বৃহস্পতিবার, ২৫ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

আমার গ্রিন কার্ড, আমেরিকার ট্রাম্প কার্ড

তসলিমা নাসরিন

আমার গ্রিন কার্ড, আমেরিকার ট্রাম্প কার্ড

আমার আমেরিকার গ্রিন কার্ডটি মনে হচ্ছে বাতিল হতে যাচ্ছে। কারণ কী? আমি কি মুসলিম মৌলবাদী? সন্ত্রাসী? আমেরিকার বিরুদ্ধে কোনও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত? না। আমি বরং মুসলিম মৌলবাদ আর সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে, মানবাধিকার আর নারীর অধিকারের পক্ষে দীর্ঘকাল সংগ্রাম করা মানুষ। আমাকে গ্রিন কার্ড দেওয়া হয়েছিল ‘এক্সট্রা অরডিনারি অ্যাবিলিটি’ বা অসাধারণ দক্ষতার জন্য। আমার পরিবারের লোকেরা আমেরিকার নাগরিকত্ব পেয়েছে, কারণ তারা আমার পরিবার। আর এখন কিনা, আর যারাই ঢুকতে পারুক আমেরিকায়, আমি পারবো না। সুইডিশ পাসপোর্ট হাতে নিয়েও পারবো না। আমি ট্রাম্পের সমালোচক, তাই বলে? কিন্তু আমার সমালোচনা আর ক’জন শুনেছে? আমি নিতান্তই ক্ষুদ্র একটি মানুষ। পৃথিবীর সাধারণ মানুষ কারা ট্রাম্পের নিন্দে করে, হোয়াইট হাউস তার হিসাব রাখে বলে আমার মনে হয় না। আমার মনে হয় না, সব সমালোচকের আমেরিকায় প্রবেশ করা অথবা বাস করা নিষিদ্ধ। তাহলে কেন আজ আমেরিকায় ঢোকার অনুমতি জুটছে না আমার! আমি তো কোনও অপরাধ করিনি, আমেরিকার বিরুদ্ধে কোনও ষড়যন্ত্র করিনি। কাউকে মারিনি ধরিনি। কারও পাকা ধানে মই দিইনি। নিরীহ সাদাসিধে ভালো মানুষটিকে কেন জীবনভর ভুগতে হবে একা! আমার মনে হয়, আমেরিকার সীমান্ত রক্ষীরা আমার নামটিকে পছন্দ করছে না, এই নামে, অনেকে বিশ্বাস করে, মুসলিম মুসলিম গন্ধ আছে। আমার আরও মনে হয়, ওরা পছন্দ করছে না যে দেশে আমি জন্মেছি সে দেশের নামটিকেও! পছন্দ করছে না আমার গায়ের রঙ। সে কারণে আমার গ্রিন কার্ডটিকে বাতিল করার ছুতো খুঁজছে, অবান্তর প্রশ্ন করছে, কেন তুমি তোমার গ্রিন কার্ড হারিয়ে যাওয়ার পর দূতাবাসকে সঙ্গে সঙ্গে জানাওনি! দূতাবাসকে জানাতে আমার দু’মাস দেরি হলো বলে আমি নিষিদ্ধ হয়ে যাবো! কাম অন।

ট্রাম্প ৭টি মুসলিম দেশের মানুষের আমেরিকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। আসলে তিনি মুসলমান নামের মানুষগুলোকেই বাধা দিতে চাইছেন। যখন আমার আমেরিকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ হচ্ছে, ট্রাম্প তখন মুসলিম মৌলবাদীদের সঙ্গে দুলে দুলে তলোয়ার-নাচ নাচছেন। তিনি মুসলিমদের নিষিদ্ধ করেন, কিন্তু মুসলিম-মৌলবাদীদের নিষিদ্ধ করেন না। মুসলিম মৌলবাদী— যারা টাকা-পয়সা দিয়ে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে টিকিয়ে রাখছেন, তাঁরা আজ ট্রাম্পের কাছের লোক। তাঁরা হাজার কোটি টাকার অস্ত্র কেনেন, যে অস্ত্র সন্ত্রাসবাদ ঠেকানোর কাজে নয়, সন্ত্রাসবাদকে আরও বিস্তৃত করার কাজে ব্যবহৃত হয়। ট্রাম্প সুন্নিদের দেশে গিয়ে সন্ত্রাসবাদের জন্য দোষ দিয়ে দিলেন শিয়াদের দেশ ইরানকে। এ ঠিক কেমন বুদ্ধিমানের কাজ করলেন, যখন সারা বিশ্বে সন্ত্রাস করছে যারা, তাদের প্রায় সবাই সুন্নি এবং সৌদি রাজপরিবারের ধর্ম ওহাবিবাদে বিশ্বাসী! অস্ত্র কিনেছে বলে সৌদি আরবের সবাইকে ট্রাম্প ধন্যবাদ জানিয়েছেন। কিন্তু সৌদি আরবের সবাই তো অস্ত্র কেনেনি, কিনেছে সৌদি আরবের রাজপরিবার। এই রাজপরিবারের সঙ্গে আমেরিকার প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলোর সম্পর্ক খুব মধুর। মধুর সেই ১৯৪৩ সাল থেকেই। সেই কত আগে রুজভেল্ট বলেছিলেন, ‘সৌদি আরবের প্রতিরক্ষা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।’ গত সত্তর বছরে সৌদি আরব অবিশ্বাস্য সংখ্যক অস্ত্র কিনছে আমেরিকার কাছ থেকে। ওবামাকে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার দেওয়া হলেও ওবামার আমলে ২০১০ সালে সৌদি আরব কিনেছে ৬০ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র।

ট্রাম্প কী বলেছিলেন সৌদি আরব সম্পর্কে। মনে আছে সে সব? তাঁর নির্বাচনী প্রচারণার সময় সৌদি আরব সরকারকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘এরা উঁচু দালান থেকে সমকামীদের ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। এরা মেয়েদের মেরে ফেলে, মেয়েদের অকথ্য অত্যাচার করে।’ আমেরিকার টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার পেছনে ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘হাত সৌদি আরবের’। সন্ত্রাসী হামলার পেছনে যাদের হাত, তাদের কাছে আজ ট্রাম্প অস্ত্র বিক্রি করছেন। তাহলে কি ট্রাম্পকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধের মানুষ বলা যায়? নিশ্চয়ই যায় না। আমেরিকার এই অস্ত্র মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে গরিব দেশ ইয়েমেনের গরিবদের মারবে। এর মধ্যে দশ হাজার লোক মরেছে, অগুনতি ইয়েমেনি মানুষ উড়ে গেছে আমেরিকার বানানো বোমায়। গত দু’বছরে সৌদি আরব ইয়েমেনের ওপর ৮১ বার হামলা করেছে। হামলা করেছে আমেরিকা থেকে কেনা অস্ত্র দিয়ে। যত বেশি হামলা হবে আমেরিকার অস্ত্র দিয়ে, মগজধোলাই হওয়া তরুণেরা তত বেশি অস্ত্র হাতে নিয়ে পাশ্চাত্যের মানুষদের হামলা করবে। ট্রাম্পের বক্তৃতার কিছু পরেই হামলা হলো ম্যানচেস্টারে। ২২ জনের মৃত্যু হলো।

আইসেনহাওয়ার বলেছিলেন, ‘আমেরিকার মিলিটারি কোম্পানিগুলোর জন্য যা ভালো, তা খুব স্বাভাবিকভাবেই আমেরিকা এবং বিশ্বের জন্য ভালো নয়।’ একেবারে খাঁটি কথা বলেছিলেন। কিন্তু আমেরিকার সরকারে প্রভাবশালী ক’জন এ কথা বিশ্বাস করে?

ট্রাম্পকে সমর্থন করার লোক প্রচুর ছিল। তারা বিশ্বাস করেছিল, ট্রাম্প ইসলামি সন্ত্রাস দূর করবেন। তাঁরা নিশ্চয়ই আশাহত এখন। সন্ত্রাসের সব দোষ ইরানের ওপর চাপিয়ে বিশ্বময় সন্ত্রাস ছড়াচ্ছে যারা, তাদের সঙ্গে কোলাকুলি করে, তলোয়ার নাচ নেচে বন্ধুত্ব আরও গভীর করে এলেন ট্রাম্প। সন্ত্রাস বিলুপ্ত করবেন এই ঘোষণা দিয়ে অস্ত্র বিক্রি করে এলেন সন্ত্রাসীদের গুরুর কাছে।

আর এদিকে শুধু আমাকে নয়, মুসলিম দেশে জন্ম অনেককে অযথাই হেনস্তা করছে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি। আমেরিকা থেকে বের করে দিচ্ছে, অথবা আমেরিকায় ঢুকতে দিতে চাইছে না। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করা মানুষও অনুমতি পাচ্ছে না আমেরিকায় প্রবেশের। আগের সরকার যেভাবে দেশ চালিয়েছে, এই সরকারও সেভাবেই দেশ চালাবে। মাঝে মাঝে ভাবী, আমেরিকার ডেমোক্রেট আর রিপাবলিক দলের মধ্যে আসলে কোনও পার্থক্য নেই। অস্ত্র ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য আমেরিকার সরকার, সে যে সরকারই হোক, যা কিছু করতে পারে। মানবতাকে ধ্বংস করতে তাদের মোটেও অসুবিধে হয় না। এই স্বার্থপর দেশটির দিকে আমরা কি না তাকিয়ে আছি দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে যে এই দেশটিই শক্ত হাতে সন্ত্রাস মোকাবিলা করবে। আমেরিকা সন্ত্রাস যত নির্মূল করে, তার চেয়ে বেশি সন্ত্রাস সৃষ্টি করে। সন্ত্রাসী তৈরিতে এক সময় তো সাহায্যও করেছে। আমেরিকার সাহায্য ছাড়া আল-কায়েদা, আইসিস জন্ম নিতো না।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

সর্বশেষ খবর