রবিবার, ২১ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা
প্রসঙ্গক্রমে

বন্ধ হোক এ অমানবিকতা

রেজাবুদ্দৌলা চৌধুরী

বন্ধ হোক এ অমানবিকতা

আমাদের এই দেশটির রাজনীতিতে সুদীর্ঘকালের গণতন্ত্রহীনতা বা ‘অন্তসারশূন্য গণতন্ত্রচর্চা’ যা-ই বলা হোক না কেন,  এখানে একটি সুশাসনের সমাজ গড়ে তোলার সব প্রচেষ্টাই ভেস্তে যেতে বসেছে।  ভেবে কূল পাই না সর্বব্যাপী এক মুক্তিযুদ্ধের বিশাল রক্ত-বন্যার আত্মত্যাগের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া একটি স্বাধীন-সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র কীভাবে এতটা অমানবিক এক বর্বর সমাজের জন্ম দিল! আমার নিজের রাজনৈতিক জীবন যে প্রায় সাড়ে চার-দশকের, তাতে যে সামান্য কাজ আমি করতে পেরেছিলাম তা তো এখন আমার কাছে নিতান্তই অর্থহীন মনে হয়। একা একা যখন ভাবি— এই দেশের জন্য এই দেশের মানুষের জন্য কিছু করার লক্ষ্য নিয়ে রাজনীতিতে এসেছিলাম, কেন এলাম এই রাজনীতিতে, কেন কিছু করতে পারলাম না, বেদনায় নীল হয়ে যাই, হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যায়। কেবল অর্থহীনতায় কাটালাম সারা জীবন!

এই সেদিন, খোদ রাজধানী-নগরী ঢাকার বুকের মধ্যে রামপুরার মতো জায়গায় সব মানুষের চোখের সামনে কথিত ‘সাইকেল-চুরি’-র অভিযোগে একটি কিশোরকে চরম নিষ্ঠুরতায় পিটিয়ে হত্যা করল কিছু ‘মানুষ’ নামের দানব, তা কতটা অমানবিক তা কি আমাদের নাগরিকদের মাঝে কোনো বোধ জাগাতে পেরেছে? না পারেনি। তা পারলে এই নিষ্ঠুর ঘটনাটিকে নিয়ে এতটুকু প্রতিবাদের ঝড় তো কোথাও দেখছি না। একটি কিশোর যদি আদৌ সাইকেল চুরি করেও থাকে তাহলে তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে হবে! থানা-পুলিশ বা সেখানকার আশপাশের মানুষ কেন সেই অসহায় কিশোরটিকে উদ্ধার করে, অন্ততপক্ষে থানা-পুলিশের হেফাজতে হস্তান্তর করতে পারল না? কিশোরটি কতগুলো বর্বর লোকের হাতে যখন পিটুনিতে মরণ-দশায়, সে বার বার আকুতি জানিয়েছিল— ‘আমি সাইকেল চুরি করিনি, যদি বিশ্বাস না করেন, আমার একটা হাত অথবা একটা পা বা চোখ দুটো নষ্ট করে দিয়ে হলেও আমার প্রাণ রক্ষার ব্যবস্থা করুন, আমাকে দয়া করুন, আমি চুরি করিনি ওই সাইকেল’। কিন্তু কেউ তার আকুল আবেদনে সাড়া দেয়নি, অসভ্য প্রাণীগুলো (‘মানুষ’ নামের অযোগ্য এরা) সবাই তামাশা দেখেছে, নিজেদের বিকারগ্রস্ত মনের প্রশান্তি খুঁজেছে বর্বরতার বিকারের মধ্যে। এই নৃশংস ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার পরে আমি তা মনে পড়লে রাতে ঘুমাতে পারি না। আমরাও তো ওর মতো কিশোর তারুণ্য পেরিয়ে এসেছি, আমাদের সন্তানেরাও তো ওই সময়টা পার করেছে। এরপর আর কল্পনাও করতে পারি না দৃশ্যটা— নিজের চেতনা হারানোর দশা হয়। আধুনিক সমাজের নাগরিক আমরা, বর্বরতায় আমরা কি জন্তু-জানোয়ারকেও হার মানিয়ে দেওয়ার পথে!

কেন এই নির্মমতা সমাজে? এই ১৭ কোটি মানুষের দেশে এখন অনেক বিত্তবৈভব বেড়েছে, বহুতল ভবন আর রাস্তাঘাট আর সেতু অবকাঠামো উন্নয়নের জোয়ারে দেশ ভাসছে, শিল্পকারখানা হচ্ছে প্রচুর, আধুনিক দামি দামি গাড়ির ভিড় সর্বত্র। সেসবের জৌলুস সবারই চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। উন্নয়নের কর্মধারা আমাদের মনের প্রশান্তি এনে দেয়, দেশের মানুষের উন্নত ভবিষ্যত্ নিশ্চিত ভেবে আমরা প্রবল আশাবাদী হই (যদিও গণতন্ত্রশূন্য এই সমাজে সবটাই ফাঁকা)। বিষয়টির গভীরে যাওয়া দরকার।

সাম্প্রতিককালের সিলেটের কিশোর রাজীব হত্যাসহ সারা দেশে বেশ কিছু কিশোর হত্যার ঘটনা ঘটেছে। বেশ কিছু শিশু-হত্যার পৈশাচিক ঘটনা ঘটেছে। প্রায়ই পত্র-পত্রিকায় খবর আসে (কখনোবা সচিত্র খবর)— দেশের কোনো কোনো জায়গায় ‘চুরির অভিযোগ’-এ শিশু-কিশোরদের গাছের সঙ্গে বেঁধে পটানো হচ্ছে। শিশু বা কিশোরের শরীরে যান্ত্রিকভাবে বায়ু ঢুকিয়ে হত্যা করার কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। এসব বর্বরতার বিরুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা দায়সারা ধরনের। আর রাজনৈতিক মহলে, সরকারি উঁচু মহলে একেবারেই তা তেমন কোনো সাড়া ফেলে না। সামান্য একটু হৈচৈ হলেও তা মিডিয়াতে একটু হয়, সব ঘটনা মিডিয়াও তেমনভাবে তুলে ধরে না, বা ধরার ফুরসত পায় না। দেশে হাজারো নৈরাজ্যময় ঘটনার চাপে মিডিয়া ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

দেশে গণতন্ত্র এখন একটি অন্তসারশূন্য দশায়। আমলারা যারা রাজনীতিকদের (মানে সরকার-পরিচালনাকারী রাজনীতিক) পরামর্শে প্রশাসনিক কাজকর্ম পরিচালনা করে তারা এখন নজিরবিহীনভাবে অকর্মণ্য, অদক্ষতার রোগে রুগ্ন, দুর্নীতিতে ডুবন্ত। তারা গণতন্ত্রহীনতার সুযোগ নিচ্ছে— তারা যখন বোঝে নির্বাচনবিহীন নির্বাচনে একটি সরকার গঠিত হয়েছে, তারা দেশ চালাচ্ছে, তখন তাদের পোয়াবারো— তাদের অদক্ষতা, আলস্য চরমে যেতে বাধ্য। আমলাগোষ্ঠী মানে আমি এখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আমলাদের কথাও বোঝাতে চাইছি। সাধারণ আমলা আর পুলিশ বাহিনীর আমলারা যারা সুশাসনের কাজটি করার দায়িত্ব প্রধানত পালন করবেন তাদের সবার মধ্যে এখন দায়িত্বশীলতার অভাব চরমে।  তা না হলে দেশে অপরাধপ্রবণতা, বিকারগ্রস্ত কিছু প্রাণীর এসব বর্বরতা এমন পর্যায়ে পৌঁছতে পারত না।

লেখক : বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর