রবিবার, ২১ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

দরকার চিকিৎসা নীতিমালা

অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত

দরকার চিকিৎসা নীতিমালা

সব সিস্টেম চালানোর জন্য, সব প্রতিষ্ঠান চালানোর জন্য, রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য এমন কি রাষ্ট্রের অন্তর্নিহিত কোনো প্রকল্প, কর্মসূচি, সবকিছুরই নীতিমালা প্রয়োজন। এই নীতিমালা চিকিৎসাশাস্ত্রে বহুদিন ধরে প্রচলিত আছে। বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার জন্য শুধু স্ব স্ব দেশীয় নীতিমালা নয়, আন্তর্জাতিক নীতিমালাও অনুসরণ করা হয়। যেমন— ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা, বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার, সর্প দংশন ইত্যাদি অসুখের জন্য চিকিৎসা পদ্ধতি প্রায় সর্বত্র একই রকম।  এমনকি, রোগের নাম দিয়ে ইন্টারনেটে সার্চ দিলে পুরো চিকিৎসা পদ্ধতি বেরিয়ে আসে, যা একজন সাধারণ নাগরিকও বুঝতে পারেন। আগে বলা হতো Cancer has got no answer, Cancer not only kills the patient, kills the family. অর্থাত্ ক্যান্সারের কোনো চিকিৎসা নেই, ক্যান্সার আক্রান্ত ব্যক্তি শুধু যে নিজে মারা যান তা নয়, তার পরিবারকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে যায় অর্থাত্ এত ব্যয়বহুল এই চিকিৎসা। কিন্তু আরোগ্যের আশা ছিল ক্ষীণ বা শূন্য। বর্তমানে অবশ্যই অনেক ধরনের ক্যান্সার চিকিৎসায় আরোগ্য পাওয়া যায় অর্থাত্ ন্যূনতম পাঁচ বছর বেঁচে থাকেন। আবার কিছু কিছু ক্যান্সার আছে বয়সের ওপর ভিত্তি করে বেঁচে থাকা কল্পনা করা যায় না।

‘হয়েছে যক্ষ্মা নেই রক্ষা’ এটা অতি প্রচলিত উক্তি ছিল এ সমাজে। অতীতে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে বহু রাষ্ট্রনায়ক, প্রথিতযশা কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী মৃত্যুবরণ করেছেন। যেমন— আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্টপত্নী এলিয়েনর রুজভেল্ট, সপ্তম প্রেসিডেন্ট এন্ড্রু জেকলন, অষ্টম প্রেসিডেন্টের স্ত্রী হান্নাহ ড্যান বুরেন, মিসেস নেহেরু, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহসহ অসংখ্য স্বনামধন্য ব্যক্তি। পৃথিবীতে একসময় যক্ষ্মা নিরাময় হতো। অর্থাত্ রোগী পূর্ণ আরোগ্য লাভ করতেন। আচমকা যক্ষ্মা এখন আবার অগ্নিমূর্তি ধারণ করে ফিরে আসছে। MDR T.B. অর্থাত্ বহু ওষুধের প্রতি প্রতিরোধকারী যক্ষ্মা জীবাণু এখন মানুষকে কাবু করে ফেলছে। টিউবারকুলার লিম্পএডিনোপ্যাথি এখন তারুণ্যের জন্য এক মহা হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তরুণ সমাজও তার সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে পারছে না। Mediastinum এ থাকা লিম্ফগ্রন্থিগুলো বড় হয়ে শ্বাসনালির ওপর চাপ সৃষ্টি করে শ্বাস নেওয়া বন্ধ করে দিয়ে অকালে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।

বলেছিলাম গাইডলাইন দরকার। এখনো গাইডলাইন তৈরি হচ্ছে না। কোন কোন অবস্থায় রোগী ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে ভর্তি হবেন| I.C.U রোগীদের চিকিৎসার গাইডলাইন আছে। কিন্তু কখন ভর্তি হবেন, সেটা আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক এবং রোগীর আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা বিবেচনায় রেখে কাকে ভর্তি করব সেই নীতিমালা। পৃথিবীর সব দেশে I.C.U নীতিমালা বিশদভাবে বর্ণিত আছে। চিকিৎসাবিদ্যার শল্য শাখার ধর্মগ্রন্থ খড়াব Love & Baily’s Surgical principle-এ এ ব্যাপারে একটি গাইডলাইন দেওয়া আছে। তাছাড়াও পৃথিবীর প্রায় বেশির ভাগ দেশেই এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন নিজস্ব আর্থ-সামাজিক অবস্থা, চিকিৎসা দক্ষতা এবং সুবিধা বিবেচনায় তৈরি হয়েছে। আমার মনে হচ্ছে আইসিইউ চিকিৎসা এখন একটা ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। এ ব্যবসা ঠেকানো না গেলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে যেমন বাংলাদেশের কিছু জনসংখ্যা প্রতিনিয়ত মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্তে বা নিম্নবিত্ত থেকে দারিদ্র্যসীমায় চলে যাচ্ছে, তেমনি আইসিইউ চিকিৎসাজনিত কারণেও মানুষ নিঃস্ব হয়ে চরম দারিদ্র্যসীমায় চলে যাচ্ছে।

গত ১৮ এপ্রিল ২০১৭ থিম্পুতে স্বাস্থ্য সচিবের সঙ্গে আমার আলাপ হচ্ছিল। ১০ বছরের একটি রোগীকে রাজধানীর একটা আইসিইউতে বৎসরাধিককাল চিকিৎসা নিতে হয়। ১ কোটি ১৮ লাখ টাকা বিলের বিপরীতে তারা ইতিমধ্যে ৭০ লাখ টাকা জমা করেছেন। কিন্তু বাকি টাকার কোনো সুরাহা হয়নি বা হচ্ছে না। সেক্ষেত্রে আমি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকেই শুধু দোষারোপ করছি না, রোগীর আত্মীয়স্বজনের সিদ্ধান্ত নিতে না পারাকেও দায়ী করছি। দ্বিতীয়টি হলো, আমাদের এক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বরিশাল মেডিকেল কলেজের নাক কান ও গলা রোগ বিশেষজ্ঞ। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের জন্য রাজধানীর একটি বেসরকারি ক্লিনিকে ভর্তি হয়ে, নাক কান গলা সমিতির আর্থিক সাহায্য ছাড়াও তার পরিবার সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে, কিন্তু আরোগ্য তো কল্পনাতীত, আলিঙ্গন করতে হয়েছে এক বেদনাবিধুর মৃত্যুকে। তার স্ত্রী ও মেডিকেল পড়ুয়া দুই কন্যার জন্য কিছু রেখে যাননি নয়, তাদের রাস্তায় বসিয়ে গেছেন। এরকম অনেক উদাহরণ বাংলাদেশের অনেক ভুক্তভোগী নাগরিকের সামনে আছে।

জরুরি ভিত্তিতে দরকার সুস্পষ্ট ভর্তি নীতিমালা। কেননা ICU এবং NICU চিকিৎসা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো অনেক মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারকে দারিদ্র্যসীমার নিচে ঠেলে দিচ্ছে। একটি Disabled বা specially abled Child কিংবা একজন Vegetative বয়স্ক লোককে দেখাশোনা পরিবার, সমাজ এবং জাতিকে মাথা উঁচু করে সুখী ব্যক্তি বা সুখী পরিবার এবং সমাজ হিসেবে বাঁচতে দিচ্ছে না। অচিরেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এ ব্যাপারে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন, একই সঙ্গে প্রয়োজন বিএমএ এবং বিএমডিসিকে এগিয়ে আসা, যাতে দক্ষ বিশেষজ্ঞদের দিয়ে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে সাহায্য করেন।

আমাদের দেশে এমনও নজির আছে ৮০ বছরের বৃদ্ধকেও ICU তে ভেন্টিলেশনে রেখে Heart-Lung preparation খেলা হয়। এমনকি ৯০ বছরের রোগীও আমি একটা দেখেছি ICU Ventilation এ। তবে এক্ষেত্রে শুধু ক্লিনিক দায়ী নয়, রোগীদের আত্মীয়স্বজনও কম দায়ী নন। কারণ মৃত্যুকে তারা সহজে মেনে নিতে পারেন না। অবশ্যই আপনজনকে কেউ সহজে হারাতে চায় না। আইসিইউ চিকিৎসা নিয়ে যেসব রোগী আরোগ্য লাভ করে তারা চিকিৎসা সাহায্য নিয়ে নিজেরা মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে ওঠে। একইভাবে Neonatal ICU (NICU)তে ভর্তি করানোর ব্যাপারেও একটা সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন দরকার। বাংলাদেশে NICU এর প্রথম এবং দক্ষ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক খালেদা বানু এবং বর্তমানে অধ্যাপক ডা. শহীদুল্লাহ, যার নেতৃত্বে এ বিষয়টি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এদের সবাইকে নিয়ে একটি গাইডলাইন তৈরি করা। যা বিকলাঙ্গ শিশু সৃষ্টি কমাতে বেশ ভূমিকা রাখতে পারে। এ ক্ষেত্রে শিশু মৃত্যু হ্রাস মুখ্য নয়। একইভাবে NICU অর্থাৎ নবজাতকদের আইসিইউতে কাকে রাখা হবে এ নীতিমালা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে নিউন্যাটোলজির অধ্যাপক শহীদ উল্লাহ এবং তার বিভাগ শিক্ষা দিচ্ছেন যে তা বাইরের কোনো প্রতিষ্ঠানে হুবহু মানা হয় কিনা। NICU এর শিশুদের সর্বাধুনিক চিকিৎসা দেওয়া না হলে, দেশে বিশেষ শিশুর (Disabled) সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে। এতে শিশু মৃত্যুর হার কমবে, বাড়বে রাষ্ট্রীয় বোঝা, পারিবারিক বোঝা।

বাংলাদেশে আইসিইউ চিকিৎসা ব্যয় অতীতের ক্যান্সার ও যক্ষ্মার চিকিৎসা ব্যয়কে ছাড়িয়ে গেছে। শুধু পারিবারিক টেনশন নয়, অর্থের অপচয় বা অর্থশোষণ, বিদেশি অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার, পারিবারিক বা রাষ্ট্রীয় অপচয়, সব মিলে এটা একটা ভয়াবহ রূপ লাভ করেছে। সব সন্তান চাইবেন তার মা-বাবাকে আইসিইউ কেন তার চেয়েও বেশি কিছু থাকলে সেখানে রেখে বাঁচিয়ে রাখতে। বাবা-মাও তার সন্তাকে বাঁচাতে চাইবেন, দীর্ঘদিনের জন্য যে কোনোভাবেই হোক।  আসলে জরুরি দরকার, রোগীর আত্মীয়স্বজনকে কাউন্সিলিং করা।  ভর্তি এবং চিকিৎসার গাইডলাইন তৈরি করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া। 

লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর