রবিবার, ২১ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

বোরোর নেকব্লাস্ট : ক্ষতি একেবারে কম নয়

শাইখ সিরাজ

বোরোর নেকব্লাস্ট : ক্ষতি একেবারে কম নয়

কৃষি আর কৃষকের মাঠ পরিস্থিতি জানতে মাঠে যাচ্ছি প্রতি সপ্তাহেই। দুই দিন আগে ফিরলাম দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় ঘুরে। ১৭ এপ্রিল ভোরে বেরিয়েছি প্রত্যন্ত জনপদের চিত্র ধারণ করতে, কৃষকের সঙ্গে কৃষি পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে। পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার ইসলামপুরে বিস্তীর্ণ এক পাকা ধানের খেত দেখে গাড়ি থেকে নামলাম। তখন ভোর সাড়ে ৬টার বেশি হবে না।  আকাশে কিছু মেঘ থাকায় খুব বেশি ঝাঁঝালো রোদ ওঠেনি। দূর থেকে সোনালি ধানের খেতটি দেখে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। কিন্তু কাছে এগিয়ে যেতেই একজন কৃষক এসে বললেন, ‘কিচ্ছু নাই ভাই! সব শ্যাষ হয়া গেছে। সব চিটা।’ তিনি কয়েকটি ধানের শীষ হাত দিয়ে ছিঁড়ে কচলাতে কচলাতে দেখালেন কিছুই নেই তার মধ্যে। বললেন, ‘৫ বিঘায় আবাদ করেছিলাম। ২ বিঘার বেশি নষ্ট হয়ে গেছে।’ মুহূর্তেই চিন্তাটি উল্টে গেল। লক্ষ্য করলাম খেতের পর খেত একই পরিস্থিতি। কোনো খেতের অবস্থাই স্বাভাবিক নয়। অধিকাংশ খেতই আশি ভাগ আক্রান্ত। আমি ওই কৃষকের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই একে একে অনেক কৃষক এগিয়ে আসতে থাকলেন। মুরব্বি গোছের কৃষক আবদুল হাকিম এবার আড়াই বিঘায় বোরো আবাদ করেন। তিনিও ধানের শীষ তুলে দেখালেন। জানালেন কোনো ধানই পাননি তিনি। কৃষকের বয়স সত্তরের মতো হবে। বললেন, এই রোগটি আগে কোনো দিন দেখেননি। ধানে যখন থোড় আসে তখন শীষগুলো সাদা হয়ে যায়। পরে তা চিটা হয়ে যায়। কৃষক আবদুস সবুর দেড় বিঘায় ব্রি ধান-২৮ করেন। তা পুরোপুরিই নষ্ট হয়ে গেছে। তিনি বললেন, আবহাওয়ার কারণে এই সমস্যা হতে পারে। রোগটির নামও তিনি জানেন না। বললেন, ‘শুনেছি রোগটির নাম ব্লাস্ট। এটি ছোঁয়াচে রোগ। এক খেতে হলে বাতাসে আরেক খেতে ছড়িয়ে পড়ে।’ ছোঁয়াচে বলেই তিনি এই রোগটিকে বললেন ‘ডায়রিয়া’। বললেন, ‘দেড় বিঘায় ১৬ হাজার টাকা খরচ করেছিলাম। ৪০ হাজার টাকা হয়তো পাওয়া যেত। সবই শেষ।’ ওই এলাকার অধিকাংশ কৃষকের নিজের জমি নেই। তারা জমি বর্গা নিয়ে আবাদ করে। আবাদের পুঁজিও এনজিওসহ বিভিন্নভাবে ধারকর্জ করে সংগ্রহ করে। কৃষক ইদ্রিস আলী বললেন, ‘৩ বিঘা লিজের জমিতে বোরো আবাদ করেছিলাম। ১০ কাঠা জমির ধান টিকেছে, বাকি সবই নষ্ট হয়ে গেছে।’ কৃষক নিজে ধানের শীষ ছিঁড়ে ছিঁড়ে আমাকে দেখাচ্ছিল। সেটি সত্যিই এক করুণ দৃশ্য। তরুণ কৃষক এনামুল ধান কাটছিল। জিজ্ঞাসা করলাম, সব ধানই তো চিটা কেটে কী করবে? জানাল, ‘কাটছি গরুর খাবারের আশায়।’ সবচেয়ে খারাপ লাগল একটি ধান খেতে এক মাঝবয়সী মহিলা ধান ছিঁড়ছিলেন আর কী যেন বলছিলেন দেখে। তার কাছে এগিয়ে গেলাম। বললেন, ‘এই খেতে আসলে মাথা আর ঠিক থাকে না। এই ১ বিঘা বর্গা জমি আবাদ করে এক ছেলে নিয়ে খাই। এবার কিছুই ধান পেলাম না।’ মহিলার নাম ফাতেমা বেগম। তার স্বামী নেই। উপার্জনের তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। ছেলেটি ১৪-১৫ বছর বয়সের। কিছু দূর লেখাপড়া করে এখন মায়ের সঙ্গে কৃষিকাজ করে। ঠিক এই ছোট পরিবারটির মতো অসংখ্য পরিবার রয়েছে গোটা উত্তরাঞ্চলে। বড় ও মাঝারি কৃষকের অর্ধেক বা সিকি ক্ষতি হলেও এদের ক্ষতি হয়েছে পুরোপুরি। বোরো ফসলের কিছুই পাবে না তারা। অবাক হলাম প্রায় ২০ জন কৃষকের সঙ্গে আমার আলোচনা হলো, এদের মধ্যে কারও কাছেই ধানের রোগটির ধারণা নেই। সবাই সমস্বরে বললেন, কৃষি বিভাগও তাদের মাঠে কখনো আসেনি। তারা এই রোগ ও সমস্যা নিয়ে কথা বলার মতো কাউকে পায়নি। বোদা উপজেলা পেরিয়ে পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলায় গেলাম। সেখানে চিলাহাটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শহীদুল ইসলামের সঙ্গে কথা হলো। তিনি বললেন, তার এলাকায়ও এবার ব্যাপক ফসলহানি ঘটেছে এই একইভাবে। বিষয়টি তিনি কৃষি বিভাগকে জানানোর পর তাকে কয়েকটি ওষুধ ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়। সেই কীটনাশক স্প্রে করার পরও ধানের ফলন রক্ষা করা যায়নি। বিষয়টি নিয়ে দেবীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার সঙ্গেও কথা বলেছি। তিনি একে তেমন সমস্যা হিসেবেই নিলেন না। বললেন, ‘বিক্ষিপ্তভাবে কোথাও কোথাও ব্লাস্ট দেখা যায়।’ তার হিসাবে তার উপজেলায় ক্ষতি হয়েছে মাত্র ১ শতাংশেরও কম ধানের। তার মানে ১১ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়। এর মধ্যে ব্লাস্ট আক্রান্ত হয়েছে আড়াই হেক্টরে। তবে রোগটি যে ব্লাস্ট এতে তার কোনো সন্দেহ নেই। তিনি বললেন, ‘নেকব্লাস্টের যে যে লক্ষণের কথা আমরা জানি সবই দেখা যায়। এটি হয়েছে আবহাওয়ার কারণে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবেই এভাবে ব্লাস্টের আক্রমণ হয়েছে।’ যা হোক, কৃষি বিভাগের সঙ্গে কথা বলে ব্লাস্ট সম্পর্কে বিস্তারিত বা মাঠ পর্যায়ের যে চিত্র পাওয়া যায় তার সঙ্গে মাঠের চিত্রের মিল খুব একটা পাওয়া যায় না। কৃষক যে বিস্তীর্ণ খেতের ক্ষতি দেখাল কৃষি বিভাগের হিসাবে তা একেবারেই সামান্য। এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরেও যোগাযোগ করেছি। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ব্লাস্টের কারণে কী পরিমাণ জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত বা এবার ফলন কতটা কমবে— এমন প্রশ্নের জবাব হিসেবে পেয়েছি সারা দেশে ২ হাজার ৬০০ হেক্টরের বোরো খেতে ব্লাস্ট আক্রান্তের কথা। সারা দেশের ৪৮ লাখ হেক্টর জমির বোরো আবাদের বিবেচনায় এই পরিমাণ অতি সামান্য। অবশ্য অধিদফতর সূত্র বলেছে, সারা দেশে ধান কাটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত সামগ্রিক ক্ষতির চিত্র জানানো সম্ভব নয়। তবে তারা জানিয়েছে, উত্তরাঞ্চলের সব জেলায়ই ধানে এবার নেকব্লাস্ট আক্রমণ করে। এ ছাড়া খুলনা, সাতক্ষীরা, যশোর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুরও রয়েছে।

উত্তরাঞ্চলে বোরো ধানে নেকব্লাস্টের আক্রমণের চিত্রটি জানার জন্য স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে পাওয়া তথ্যের সঙ্গে সরাসরি দ্বিমত পোষণ করে জানিয়েছেন, ব্লাস্ট আক্রান্ত জমির পরিমাণ আরও বেশি। গাইবান্ধার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানিয়েছে, জেলায় ১ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর বোরো আবাদি জমির মধ্যে ব্লাস্ট আক্রমণ করেছে মাত্র ৫ হেক্টরে। আমার সাংবাদিক সূত্রটি জানিয়েছেন, আক্রান্তের এই হার বোরো আবাদি জমির ১০ শতাংশের কম হবে না। রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানিয়েছে, জেলায় বোরো আবাদ হয় ১ লাখ ৩০ হাজার ৪০ হেক্টর জমিতে। ১৬ থেকে ২৫ এপ্রিল বোরো খেতে ব্লাস্টের আক্রমণ দেখা দেয়। আক্রান্ত হয় মাত্র ৩৬ দশমিক ১ হেক্টর জমি। আগাম কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ ও ধান কেটে ফেলার কারণে ক্ষতি এড়ানো সম্ভব হয়েছে। আমার সাংবাদিক সূত্র জানাচ্ছেন, ব্লাস্টের কারণে বহু কৃষক এবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কুড়িগ্রামের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাবে জেলায় ১ লাখ ১০ হাজার ৫০২ হেক্টর বোরো আবাদি এলাকার মধ্যে ব্লাস্ট আক্রান্ত হয় মাত্র ২৪ হেক্টরে। সাংবাদিক সূত্র বলেছেন, কুড়িগ্রামের ৭-৮টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সঙ্গে আলোচনা করে জানা গেছে, জেলায় কমপক্ষে ২ হাজার হেক্টর জমির ধান ব্লাস্টের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পঞ্চগড় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাবে ৩০ হাজার ৬০০ হেক্টরের বোরো আবাদি জমির মধ্যে ক্ষতি হয়েছে ১ শতাংশেরও কম। সাংবাদিক সূত্রের দাবি, ক্ষতি ৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। লালমনিরহাটে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য ৯১ হাজার ৮৮৫ হেক্টর বোরো আবাদি জমির মধ্যে ব্লাস্ট আক্রান্ত হয় ২ হাজার ৩০০ হেক্টর। এর মধ্যে পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১ হাজার ৬৬২ মেট্রিক টনের ধান। সাংবাদিক সূত্রের হিসাবে ক্ষতি হয়েছে আরও বেশি। যা হোক, কোনো বিতর্কের উদ্দেশ্যে এই তথ্য উপস্থাপন করিনি। পাশাপাশি এ কথাও ঠিক সংবাদিকদের পক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত আবাদি এলাকা, ফলনসহ উত্পাদন পরিস্থিতি নিজেদের উদ্যোগে মাপজোখ করার কোনো ব্যবস্থা নেই। তাদের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরেরই দ্বারস্থ হতে হয়। কখনো এ ধরনের বিপর্যয় এলে সরকার মনে করে সংবাদমাধ্যম বাড়িয়ে বলে। সংবাদমাধ্যম দৃশ্যত যে চিত্রটি দেয় তার সঙ্গে সরকারের দেওয়া ক্ষতির চিত্রের তফাত্ থাকে অনেকটাই। অমার অবস্থান থেকে বিনীতভাবে বলতে চাই, সবার দিক থেকেই সঠিক চিত্রটি উপস্থাপন করা জরুরি। আমিও বোদা ও দেবীগঞ্জের দৃশ্যত মিল খুঁজে পাইনি। জানি না, আমি বাড়িয়ে বলছি, কৃষক বাড়িয়ে বলছে, নাকি কৃষি বিভাগ কমিয়ে বলছে। তবে যেভাবেই হোক পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে হবে, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষককে কীভাবে সহায়তা করা যায় সে বিষয়টিও ভেবে বের করতে হবে। একই সঙ্গে দেশের খাদ্যের মজুদ পরিস্থিতি, খাদ্যশস্য আমদানি, ধান-চাল সংগ্রহ একটি স্বচ্ছ ও স্পষ্টতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেলে জনসাধারণও তার সঙ্গে থাকতে পারে।

প্রতি বছর দেখা যায় আমন মৌসুমের চাল বাজারে শেষ হতে হতেই বোরোর চাল আসতে থাকে, আর বোরো মৌসুমের ধান কাটা শুরু হয় হাওরাঞ্চলের জেলাগুলো থেকে। অর্থাত্ আমন মৌসুমের ধান শেষ হতে হতেই হাওরের ধান বাজারে আসে। একই সঙ্গে সারা দেশে বোরো কাটার ধুম পড়ে যায়। কিন্তু এবার হাওরে বিপর্যয়ের কারণে সেই চাল বাজারে আসতে পারেনি বলেই হঠাত্ করে সাধারণ চালের দাম বেড়ে ৪০-৪৫ টাকায় উঠে গেছে। এই সময়ে সরকার ৮ লাখ মেট্রিক টন চাল ও ৭ লাখ মেট্রিক টন ধান যথাক্রমে ৩৪ ও ২৪ টাকা কেজি দরে সংগ্রহের ঘোষণা দিয়েছে। বাজারে চালের মূল্য সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি হওয়ায় মিল মালিকরা সরকারের কাছে চাল বিক্রিতে আগ্রহী নয়। খাদ্যমন্ত্রী দেশের রাইস মিল এলাকাগুলো চষে বেড়াচ্ছেন খাদ্যশস্য সংগ্রহের জন্য, কিন্তু ফল তেমন হচ্ছে না। তবে যেভাবেই হোক পরিস্থিতি সামাল দিয়ে ওঠাই বড় চ্যালেঞ্জ। দুটি বিপর্যয়ে খাদ্যশস্যের যে ঘাটতি হয়েছে তা পূরণ করতে তাত্ক্ষণিক উদ্যোগ যেমন নিতে হবে, একইভাবে নিতে হবে দীর্ঘমেয়াদি কিছু উদ্যোগও। এ ক্ষেত্রে নেকব্লাস্ট ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার কারণটি সুনির্দিষ্ট ও বিজ্ঞানসম্মতভাবে সবিস্তারে বের করার জন্য গবেষক, সম্প্রসারণ সমন্বয়ে উচ্চ পর্যায়ের একটি বিশেষজ্ঞ দলের মাঠে নেমে যাওয়া প্রয়োজন। কারণটি কি জলবায়ুঘটিত না বীজজনিত, তা বের করতে হবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে ব্রি ধান-২৮-এর খেত ব্লাস্ট আক্রান্ত হয়েছে বেশি।  এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের নিতে হবে ত্বরিত ও যুগোপযোগী পদক্ষেপ; যাতে আগামী বছরের বোরো আবাদে কৃষককে কোনোরকম সংশয়ের মধ্যে না রাখে।  সেই সঙ্গে আগামী আমন মৌসুমে সারা দেশে কৃষকের জন্য বিশেষ প্রস্তুতি ও সুযোগ-সুবিধার উদ্যোগ নিতে হবে, যার মাধ্যমে সে বোরোর ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারে।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

     [email protected]

সর্বশেষ খবর