠেন তিনি। পরে বলেন, বন্ধুরা! আমি নামাজে দাঁড়াই। তখন তোমরা আমার তীর খুলে নিও। নামাজরত আলীর পা থেকে হেঁচকা টানে তীর খুলে নেওয়া হয়, অথচ টেরই পেলেন না তিনি।’ সাহাবিরা যখন নামাজে দাঁড়াতেন তারা এত ধ্যানমগ্ন-তন্ময় হয়ে পড়তেন, বনের পাখি গাছ ভেবে তাদের মাথায়-কাঁধে এসে বসত। এসব হলো খুশুখুজু নামাজের কিছু বাস্তব উদাহরণ।

আমরা এখন যেভাবে নামাজ পড়ছি, তখনো কেউ কেউ সেভাবে নামাজ পড়ত। রসুল (সা.) ও সাহাবিরা স্পষ্ট বলে দিতেন, এ ব্যক্তির নামাজ কোরআনের নামাজ নয়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি মসজিদে নববীতে এসে নামাজে দাঁড়াল। নামাজে দাঁড়িয়েই দাড়ি টানছে। নড়াচড়া করছে। রসুল (সা.) দেখে বলেন, ‘লাও খাশিয়া কালবাহু, লা খাশিয়া জাওয়ারিহাহু। অর্থ, তার অন্তরে যদি আল্লাহর ভয় থাকত, তবে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেও তা প্রকাশ পেত।’ একবার সিরিয়ার জামে মসজিদে হজরত হুজায়ফা (রা.) আসরের নামাজ পড়ে বসে আছেন। এমন সময় এক ব্যক্তি এসে নামাজ পড়ল। তিনি ওই ব্যক্তিকে ডাক দিলেন। বললেন, ‘তোমার নামাজ হয়নি। তুমি আবার নামাজ পড়।’ ওই ব্যক্তি আবার নামাজ পড়ল। সাহাবি বললেন, ‘ভাই তুমি আবার নামাজ পড়। তোমার নামাজ হয়নি।’ এভাবে কয়েকবার করার পর সাহাবি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা! বলত তুমি কত দিন এরকম তাড়াহুড়ো করে নামাজ পড়ছ?’ ওই ব্যক্তি বলল, ‘চল্লিশ বছর তো হবেই।’ এবার সাহাবি বললেন, ‘শুনে রাখ! আমি আল্লাহর নবীর সাহাবি হুজায়ফা বলছি, এভাবে যদি সারা জীবনও তুমি নামাজ পড়, তবে রসুলুল্লাহ আমাদের যে নামাজ শিখিয়েছেন, কোরআন আমাদের যে নামাজ আদায় করতে বলেছেন, সে নামাজ তোমার আদায় হবে না।’ আরেকটি ঘটনা শুনুন। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘একবার আমরা রসুল (সা.)-এর সঙ্গে জোহরের নামাজ পড়লাম। নামাজ শেষ করেই রসুল (সা.) এক ব্যক্তিকে ডাকলেন। লক্ষ্য করে দেখি সে পেছনের কাতারে বসা। রসুল (সা.) বললেন, ‘হে আল্লাহর বান্দা! আল্লাহকে ভয় কর। সাবধান! তুমি কীভাবে নামাজ পড়ছ সেদিকে খেয়াল রেখ। যখন কেউ নামাজে দাঁড়ায় সে প্রভুর একান্ত সান্নিধ্যে চলে যায়। সুতরাং তার অবশ্য কর্তব্য প্রভুর সান্নিধ্যের সতর্কতা ও আদব বজায় রাখা।’ (ইবনে খুজাইমা)।

প্রিয় বন্ধু! এভাবে ওঠাবসার নামাজ, ঠুকঠাক রুকু সেজদা দেওয়ার নামাজে তো কোনো কল্যাণ হবেই না, বরং আরও বেশি ধ্বংস ও খোদার অভিশাপকে কাছে নিয়ে আসবে বান্দা। আল্লাহ বলেন, ‘ধ্বংস ওই সব নামাজির জন্য, যারা তাদের নামাজের ব্যাপারে বড়ই উদাসীন।’ (সূরা মাউন : ৪-৫) রসুল (সা.) বলেছেন, ‘সবচেয়ে বড় চোর হলো সে, যে নামাজে চুরি করে। নামাজে চুরি মানে হলো ঠিকমতো রুকু সেজদা না করা। নামাজের আরকান পালন না করা। নামাজের শিক্ষা সমাজে বাস্তবায়ন না করা।’ হে নামাজি মুমিন ভাই! আসুন আমরা কোরআনে বর্ণিত আত্মায় প্রশান্তিময় সালাত আদায় করি। নামাজকে আমাদের হৃদয়ের সঙ্গী বানাই।  আখেরাতে কঠিন আজাব থেকে মুক্ত থাকব এই নামাজ দিয়েই।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসিসরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

www.selimazadi.com

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর