মঙ্গলবার, ২৩ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

‘প্রাইমারি কালচার’ প্রতিষ্ঠায় স্থানীয় সরকারের ভূমিকা

মোশাররফ হোসেন মুসা

‘প্রাইমারি কালচার’ প্রতিষ্ঠায় স্থানীয় সরকারের ভূমিকা

ইংরেজি ‘কালটিভেশন’ থেকে ‘কালচার’ বা সংস্কৃতি শব্দের উৎপত্তি। বিভিন্ন মনীষীর মতে, উদ্ভিদের স্বচ্ছন্দে বেড়ে উঠতে চাষাবাদ যেমন প্রয়োজন, মানুষকে সৃজনশীল কাজে নিয়োজিত রাখতে তথা মানুষের মনে প্রেম-প্রীতি, মায়া-মমতা, সৌন্দর্য ও ঔদার্যবোধ জাগ্রত রাখতে সংস্কৃতিচর্চাও তেমন প্রয়োজন। উন্নত বিশ্বে সংস্কৃতির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়কে ‘প্রাইমারি কালচার’ নামে অভিহিত করা হয়। যেমন মিষ্টভাষী হওয়া, অনুচ্চ স্বরে কথা বলা, অন্যের বক্তব্য ধৈর্যসহকারে শোনা, অনুমতি নিয়ে কথা বলা, ভুল স্বীকার করা, অন্যকে মান্য করা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা ইত্যাদি। আমরা প্রাত্যহিক জীবনে ইচ্ছাকৃত কিংবা অনিচ্ছাকৃত কারণে সংস্কৃতির এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় অনুশীলন করি না। ফলে সামান্য অসতর্কতার কারণে মারাত্মক দুর্ঘটনা, সামান্য কটূক্তি থেকে মারামারি, তুচ্ছ ঘটনা থেকে তুলকালাম বেধে যাওয়ার ঘটনা প্রায়ই দেখতে পাওয়া যায়। তা ছাড়া প্রত্যেক মানুষের মনে নাগরিক বোধ জাগ্রত করতে ‘প্রাইমারি কালচার’ চর্চা করা অত্যন্ত জরুরি। জনগণ চারটি তৃণমূলীয় স্থানীয় ইউনিট তথা ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন ও ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের যে কোনো একটিতে বসবাস করে। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন, উপজেলা পরিষদ ও জেলা পরিষদ নিয়ে আলোচনা করলেও ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের কাজ নিয়ে তেমন আলোচনা করেন না। অথচ ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড এলাকায় সামরিক বাহিনীর সদস্যরা ছাড়াও তাদের স্ত্রী-সন্তান ও বেসামরিক লোকজনের বসবাস রয়েছে। সেখানে রয়েছে রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল-ক্লিনিক, দোকানপাট ও আবাদি জমি। নাগরিকত্ব সনদপত্র, জন্ম ও মৃত্যু সনদপত্র দেওয়ার ক্ষমতাও রয়েছে ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডগুলোর। সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদের এক সভায় সেনানিবাসে শৃঙ্খলা রক্ষার্থে ‘সেনানিবাস আইন-২০১৭’ নামে একটি খসড়া আইন চূড়ান্ত করা হয়েছে। বিগত ১৯২৪ সালের ‘ক্যান্টনমেন্ট অ্যাক্ট’ পুনর্বিন্যস্ত করে নতুন আইনটি তৈরি করা হচ্ছে। ৪৩টি বিষয়ে আর্থিক জরিমানার পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয়েছে, যা ৯০ বছর আগে খুবই কম ছিল। যেমন জনগণের দৃষ্টির সামনে খোলা অবস্থায় মাংস বহন; বিকলাঙ্গতা ও ব্যাধি অনাবৃত করে প্রদর্শন; মাতলামি, ভিক্ষাবৃত্তি, জুয়া খেললে, রাস্তাঘাটে মলমূত্র ত্যাগ করলে সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করার কথা বলা হয়েছে। আগে এ জরিমানার পরিমাণ ছিল মাত্র ১ (এক) টাকা। ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড এলাকায় ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করলে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা জরিমানা নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে, যা আগে ছিল ৫০ টাকা। তা ছাড়া বসতবাড়ি জরাজীর্ণ রাখলে এবং পশুকে আবর্জনা খাওয়ালে জরিমানার কথা বলা হয়েছে (বাংলাদেশ প্রতিদিন : ১৬ মে, ২০১৭)। এটি স্পষ্ট যে, আইনের কড়াকড়ি আরোপের কারণেই সেখানে সর্বত্র পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও শৃঙ্খলা পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু ইউরোপের দেশগুলোয় এ রকম ভিন্নতা দেখা যায় না। সেখানে একরূপ স্থানীয় সরকার কার্যকর থাকায় শক্তিশালী নাগরিক শ্রেণি গড়ে উঠেছে বহু আগেই। তবে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনগুলোয় যেসব বাধ্যতামূলক ও ঐচ্ছিক দায়িত্বাবলি দেওয়া আছে, সেসব বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে দেশের অন্য এলাকায়ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। উদাহরণস্বরূপ ইউনিয়ন পরিষদের ১০টি বাধ্যতামূলক ও ৩৮টি ঐচ্ছিক কার্যাবলি নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা যেতে পারে। বাধ্যতামূলক কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে : আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা, অপরাধ ও বিশৃঙ্খলা রোধে পদক্ষেপ নেওয়া, বৃক্ষ রোপণ করা, জনগণের সম্পত্তি রক্ষা করা, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। ঐচ্ছিক কার্যাবলির মধ্যে রয়েছে : জনগণ ও রাজপথ রক্ষণাবেক্ষণ, উদ্যান ও খেলার মাঠ রক্ষণাবেক্ষণ, পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করা, মৃত পশুর দেহ অপসারণ, পশু জবাই নিয়ন্ত্রণকরণ, বিপজ্জনক স্থাপনা নিয়ন্ত্রণকরণ, খাবার পানির দূষণ রোধে ব্যবস্থা গ্রহণ, আবাসিক এলাকায় চামড়া রং করা নিষিদ্ধকরণ, উৎসব পালন, খেলাধুলায় উন্নতি সাধন ইত্যাদি। অর্থাৎ জনগণকে দায়িত্বশীল নাগরিক শ্রেণিতে উন্নীত করতে যেসব দায়িত্ব পালনের প্রয়োজনীয়তা থাকে তার সবই রয়েছে ওই কার্যাবলির মধ্যে। পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনগুলোতেও অনুরূপ কার্যাবলির কথা বলা আছে। কিন্তু যথোপযুক্ত ক্ষমতা এবং প্রয়োজনীয় জনবল ও অর্থবল না থাকায় কাজগুলোর অধিকাংশই কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ রয়েছে।

সম্প্রতি স্থানীয় সরকার বিভাগের ইউনিয়ন পরিষদ গভর্ন্যান্স প্রজেক্ট (ইউপিজিপি) থেকে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের উত্তম চর্চা, উদ্ভাবন ও টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রস্তাব চাওয়া হয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগ ইচ্ছা করলে এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। স্থানীয় সরকারগুলোকে দেওয়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাজগুলো যেমন : ময়লা-আবর্জনা নির্দিষ্ট ডাস্টবিনে ফেলা, মৃত জীবদেহ মাটিতে পুঁতে ফেলা, নির্দিষ্ট স্থানে পশু জবাই করা, বিদ্যমান ল্যাট্রিনসমূহ পরিচ্ছন্ন রাখা, শব্দদূষণ রোধ করা, টাকার নোট পরিচ্ছন্ন রাখা, সরকারি সম্পদের ক্ষতিসাধন না করা, অন্য ধর্মাবলম্বীদের সম্মান করা, বৃক্ষের কাণ্ডে গজাল বিদ্ধ করে সাইনবোর্ড না দেওয়া, ফুটপাথ মুক্ত রাখা, মোটরসাইকেল চালানোর সময় হেলমেট ব্যবহার করা, রাস্তা পারাপারের সময় ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করা, গাড়ি চালানোর ও রাস্তা পারাপারের সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার না করা, প্রকাশ্যে ধূমপান না করা ইত্যাদি কাজকে প্রাইমারি কালচারের অন্তর্ভুক্ত করে ‘প্রাইমারি কালচার বাস্তবায়ন কর্মসূচি’ নাম দিয়ে একটি পৃথক প্রকল্প গ্রহণ করতে পারে।

 

লেখক : পরিচালক, প্রাইমারি কালচার ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (পিসিডিসি)।

ইমেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর