শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ২৫ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

বাংলাদেশে গণহত্যা : স্বীকৃতিতে বিলম্ব গ্রহণযোগ্য নয়

বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

বাংলাদেশে গণহত্যা : স্বীকৃতিতে বিলম্ব গ্রহণযোগ্য নয়

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন নািস বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত গণহত্যা বিশ্ব বিবেককে প্রকম্পিত করেছিল। তারই ধারাবাহিকতায় যুদ্ধ সমাপ্তির পরপরই জাতিসংঘ গঠিত হওয়ার পর বিভিন্ন মানবতা রক্ষাকারী সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যার মধ্যে রয়েছে ১৯৪৮ সালের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ এবং ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর গণহত্যাবিরোধী  প্রস্তাবনা, যা ১৯৬১ সালের ১২ জানুয়ারি কার্যকর হয়।

গণহত্যা কনভেনশনের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে গণহত্যার যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে তার আওতায় শুধু খুনই পড়ে না, মারাত্মক শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনও এর অন্তর্ভুক্ত। তবে খুন হোক বা মানসিক, বা দৈহিক ক্ষতিসাধন, যাই হোক না কেন, এটি সংঘটিত করতে হবে অন্য এক জনগোষ্ঠীর ওপর যারা জাতিগতভাবে (racially) বা গোষ্ঠীগতভাবে (ethnically) বা ধর্মীয়ভাবে, বা জাতীয়ভাবে (nationally), ভিন্ন।

শর্মিলা বসু নামের এক বিতর্কিত লেখিকা, যিনি নেতাজি সুভাষ বসুর ভাতিজি হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন, এ ধরনের উদ্ভট ইঙ্গিত দেওয়ার চেষ্টা করেছেন যে পাকিস্তানি মুসলমান বাঙালি মুসলমানদের খুন করে থাকলে তা গণহত্যা কনভেশনের সংজ্ঞাক্রমে গণহত্যার পর্যায়ভুক্ত হতে পারে না। তার কথায় মনে হচ্ছে তিনি নয় বোঝেন কিন্তু ছয় বোঝেন না। বাঙালি মুসলমান এবং পাকিস্তানি মুসলমানেরা যে এক বর্ণ (race) বা গোত্রভুক্ত (ethnic) নয় সেটা যদি মিস বসু অনুধাবন করতে না পেরে থাকেন তাহলে তার বুদ্ধিমত্তা এবং জ্ঞানের পরিধি নিশ্চয়ই প্রশ্নবিদ্ধ।

পাকিস্তানি এবং বাঙালি মুসলমানরা একই ধর্মের অনুসারী হলেও বর্ণ এবং গোত্রগতভাবে তাদের পার্থক্য স্বত্বঃসিদ্ধ। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই কম-বেশি মুসলমান ধর্মাবলম্বী লোক রয়েছেন, যেমন চীন, ইন্দোনেশিয়া, আলবেনিয়া, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ, প্রাক্তন সোভিয়েত অঙ্গসমূহ এবং এমনকি রাশিয়াতেও। কেউ কি বলতে পারবে চীনের মুসলমান আর সৌদি মুসলমান এক বর্ণ বা গোত্রভুক্ত?

পাকিস্তানি মুসলমান এবং বাঙালি মুসলমানদের আদি শিকড়, উৎস, বর্ণ এবং গোষ্ঠীগত বিবর্তন সম্পূর্ণ আলাদা। মাওলানা আজাদ, এবং এমনকি আইয়ুব খানও এ পার্থক্যের কথা স্পষ্ট করে বলেছেন। পাকিস্তানি মুসলমানদের, যাদের অনেকেরই পিতৃ পুরুষ ইরান, তুর্কিস্তান থেকে এসেছিলেন সুলতান এবং মোগল আমলে, গোত্রগত পরিচয় থেকে আলাদা হওয়ায়, গণহত্যা কনভেশনের সংজ্ঞায় পাকিস্তানিদের হাতে বাঙালি মুসলমানদের গণহারে খুন ধর্ষণ নিশ্চই গণহত্যার আওতায় আসে। আর হিন্দু খুনের বিষয়ে তো কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না। গণহত্যা কনভেনশন অনুযায়ী শুধু খুনই গণহত্যার পর্যায়ে পড়ে না, এতে আসে মারাত্মক দৈহিক এবং মানসিক ক্ষতিসাধনও। সুতরাং ’৭১ এ পাকি বাহিনীর ব্যাপক খুন, ধর্ষণই শুধু নয়, ভারতে চলে যাওয়া এক কোটি উদ্বাস্তু ও গণহত্যা কনভেনশনের সংজ্ঞাভুক্ত কেননা তারা পাকিদের নির্যাতনে মারাত্মক দৈহিক ও মানসিক ক্ষতির শিকার হয়েছেন।

উদ্বাস্তু এবং ধর্ষিতার সংখ্যা বাদ দিয়ে শুধু ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যা ধরলেও বাংলাদেশের গণহত্যা পৃথিবীতে নজিরবিহীন। সম্প্রতি দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ভারত-বাংলা মৈত্রি সম্মেলনে ভারতের একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক শ্রী হিরণ্ময় কার্লেকার অত্যন্ত সঠিকভাবেই বলেছেন যে, বাংলাদেশে ঘটানো গণহত্যা হিটলারের গণহত্যার চেয়ে ব্যাপক ছিল এই অর্থে যে, যেখানে ছয় বছরে ৬০ লাখ ইহুদি হত্যা করা হয়, সেখানে বাংলাদেশে ৯ মাসে হত্যা করা হয় ৩০ লাখ। ধর্ষিতা এবং উদ্বাস্তুর সংখ্যা ধরলে, কনভেনশনের সংজ্ঞায় যারাও অন্তর্ভুক্ত বাংলায় গণহত্যার সংখ্যা কমবেশি এক কোটি পঁয়ত্রিশ লাখ (গবেষক মুনতাসির মামুনের দাবি অনুযায়ী ৫ লাখ নারী ধর্ষিত হয়েছেন, যে দাবির সমর্থন অস্ট্রেলিয়ান ডাক্তার জেফরি ডেভিসসহ অন্যান্য গবেষকদের দেওয়া তথ্য থেকে পাওয়া যায়)।

টিক্কা খান নিজেই বলেছেন অপারেশন সার্চলাইটকালে যে গণহত্যা হয়েছে তা চেঙ্গিস খানের হত্যাকেও হার মানিয়েছে।

পাকিস্তানি লে. জেনারেল কামাল মইনুদ্দিন তার বইTragedy of Error এ বিভিন্ন জায়গায় লিখেছেন, (১) (বাংলাদেশে) যে হত্যাযজ্ঞ হয়েছে তার ফলে শকুনদের খাদ্যের সন্ধানে অন্যত্র যেতে হয়নি (২) ইয়াহিয়া বলেছিলেন পাকিস্তান রক্ষার জন্য কয়েক হাজার লাশ ফালানো কোনো ব্যাপার হবে না (৩) (বাংলাদেশে) হত্যাযজ্ঞ চালানোর জন্য বেলুচিস্তানের কসাই নামে পরিচিত টিক্কা খানকে পাঠানো হয় ১৯৭১ এর ৭ মার্চ। সে সময় মার্কিন দূতাবাস প্রধান আর্চার ব্লাড এবং তার সহকর্মীরা যে টেলিগ্রাম মার্কিন সরকারকে পাঠিয়েছিলেন তাতে গণহত্যা কথাটির স্পষ্ট উল্লেখ ছিল। সাংবাদিক সাইমন ড্রিং, পিটার হেজেলহার্স্ট, এন্থনি মেসকেরেনিয়াসসহ সব বিদেশি সাংবাদিকই গণহত্যার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। সিডনি ট্রিবিউনের ভাষ্য অনুযায়ী শুধু ২৫ মার্চ রাতেই কম-বেশি এক লাখ লোককে হত্যা করা হয়।

বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী তার পুস্তক ‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’তে লিখেছেন ২৭ মার্চ তিনি ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গেলে সেখানকার দক্ষিণ এশিয়া প্রধান মি. স্যান্ডারল্যান্ড বলেন, ঢাকাতে নিযুক্ত ব্রিটিশ উপরাষ্ট্রদূত ২৬ মার্চ এ কারণে রাস্তায় বের হয়ে এগোতে পারেননি যে রাস্তায় পড়েছিল লাশের ঢল।

প্রশ্ন হলো, এতবড় গণহত্যা কেন আজ অবধি বিশ্ব স্বীকৃতি পেল না।

প্রথমত বঙ্গবন্ধু হত্যার পর একটি বিরাট সময় দেশ শাসন করেছে পাকিস্তানি চররা। তারা কখনো চায়নি বাংলাদেশে গণহত্যা হয়েছে এ কথা প্রকাশ করতে। দ্বিতীয়ত যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ ছিল আমাদের মুক্তির বিরুদ্ধে, পাকিস্তানের পক্ষে। তারা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পাকিস্তানকে অপদস্ত করতে চায়নি। তবে সবচেয়ে বড় কারণ ছিল এই যে আমাদের নিজ দেশেই তো গণহত্যা দিবস ছিল না। বহু বছর পাকিপ্রেমী শাসন অবসানের পর মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল ক্ষমতায় আসে এবং তার কারণেই গত ২৫ মার্চকে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমাদের সংসদ গণহত্যা দিবস হিসেবে ঘোষণা করায়, আমাদের দেশে সংঘটিত গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পথ সুগম হয়েছে। এর পেছনে ৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির বহু বছরের দাবি বড় ভূমিকা রেখেছে।

প্রয়োজন এখন ব্যাপক আন্তর্জাতিক লবিং, কেননা এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদকে। সাধারণ  পরিষদ এরই মধ্যে রুয়ান্ডা, আরমানিয়ার গণহত্যাকে রেকর্ডে এনেছে। এ ব্যাপারে আমাদের শ্রেষ্ঠতম এবং ঘনিষ্ঠতম মিত্র, তথা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক শক্তি ভারত আমাদের প্রচেষ্টাকে সহায়তা দেবেন এটাই স্বাভাবিক, কেননা ভারত প্রথম থেকেই এই মর্মে দাবি করে আসছে যে পাকি দস্যুরা বাংলাদেশে ব্যাপক এবং নির্মম গণহত্যা ঘটিয়েছে। আমরা প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো থেকেও সমর্থন আশা করতে পারি। তারপরও আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে প্রচুর লবিং করতে হবে বিশ্বব্যাপী যাতে সাধারণ পরিষদ গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে এমন দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশকেও অন্তর্ভুক্ত করে। জাতিসংঘের তালিকায় যে সব দেশ রয়েছে বাংলাদেশের গণহত্যা তার চেয়ে অনেক অনেক ব্যাপক, লোমহর্ষ এবং নির্দয় অথচ এদেশটিই জাতিসংঘের তালিকায় নেই, সে তো হতে পারে না। উল্লেখযোগ্য যে গণহত্যা সংক্রান্ত সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্ত ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর অনুমোদন পেয়েছিল বলে সেদিনটিই আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃত।

আমরা আশা করতে পারি প্রয়োজনীয় লবিং এবং ভারতসহ অন্যান্য মিত্র দেশের সহায়তায় বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের গণহত্যা অচিরেই জাতিসংঘের তালিকায় স্থান পাবে। এ ব্যাপারে আর কালক্ষেপণ গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বিশ্ববিবেক নিশ্চয়ই এ বিষয়টি মেনে নেবে।

     লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি।

সর্বশেষ খবর